গবেষণামূলক প্রবন্ধ! ইহাতে সাধারণতঃ কি বুঝায়, এ প্রশ্ন আর কোন দেশের লোক করিয়া বসিলে নিশ্চয়ই বিপদে পড়িতাম এবং খুব সম্ভব জবাব দিতেও পারিতাম না, কিন্তু, বাঙ্গালা মুলুকের লোকের কাছে ভয় পাইবার কিছুমাত্র হেতু দেখি না। কারণ, এ মুলুকের গবেষণার ধারা আমি বিদিত আছি। ইহা মাত্র দুই প্রকার এবং গবেষণাকারীরা দুই দল হইয়া বিরাজ করেন। এ দলের একজন যাই ‘পদ্যপ্রচারিণী’তে গবেষণা করেন, ‘বিক্রমপুর পরগণার স্বর্ণভৃগু গ্রামের তিন্তিড়ী বৃক্ষমূলে যাহা পাওয়া গিয়াছে তাহাই ভোজরাজের তাম্রশাসন এবং ইহাই বাঙ্গালার ইতিহাসের প্রকৃত উপাদান।’ ‘গদ্যপ্রচারিণী’তে ও-দলের আর একজন তৎক্ষণাৎ প্রতিবাদ করেন—‘কখনই না। কারণ, এই প্রমাণ—ওই প্রমাণ—সেই প্রমাণের বলে স্পষ্ট জানা যাইতেছে, ওটা ভোজরাজের তাম্রশাসন হইতেই পারে না, ওইটাই তাম্ররাজের ভোজশাসন, যাহা নবম ধর্মপালদেব পঞ্চম বিক্রমপালদেবকে যুদ্ধে পরাস্ত করিয়া উজ্জয়িনীর তটে—উৎকীর্ণ করিয়া তাম্রলিপ্ত নগরে প্রোথিত করিয়াছিলেন, অতএব ইহাই বাঙ্গালার আসল ইতিহাস।’
দ্বিতীয় প্রকার হইতেছে, প্রাচীন কবিদিগের কাল নিরূপণ করা। একজন বলিতেছেন, কবি কালিদাসের প্রকটকাল ৫৬৮ শকে, আর একজন সংশয় প্রকাশ করিয়া জবাব দিতেছেন—শ্রদ্ধেয় লেখকের গণনায় ঈষৎ ভুল হইয়াছে। কারণ, অনঙ্গদেবের প্রপিতামহ তখন মগধের সিংহাসন অলঙ্কৃত করিয়াছিলেন। সুতরাং এক পুরুষে যদি ২৫ বৎসর ধরা যায়, তাহা হইলে কালিদাসের জন্মকাল ১১৯৩ সংবতের পূর্বে ঘটিতেই পারে না।
এখানে হতভাগ্য পাঠক-পাঠিকার অবস্থা সহজেই অনুমেয়। আত্মরক্ষা অতি শ্রেষ্ঠ ধর্ম, এবং এ অধিকার সকলেরই আছে। কাজেই, পাঠকবেচারা যদি প্রাণের দায়ে গবেষণার হাত ছিনাইয়া কথাসাহিত্যের ভিতরে গিয়া ঢোকে তাহাকে নিন্দা করা চলে না। অবশ্য, এই যাওয়াটাকে ইংরাজি ভাষায় ‘ফ্রাইং প্যান টু দি ফায়ার’ বলিয়া পরিহাস করা চলে কিনা, ঠিক জানি না, কিন্তু আর কোন নিরাপদ স্থানের সংবাদও ত তাহাকে বলিয়া দিতে পারিলাম না।
এ হেন যে ‘গবেষণামূলক’ তাহা যে কি বস্তু আশা করি সাধারণকে তাহা বুঝাইতে পারিয়াছি। অন্ততঃ আমি ত শপথ করিতে পারি, বাঙ্গালা গবেষণাময় প্রবন্ধে ইহার অধিক কিছু এখনও আবিষ্কার করিতে সক্ষম হই নাই। কেহ হইয়া থাকিলে দয়া করিয়া লিখিয়া জানাইবেন, আজীবন কৃতজ্ঞ হইয়া থাকিব।
এইবার ‘কথাসাহিত্যের’ কথা। দুনিয়ায় গান গাহিতে পারে না এমন লোক বিরল, কথাসাহিত্য সৃষ্টি করিতে পারে না এমন হতভাগা ত নাই-ই। কারণ, কথার ত অন্ত নাই। থাকিলে, আজ পর্যন্ত এত মানুষ এত কথা লিখিয়া ফেলিয়াছে, কোন্ যুগে ইহার শেষ হইয়া যাইত। সে ত হইবার নয়। যাহার আদি অন্ত নাই তাহার অতীতও নাই ভবিষ্যৎও নাই। যাহা ঘটিয়া গিয়াছে তাহাও গত নয়, যাহা ঘটে নাই তাহাও অনাগত নয়। সৃষ্টি করার পক্ষে ইহাই ইহার প্রচণ্ড সুবিধা। মানুষের অদৃষ্ট ত দেখা যায় না, সে কি করিবে না করিবে, কি হইবে না হইবে, কোথায় জীবনের কূল-কিনারা সে ত কাহারও ঠাহর করিবার জো নাই, তাই নবীন সাহিত্যস্রষ্টা যখন দিকচক্রবালে আঙুল তুলিয়া জোর করিয়া বলেন, ওর বেশি নাই, তখনও চুপ করিয়া থাকিতে হয়, এবং ভাবুক কবি যখন অপার আকাশে মুখ তুলিয়া মানবসৃষ্টির অগোচর বহু বহু দূরে ইঙ্গিত করিয়া হৃদয়ে অসীমতার আভাস জাগাইয়া দেন তখনও নির্বাক স্তব্ধ হইয়া থাকিতে হয়। হয় বটে, কিন্তু চুপ করিয়া যাওয়া এবং স্তব্ধ হইয়া থাকা এক বস্তু নয়। তাহাই বলিতেছি…।
দেশসেবা
দেশসেবা কথার কথা নয় দেশসেবা মানবের শ্রেষ্ঠ সাধনা। স্বার্থ-গন্ধ থাকবে না, নাম-যশের আকাঙ্ক্ষা থাকবে না, প্রাণের ভয় পর্যন্ত থাকবে না, এক দিকে দেশসেবক নিজে, আর দিকে তার দেশ, মাঝে আর কিছু থাকবে না। যশ, অর্থ, দুঃখ, পাপ, পুণ্য, ভাল, মন্দ সব যে দেশের জন্য বলি দিতে পারবে, দেশসেবা তার দ্বারাই হবে।
রাষ্ট্রীয় সাধনাতে নারীকেও নাবতে হবে—দেশের স্বাধীনতার জন্য নারী-পুরুষের সম্মিলিত সাধনা চাই, তা নইলে কিছু হবে না। আমি জানি ছেলেরা আর মেয়েরা যদি এক সঙ্গে কাজে নামে, তাহলে দেশের লোক নানারকম কুৎসা রটাবেই—তা রটাক। নিন্দুক তার কাজ করবেই, কিন্তু তাই বলে কি আমরা কাজ বন্ধ রাখবো? দেশের জন্য যে সুনামের প্রতিষ্ঠা ত্যাগ করতে পারবে না, তার আবার ত্যাগ কোথায়?
