নিরুপমা অন্য দিকে চাহিয়া থাকিয়াই জবাব দিল—কিন্তু ছোট-বড় স্থির করবার ভার ত তোমরা আমাদের ওপর দাওনি। যে ঘৃণা করি বলে এখন নালিশ করচ, আমাদের ধর্ম, আমাদের সমাজ মন্দ বলে ঘৃণায় তাঁরাই চলে গিয়েছিলেন, আমরা যাইনি। আজ এ অভিযোগ ত তোমাদের মুখে সাজে না অরুণদা!
অরুণ ক্ষণকাল চুপ করিয়া থাকিয়া কহিল, তাহলে আমাদের ঘৃণা করবার তোমাদের অধিকার আছে বল?
যদি থাকে ত সে তোমাদেরই দান।
তাহলে খুড়ীমার আচরণে রাগ করবার অধিকার ত তোমারও নেই।
নিরুপমা অকস্মাৎ তাহার আরক্ত সজল চোখ-দুটি অরুণের মুখের প্রতি তুলিয়া বলিল, আমার মায়ের ওপর আমার কি অধিকার সে আমি বুঝবো। কিন্তু তুমি কি ক্ষিদে-তেষ্টা চেপে এই দুপুরবেলা আমার সঙ্গে ঝগড়া করতে দাঁড়ালে নাকি? বাড়ি যাও।
যাচ্চি। হাঁ নিরু, আমাকে ছুঁতে কি তোমার ঘৃণা হয়?
হাঁ হয়। তুমি বাড়ি যাও না।
যাচ্চি।
আচ্ছা, খুব একটা নোংরা জিনিস, যেমন—
হাঁ, হাঁ, ঠিক তেমনি। ঠিক তেমনি। তোমার পায়ে পড়ি অরুণদা, বাড়ি যাও—ক্ষিদে-তেষ্টায় তোমার গলা যে শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল।
তা যাক। বলিয়া অরুণ ক্ষণকাল স্থির থাকিয়া পুনরায় কহিল, আমি নিজে থেকে কোন দিন সমাজও ত্যাগ করিনি, অন্য ধর্মও গ্রহণ করিনি। শুধু আমার খুড়ীমাকে মায়ের মত এবং অনাথ বোনটিকে বোনের মতই আশ্রয় দিয়েচি। কেবল এই অপরাধেই যে তোমাদের চোখে এত ছোট হয়ে যেতে পারি, এ কথা কখনো ভাবিনি নিরুপমা। আমিও না, সন্ধ্যাও না। বরঞ্চ গ্রামের মধ্যে তোমরাই শুধু আমাদের ভালবাস, এই আমরা দু-ভাইবোনে ভাবতুম। এতদিন উল্টো বুঝে না জানি তোমার প্রতি আমরা কত উৎপাতই করেচি।
সত্যি নাকি? কৈ কিরকম উৎপাত একটা শুনি?
অরুণ নিজেও একটুখানি শুষ্কভাবে হাসিয়া কহিল, জেনে করিনি বলে মনে নেই নিরু। নইলে মনেও থাকত, বলতেও নিশ্চয় পারতুম।
তাহলে মনে করে এসে তখন ঝগড়া করো। এখন বাড়ি যাও। বেলা আর নেই—মুখে একটু জলটল দাও গে।
হাঁ, যাই! আমাকে মাপ করো ভাই, আর আমি তোমাদের বাড়িতে উপদ্রব করতে আসব না। বলিয়া অরুণ ধীরে ধীরে প্রস্থান করিল।
সে চলিয়া গেলেও নিরুপমা পাষাণমূর্তির মত অপলকচক্ষে সেই দিকে চাহিয়া দাঁড়াইয়া ছিল।
জগদ্ধাত্রী ঘর হইতে বাহির হইয়া কহিলেন, অরুণ চলে গেল?
নিরুপমা ফিরিয়া দাঁড়াইল, বলিল—হাঁ।
কিসে জল খেলে?
জলের বদলে যে জিনিস তুমি দিয়ে গেলে মা, তেষ্টা ঘোচবার পক্ষে সেই কি যথেষ্ট নয়?
