দ্বিতীয় গর্ভাঙ্ক
দুদিন পরে পথ্যি কোরেই আজ আবার কেন সেলাই নিয়ে বসলি মা? একটু শুগে না।
সেলাই-এর প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখিয়াই কহিল, দুপুরবেলা আমি ঘুমোতে পারিনে মা। তা ছাড়া সন্ধ্যা ভারী তাগাদা করে পাঠিয়েছে, আজ এটা শেষ করে দিতেই হবে। কাল সকালেই হাট কিনা।
এই সব বিক্রি করে তবে বুঝি তোমাদের মেয়ে-ইস্কুলের খরচ চলে? কেন সন্ধ্যার বাপের ত টাকার অভাব নেই? তার দাদা অরুণও ত শুনতে পাই অনেক টাকার মানুষ। সেও কি বোনের শখের ইস্কুলের খরচটা দিতে পারে না?
পারবে না কেন মা? কিন্তু আমরা কারো কাছে সাহায্য চাইনে। নিজেদের খরচ নিজেরাই চালাই। সন্ধ্যা বলে, মেয়েরা আরও একটু ভালো সেলাই শিখলে, আমাদের ইস্কুলেরও ভাবনা থাকবে না। তাদের নিজেদেরও অভাব ঘুচবে। এমন কি যদি দরকার হয়, ভবিষ্যতে তারা শুধু সেলাই করেই আপনাদের খরচ আপনারা চালাতে পারবে। একি সোজা কাজ মা?
হাটে যাবে কেন মা,—দোকানদার বাড়িতে এসে দাম দিয়ে কিনে নিয়ে যাবে। আর তাই যদি বল, এ সব ভদ্রঘরের মেয়েরি ত বেশি দরকার। ছোটলোকদের মেয়েরা অনেক কাজ করতে পারে, যা আমরা পারিনে। শশীর মায়ের যে কত কষ্ট যাচ্ছিল মা! রোজ দুবেলা ভাত পর্যন্ত জুটত না। ভিক্ষে করে ত আর দুঃখ ঘোচে না, তাই সন্ধ্যা তাদের দু’বোনকেই ডেকে নিয়ে যায়। এই তিন মাসের মধ্যেই তাদের কত উপকার হয়েছে জানো মা? গেল মাসে দু’ বোনে শুধু রুমাল বেচেই পেয়েছে ১৪ টাকা।
আচ্ছা, আমার কাছে যে শশীর মা কালী-পূজোর দিন চার আনা পয়সা ধার নিয়েছিল, কৈ সে ত দিলে না।
নিরুপমা হাসিয়া বলিল, তাও ভোলো নি মা? আচ্ছা, আমি তোমার পয়সা আদায় করে দেব। তখন তাদের বড় কষ্ট ছিল। কিন্তু এখন ঐ চার আনা আট আনা পয়সা তারাই ধার দিতে পারে। বলিয়া সে পুনরায় কাজে মন দিল।
জগদ্ধাত্রী খুশী হইয়া কহিলেন, আহা, তা হোক। লোকের ভাল হলেই ভাল। এত ফন্দিও জানে ঐ সন্ধ্যা মেয়েটি। মাগী বড় কষ্টেই পড়েছিল, তা নিস্ মা চেয়ে পয়সা-ক’টা মনে করে। আহা খুলচিস কেন সেলাইটা? ফুলটি ত বেশ হচ্ছিল!
না মা,—কথা কইতে কইতে ভুল হয়ে গেছে। কিন্তু কখ্খনো ভুল হয় না দেখেচি সন্ধ্যার।
কথা কইচে, শেখাচ্চে, পড়াচ্চে,—আবার নিজেও কাজ করে যাচ্ছে, কিন্তু একটা ফোঁড় কখনো উলটো পড়ে না! তার হাতের কাজ যদি দেখ মা ত অবাক হয়ে যাবে।
জগদ্ধাত্রী বিশেষ খুশি হইলেন না! নিজের মেয়ের চেয়ে পরের মেয়ের অধিক গুণপনার কথা বোধ করি তাঁহার তেমন ভাল লাগিল না। অবহেলার ভাবে বলিলেন—হবে না কেন বাছা! আমাদের হিঁদুর ঘরের মেয়েরা ত আর মেম রেখে সেলাই শিখতে যায় না! শিখলে ওদের মতই হতো। ছোঁয়াছুঁয়ি করে ওদের নাইতেও হয় না, কাপড়টাও ছাড়তে হয় না। মা গো মা! হাজার হোক বাঙালী ঘরের মেয়ে ত! কি করে যে সেই কাপড়-চোপড়ে ওদের মুখে ভাত ওঠে, আমি তাই শুধু ভাবি। বলিতে বলিতেই তিনি ঘৃণায় যেন কণ্টকিত হইয়া উঠিলেন।
নিরুপমা নীরবে কাজ করিতে লাগিল,—কথা কহিল না।
জগদ্ধাত্রী একটু স্থির থাকিয়া কহিলেন, তোর বাপের সেই হাতকাটা জামাটা একটু ছিঁড়ে গেছে—নিয়ে আসব সেরে দিতে পারবি?
