বিনোদিনী চোখ তুলিয়া কহিল, ‘আবার কি?’
ভীম একগাল হাসিয়া ফেলিয়া বলিল—’মিথ্যে মিথ্যে, সব মিথ্যে।’
‘কি মিথ্যে?’
‘এই তোমার উইল করার কথা। বললুম তোমাকে, একি হতে পারে? সারাদিন আমি ও বাড়িতে আছি, আমাকে ফাঁকি দেবে কে? আমি জানতে পারলুম না, আর জানলে যত পাড়ার লোকে?’
বিনোদিনী স্বামীর কথা বিশ্বাস করিল না, প্রশ্ন করিল, ‘তুমি কি জেনে এলে তাই বল না?’ ভীম তেমনি আস্ফালন করিয়া কহিল, ‘মিথ্যে তাই জেনে এলুম। একটা সম্ভব-অসম্ভব আছে ত! এ কি হতে পারে আমাকে ফাঁকি আর আমি জানলুম না!’ বিনোদিনী নিঃশব্দে চাহিয়া রহিল। ভীম বলিতে লাগিল, ‘গিয়েই বললুম, ‘মা শোনো’—তিনি মুখ তুলতেই আমি তাঁর চোখের দিকে চেয়ে রইলুম। ওগো, এটা আমার ঈশ্বরদত্ত শক্তি—যে কোন মানুষ হোক না, তার চোখ দেখে আমি মনের কথা ছাপার অক্ষরের মত পড়ে ফেলতে পারি। পড়েও ফেললুম।’ বিনোদিনী একটা নিঃশ্বাস ফেলিয়া বলিল, ‘বেশ করেচ। আমি বলি বুঝি, সত্যই কিছু জেনে এসেচ।’
ভীম ভয়ানক উত্তেজিত হইয়া জবাব দিল, ‘আবার সত্যি কি হবে শুনি? উইল হল, আমি জানলুম না, মা জানলেন না আর জানলে এখানে বসে তুমি? মা আমার কেঁদে ফেলে বললেন, বাবা, আমি সৎমা বলেই—আবার কি চাও তুমি?’ বিনোদিনী আর তর্ক করিল না। সে স্বামীকেও চিনিত, তাঁর বিমাতাটিকেও চিনিত। আর একটা নিঃশ্বাস ফেলিয়া মৃদুস্বরে কহিল, ‘হলেই ভাল। আচ্ছা, যাও তুমি স্নান করে এসো, আমার রান্না হয়ে গেছে।’
ভীম, স্ত্রীর ভাব দেখিয়া বুঝিল, সে কিছুই বিশ্বাস করে নাই। তাই ক্ষুণ্ণ হইয়া বলিল, ‘আমার কথায় তোমার বিশ্বাস হয় না, বিশ্বাস হয় পরের কথায়। আচ্ছা, তখন টের পাবে—কিন্তু, আমি ত এখানে খেতে পারব না—আমাকে এখনি ফিরে যেতে হবে ‘ বলিয়া ভীমচাঁদ যেমন করিয়া আসিয়াছিল, তেমনি করিয়া চটি-জুতার পটাপট শব্দ করিয়া বাহির হইয়া গেল।
পিতৃশ্রাদ্ধ ভীমচাঁদ মহা আড়ম্বরে সম্পন্ন করিল। সদ্য বিধবা সুখদা কাঁদিয়া কাটিয়া জানাইলেন, লোহার সিন্দুকে কিছু নাই। ভীমচাঁদ জ্যেষ্টপুত্র, সুতরাং সমস্ত কর্তব্য তাহারই, সে স্ত্রীর গহনা বন্ধক দিয়া, এবং এক পাটের মহাজনের নিকট খত লিখিয়া দু’ হাজার টাকা কর্জ করিয়া সমস্ত ব্যয়ভার নিজেই বহন করিল। শ্রাদ্ধ-শেষে রেজেস্ট্রি-করা উইল বাহির হইল, উকিল সর্বসমক্ষে পড়িয়া শুনাইলেন। তাহাতে শিবদাসবাবু, দ্বিতীয় পক্ষের তিনটি ছেলেকেই সমস্ত বিষয়-সম্পত্তি তিন সমান ভাগে দিয়া গিয়াছেন, ভীমের ভাগ্যে এক কানাকড়িও নাই। ভীম শুষ্ক মুখে অধোবদনে বসিয়া রহিল।…
একটি অসমাপ্ত গল্প
আচ্ছা, জ্যাঠামশাই?