মা মুহূর্তকাল মৌন থাকিয়া শান্ত তীক্ষ্ণকণ্ঠে বলিলেন, বটে! আচ্ছা, একটা কথা তোকে জিজ্ঞেস করি বাছা, ওদের সম্বন্ধে কিছু বললেই তুই এমন বিঁধে বিঁধে কথা কোস কেন বল ত। ওর একটি কথা দেখচি তোর সামনে—
বাহির হইতে ডাক আসিল, বলি জগদ্ধাত্রী আছিস গো? এবং সঙ্গে সঙ্গেই একটি প্রবীণ ব্যক্তি—
বারোয়ারি উপন্যাস
একুশ
অরুণের মুখে শাশুড়ীর ওই দুর্দান্ত অসুখের কথা শুনে কমলার দু’চক্ষু ছলছল করে এল। এবং বিশেষ করে সে যখন জানালে যে, জামাইবাবু নিরুদ্দেশ, হয়ত বা তিনি এখন হিমালয়ের কোন গুহার মধ্যে তপস্যায় নিযুক্ত, এবং তাঁকে একটা সংবাদ দেওয়া পর্যন্ত সম্ভবপর নয়, তখন সেই দুটি চোখ দিয়ে বড় বড় অশ্রুর ফোঁটা ধারা বেয়ে নেমে এল।
হঠাৎ কি কারণে যে সতীশ সংসার ত্যাগ করে চলে গেল, এ কথা মনে মনে সবাই বুঝলে, কিন্তু মুখ ফুটে কেউ উচ্চারণ পর্যন্ত করতে পারলে না।
অরুণ বললে, শুধু কি এই? ডাক্তারের কাছে শুনে এলুম, দুর্নামের ভয়ে পাড়ার কেউ শুশ্রূষা পর্যন্ত করতে রাজী নয়। একেই ত ওদের গ্রামে মানুষের চেয়ে জানোয়ারই বেশি, তার ওপর যদি এই উৎপাত হয় ত বুড়ী বেঘোরেই মারা যাবে।
কমলা আঁচলে চোখ মুছে অশ্রুরূদ্ধ স্বরে জিজ্ঞাসা করলে, হাঁ অরুণ, মা কি তবে একলাই পড়ে আছেন? মুখে একফোঁটা জল দেবারও কি কেউ নেই?
অরুণ বললে, অবস্থা ত তাই বটে,—আমাকে ত একরকম দোর ভেঙ্গেই বাড়ি ঢুকতে হয়েছিল। তবে আজ রাতটার মত একটা বন্দোবস্ত করে এসেচি, ডাক্তারবাবু তাঁর হিন্দুস্থানী দাসীটাকে পাঠিয়ে দেবেন ভরসা দিয়েছেন ।
যাক বাঁচা গেল! বলে, হরেন একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললে, রাতটা ত কাটুক;—ভোর পাঁচটায় একটা ট্রেন আছে। আমরা তাইতে বেরিয়ে পড়লে সকাল নাগাদ কমলাকে পৌঁছে দিতে পারবো।
ক্ষিতীশ এতক্ষণ পর্যন্ত চুপ কোরেই ছিল, মুখ তুলে বললে, কমলাকে নিয়ে যাবে? হঠাৎ ওঁকে নিয়ে গিয়ে কি সুবিধে হবে হরেন?
বাঃ—সুবিধে হবে না? সতীশ যখন নেই, তখন শাশুড়ীর সমস্ত দায়িত্ব ত এখন ওরই। তাছাড়া দেখবে কে? শুনলে ত গ্রামের মেয়েরা দুর্নামের ভয়ে বুড়ীর কাছে ঘেঁষতে পর্যন্ত রাজী নয়। কে সেবা করে বল ত?
ক্ষিতীশ লোকটি অত্যন্ত বিচক্ষণ ব্যক্তিও নয়, আগাগোড়া ভেবে-চিন্তে হুঁশিয়ার হয়ে কাজ করাও তার স্বভাব নয়, কিন্তু ভিতরের একটা গোপন বেদনা কিছুদিন থেকে ওই দিকের দৃষ্টিকে তার অত্যন্ত প্রখর কোরে তুলেছিল, সে ক্ষণকাল চুপ করে থেকে বললে, কথাটা ঠিক সত্যি নয় হরেন। আমার মনে হয়, তাঁর অসুখের খবর পাড়ার মেয়েরা জানেন না। কারণ, আমার নিজের বাড়িও ত পল্লীগ্রামে, সেখানে বাপের বাড়ি থেকে বৌ হারিয়ে গেলে, শাশুড়ীর জাত যেতে আমি আজও দেখিনি, এবং এই দোষে পাড়ার মেয়েরা পীড়িতের সেবা করেন না, এত বড় কলঙ্কও তাঁদের দেওয়া চলে না হরেন।
অভিযোগটা হরেনের নিজের গায়েও বিঁধল। সে লজ্জিত মুখে জবাব দিলে, বেশ ত ক্ষিতীশ, সেবা না হয় তাঁরা করতে পারেন, কিন্তু তাই বলে এত বড় একটা টাইফয়েড রোগের সেবাও তাঁরা নিয়মিত কোরে যাবেন, এত বড় বোঝাও ত তাঁদের উপর চাপানো যায় না, ভাই।