নিরুপমা মুখ না তুলিয়াই বলিল, পারবো বৈ কি মা, নিয়ে এসো।
জগদ্ধাত্রী জামা আনিতে যাইতেছিলেন, হঠাৎ এই অসময়ে অরুণকে প্রবেশ করিতে দেখিয়া থমকিয়া দাঁড়াইলেন। অরুণের হাতে একখানা কাগজের মোড়ক ছিল। সে মুহূর্তকাল থামিয়া কহিল, খুড়ীমা, ভাল ত সব? বলিতে বলিতেই তাহার দৃষ্টি কর্ম-নিরত নিরুপমার উপরে গিয়া পড়ল।
জগদ্ধাত্রী অপ্রসন্ন স্বরে বলিলেন, ভাল আর তেমন কৈ বাছা! আমার—
কিন্তু কথাটা শেষ হইতে পাইল না কারণ, দাঁড়াইয়া শুনিবার ধৈর্য অরুণের ছিল না। সে সোজা অগ্রসর হইয়া গিয়া নিরুপমার সম্মুখে দাঁড়াইয়া কহিল, এই নাও তোমার কার্পেটের প্যাটার্ন। সন্ধ্যা বললে, কলকাতায় যাচ্ছো দাদা, অমনি নিরুপমার জন্যে আমার মত একটা কিনে এনো। তা খুঁজে খুঁজে আর কোথাও পাইনে, শেষে একটা সাহেবের দোকান থেকে জোগাড় করেচি।
নিরুপমা হাত বাড়াইয়া মোড়কটি গ্রহণ করিয়া কৃত্রিম ভর্ৎসনার স্বরে কহিল, কেন তুমি এই রোদের মধ্যে এত কষ্ট করতে গেলে? এ প্যাটার্ন আমার না হয় নাই হতো। ইস্টিশান থকে সোজা আসচ বুঝি? এখনো বাড়ি যাওনি? নাওয়া খাওয়া হয়নি?
না। এক গেলাস জল দাও দিকি। ভয়ানক তেষ্টা পেয়েচে।
জগদ্ধাত্রী এতক্ষণ অদূরে দাঁড়াইয়া ছিলেন। বিরক্তির স্বরে কহিলেন—ঝিকে ডেকে জল দিতে বল নিরু। হাত থেকে ওটা নিলি—মন ভুলে আবার যেন তুই খাবার জলের কলসি-টলসি ছুঁয়ে ফেলিস নে বাছা! বলিয়া ঘরে চলিয়া গেলেন। উভয়েই উভয়ের প্রতি ক্ষণকাল হতবুদ্ধির মত চাহিয়া থাকিয়া, অরুণ তাড়াতাড়ি বলিয়া উঠিল, থাক থাক আর জলে কাজ নেই,—আমি বাড়ি গিয়েই খাবো অখন।
নিরুপমা উঠিয়া গিয়া মুখের পানটা একধারে ফেলিয়া দিয়া কাঁদ-কাঁদ হইয়া বলিল, কেন তুমি আমাকে কষ্ট দিতে এ বাড়িতে কোন কিছু চাও? একদিন মা তোমাকে মাটির ভাঁড়ে জল খেতে দিয়েছিলেন, তোমার মনে নেই?
অরুণ হাসিবার চেষ্টা করিয়া বলিল, না, আমার মনে ছিল না। কিন্তু হলোই বা মাটির ভাঁড় তাতে কি তেষ্টা ভাঙ্গে না?
জানিনে তোমার ভাঙ্গে কি না। কিন্তু আমার যে—বলিতে বলিতেই সে অকস্মাৎ ঘাড় ফিরাইয়া আর এক দিকে চাহিয়া চুপ করিল।
অরুণ হাসিল। কহিল, কিন্তু তুমিও ত মুখের পান ফেলে দিলে নিরু। শুধু খুড়ীমার দোষ দিলে হবে কেন? ওটা ত তিনি বলেন নি! একটা ছাগল কি একটা বেড়াল ছুঁয়ে ফেললে ত তুমি এ কাজ করতে না। আমার নিরাশ্রয় ব্রাহ্ম বোনটিকে আশ্রয় দিয়ে কি আমি তার চেয়েও ছোট হয়ে গেছি?