কেন মা? বলিয়া গোবিন্দ মুখুয্যে ভাগবত হইতে মুখ তুলিয়া পরম স্নেহে তাঁহার ভ্রাতুষ্পুত্রীর দিকে চাহিলেন।
সুরমার দুই চোখে জল টলটল করিতেছিল। হাত দিয়া একগোছা কালো চুল মুখের উপর হইতে পিঠের দিকে সরাইয়া দিয়া মহা অভিমান ভরে অভিযোগ করিল,—আচ্ছা, সাহেবরা যদি এতই পারে তবে কেন তারা দাঁড়কাকগুলো সব মেরে ফেলে না? বলিয়া কাঁদিয়া ফেলিল।
গোবিন্দ ব্যাপার বুঝিয়া সুরমাকে কাছে টানিয়া লইয়া তাহার চোখ মুছাইয়া দিলেন। বাটীর ভিতরে তাঁহার স্ত্রী দুরারোগ্য পীড়ায় শয্যাগত,—মরণাপন্ন। এবং এইমাত্র চিলের ছাদে বসিয়া একটা দাঁড়কাক অতি কর্কশ কণ্ঠে খাখা করিয়া চীৎকার করিতেছিল।
সেটাকে তাড়াইয়া দিয়া সুরমা অত্যন্ত বিরক্ত ও ভীত হইয়া জ্যাঠামশায়ের কাছে জানিতে আসিয়াছিল—কি জন্য সরকার বাহাদুর এত ক্ষমতাশালী হইয়াও এই ভীষণ অত্যাচার নিবারণ করিতে পারিতেছেন না।
খানিক পরে গোবিন্দ একটুখানি শুষ্ক মলিন হাসি হাসিয়া বলিলেন, সাহেবদের কথা ত জানিনে মা, কিন্তু দাঁড়কাকের অপরাধটা কি শুনি?
সুরমা তখন চোখের জল মুছিয়া ফিসফিস করিয়া অনেক নালিশ করিল। কহিল, ইহারাই যমরাজের গুপ্তচর, এবং তাহার অকাট্য প্রমাণ এই যে, দাঁড়কাক হইয়াও ইহাদের গলা ময়ূরের মত চিকচিক করে। ছাদে কিংবা নিকটবর্তী কোন বৃক্ষশাখায় বসিয়া আয়-আয়-খাখা করিয়া ইহারা বাটীতে যমদূত ডাকিয়া আনে। বউদিদি বলিয়াছেন, কাহারও ছাদে বসিয়া ডাকিলে আর রক্ষা নাই,—সে বাটীর কেহ-না-কেহ নিশ্চিত মরে। বলিতে বলিতে সুরমা সহসা জ্যাঠামশায়ের বুকে মুখ লুকাইয়া ফুঁপাইয়া ফুঁপাইয়া কাঁদিতে লাগিল। তাহার বাপ-মা নাই, কবে মরিয়াছেন জানেও না। জ্যাঠাইমাই মানুষ করিয়াছেন। সেই স্নেহময়ী আজ সুদীর্ঘ ছয় মাস কাল রোগশয্যায় পড়িয়া। আজ তাঁহারই মরণ কামনা করিয়া ওই ঘৃণিত পক্ষীটা যখন বারংবার ডাকিয়া গিয়াছে, তখন কি উপায়ে কেমন করিয়া তাঁহাকে আর মৃত্যুর অনিবার্য কবল হইতে রক্ষা করা যাইবে! উপায় না পাইয়া যখন সে বুক ফাটিয়া ফাটিয়া কাঁদিতে লাগিল, তখন এই উপায়বিহীনাকে বুকে চাপিয়া ধরিয়া আর এক নিরুপায়ের চোখ দিয়া টসটস করিয়া জল গড়াইয়া পড়িল।
রাত্রে আহার করিতে বসিয়া গোবিন্দ বধূকে ডাকিয়া মৃদু অনুযোগের স্বরে বলিলেন, ছি মা, ও মেয়েটার জ্যাঠাইমা-অন্ত প্রাণ, তাকে কি এমন করে ব্যাকুল করে দিতে আছে?
এই বধূটি অত্যন্ত মুখরা। এখন শ্বশুরের সুমুখে কিছু বলিল না বটে, কিন্তু তিনি আঁচাইতে বসিয়া স্পষ্ট শুনিতে পাইলেন, বধূ অস্ফুট ক্রুদ্ধ বিড় বিড় করিতেছে—ইস কচি খুকি কিনা, তাই ভয় দেখিয়ে ব্যাকুল করে দিয়েচি! এগারো-বারো বছরের মেয়ে হল, ও নিজেই ত সব জানে! আজকাল রাত্তির হলে বাড়িসুদ্ধ লোকের ভয়ে গা ছমছম করে, বজ্জাত মেয়ে আবার তাই কিনা লাগিয়ে এসেচে।