দেশের স্বাধীনতা কেউ চায় না—সবাই চায় নাম প্রতিষ্ঠা, বড় বড় বচন ঝেড়ে নেতা হতে—সত্যিকার ক’টা লোক পরাধীনতার জ্বালা অনুভব করে? দেশের কি দেখে আশান্বিত হব? আমার দেশের ছেলেরা ম্যালেরিয়ায় ভুগে মরবে, তবু দেশের জন্য মহিমময় মৃত্যুবরণ করতে পারবে না। দেশের জন্য লাঞ্ছনা সওয়া, দেশের জন্য প্রাণ দেওয়া সে কি সোজা সৌভাগ্য? দেশ উঠবে কি করে? দেশের জন্য কি কেউ প্রাণ দিতে চায়? দেশের জন্য কি কেউ ত্যাগ স্বীকার করতে চায়? আবার যেদিন দেশে নগরে স্বার্থত্যাগী সন্তান জন্মাবে, সত্যিকার দেশের কাজ সেই দিন সম্ভব হবে।
‘নারীর মূল্য’র ভূমিকা
১৩২০ সালের ‘যমুনা’ মাসিকপত্রে ‘নারীর মূল্য’ প্রবন্ধগুলি ধারাবাহিকরূপে যখন প্রথম প্রকাশিত হয়, তখন আমরা এগুলি গ্রন্থাকারে ছাপিবার অনুমতি লাভ করি।
কি মনে করিয়া যে শরৎবাবু তখন আত্মগোপন করিয়া শ্রীমতী অনিলা দেবীর ছদ্মনাম গ্রহণ করিয়াছিলেন, সে তিনিই জানেন। তবে, তাঁহার ইচ্ছা ছিল এমনি আরও কয়েকটি ‘মূল্য’ লিখিয়া ‘দ্বাদশ মূল্য’ নাম দিয়া পরে যখন গ্রন্থ ছাপা হইবে, তখন তাহা নিজের নামেই বাহির করিবেন। তারপরে, এই দীর্ঘ দশ বৎসর কাটিয়া গেল, না লিখিলেন তিনি আর কোন ‘মূল্য’, না হইতে পাইল ‘দ্বাদশ মূল্য’ ছাপা। আমরা গিয়া বলি, মশায়, আপনার দ্বাদশ ‘মূল্য’ আপনারই থাক, পারেন ত আগামী জন্মে লিখিবেন, কিন্তু যে ‘মূল্য’ আপাততঃ হাতে পাইয়াছি, তাহার সদ্ব্যবহার করি,—তিনি বলেন, না হে, থাক, এ আর বই করিয়া কাজ নাই। কিন্তু কারণ কিছুই বলেন না। এমনি করিয়াই দিন কাটিতেছিল। অথচ, তাঁহার মতের পরিবর্তন হইয়াছে তাহাও নয়,—আমাদের শুধু মনে হয়, তখনকার কালে নারীরা নিজেদের অধিকার সম্বন্ধে কথা কহিতে শিখে নাই বলিয়াই এ কাজ তিনি করিয়াছিলেন, কিন্তু এখন কাগজে কাগজে ইঁহাদের দাবী-দাওয়ার প্রাবল্য ও পরাক্রান্ত নিবন্ধাদি দর্শন করিয়া এই বৃদ্ধ গ্রন্থকার ভয় পাইয়া গেছেন। তবে, এ কেবল আমাদের অনুমান, সত্য নাও হইতে পারে। কিন্তু এ কথা ঠিক যে, এ বই ছাপাইবার তাঁহার প্রবৃত্তি ছিল না। তাঁহার ইচ্ছার বিরুদ্ধে ইহা প্রকাশ করিয়া ভাল করিয়াছি, কি মন্দ করিয়াছি, তাহা পাঠক বলিতে পারেন, আমাদের ত মনে হয় মন্দ করি নাই। কিন্তু ইহার যত কিছু দায়িত্ব সে আমাদেরই।
বামুনের মেয়ে’র নাট্যরুপ
প্রথম অঙ্ক