চক্ষু ও মুখের ভাব দেখিয়া লিও পূর্বেই কিছু ভীত হইয়াছিল, এবার নিতান্ত ভয়ের সহিত বলিল—‘আমাকে যে আজ যাইতে হইবে। সময় উত্তীর্ণ হইতেছে।’
মেরি সে কথা শুনিতে পাইল বলিয়া বোধ হয় না। আপনার মনে একটা বহুমূল্য উষ্ণ শাল আনিয়া তাহার বক্ষ পর্যন্ত ঢাকিয়া দিয়া বলিল—‘লিও, এ সময়ে আমার সহিত কলহ করিলে চলিবে না। তুমি মনে করিয়াছ, ঋণ পরিশোধ করিয়াছ? কিছুই কর নাই!—আজ নয়, ভাল হও, তাহার পর এ কথা বুঝাইয়া দিব। তোমার যখন শরীর অসুস্থ তখন ও শরীরে আমারই সর্বময় অধিকার, আবার যখন ভাল হইবে তখন যাহা ইচ্ছা করিও—’
লিও স্তম্ভিত হইয়া গেল। এ কি কথা! ক্লিষ্ট শরীর মন্ত্রমুগ্ধবৎ ঢলিয়া আসিতেছিল, অর্ধমুদ্রিত চক্ষে লিও জোর করিয়া কহিল, ‘ছাড়িয়া দাও—আমি লন্ডনে যাইব।’
মেরি তাহার মুখের উপর মুখ রাখিয়া বলিল, ‘লন্ডনের কথা ছাড়িয়া দাও,—আমাকে জিজ্ঞাসা না করিয়া শয্যার নীচে নামিলে, আমি এই ছাদ হইতে নীচে লাফাইয়া পড়িব। আমার মন এখন পাগলের মত হইয়া আছে,—অবাধ্য হইলেই প্রাণ বিসর্জন দিব।’
লিও ধীরে ধীরে বলিল, ‘তবে আর কি করিয়া যাইব।’ তাহার পর পার্শ্ব পরিবর্তন করিয়া ঘুমাইয়া পড়িল।
এগার
পনর দিনের মধ্যে লিওর রীতিমত সংজ্ঞা হইল না; পনর দিন মেরি তাহার শয্যা ত্যাগ করিল না।
ডাক্তার বলিল, ‘মেরি, অত পরিশ্রম করিলে তুমিও পীড়িত হইয়া পড়িবে।’
মেরি ম্লান হাসিয়া উত্তর দিল, ‘ডাক্তার মহাশয়, এ সময়ে আমি পীড়ার ভয় করি না। এ স্থান ত্যাগ করিলেই আমার পীড়া হইবে।’
ডাক্তার বলিল, ‘আমি ধাত্রী আনাইয়া দিতেছি—দুইজনে পালা করিয়া শুশ্রূষা কর।’
মেরি মুখখানি আরও মলিন করিয়া বলিল, ‘তাহা হইবে না। এ সময়ে আমার কাহাকেও বিশ্বাস হয় না। গোলাপ ফুল বাসী হইয়াছে, রৌদ্রের তাপে বড় নিস্তেজ হইয়া পড়িয়াছে—এতটুকু আঘাতেই হয়ত ঝরিয়া যাইবে,—তখন তুমি কি তাহাকে ফিরাইয়া দিতে পারিবে?’
নিরুত্তরে ডাক্তার চলিয়া গেল।
রোগ বেশি নহে, তথাপি লন্ডন হইতে তিন-চারজন ডাক্তার মেরির বাটীতে এই পনর দিন ধরিয়া বসিয়া আছে। একদিন তাহারা বলিল, ‘অনর্থক আর কেন আমাদিগকে ধরিয়া রাখিয়াছ—রোগ সারিয়া গিয়াছে।’
মেরি তাহাদের হাত ধরিয়া কাতর-কণ্ঠে কহিল, ‘ওগো, তোমরা আমার লিওকে সম্পূর্ণ সুস্থ করিয়া আমার হাতে দিয়া—আমার সর্বস্ব লইয়া যাও—মানা করিব না কিন্তু এখন যাইও না—।’
তিন সপ্তাহ পরে লিওপোল্ড উঠিয়া বসিল। ডাক্তার এবং ঔষধের উপদ্রব আর নাই—। মেরি জানালা খুলিয়া দিল—আকাশে চাঁদ উঠিয়াছিল,—জ্যোৎস্না ঘরে আসিয়া পড়িল—মেরি চাঁদের পানে চাহিয়া সহসা লিওর বুকের উপর আসিয়া পড়িল। নিঃশব্দে অনেকক্ষণ বুকের উপরে অশ্রুসিক্ত করিল, তাহার পর চাঁদের পানে চাহিয়া বলিল, ‘ঐ দেখ, এখনও চাঁদের ভিতর কলঙ্ক বসিয়া আছে,—তোমারও কলঙ্ক তোমার বুকের উপর স্থান পাতিয়া বসিয়াছে,—তাড়াইবে কি করিয়া?’
লিওর চক্ষেও জল আসিল; সংবরণ করিয়া কহিল, ‘কলঙ্কই হউক, শোভাই হউক—বুকের উপর বড় দৃঢ় বসিয়াছে—পরিত্যাগ করিবার ক্ষমতা আমার নাই।’
তাহার পর একদিন বসন্ত প্রভাতে কোরেল গ্রামের গির্জায় বড় ধুমধামের সহিত ঘণ্টা বাজিয়া উঠিল। সমস্ত গ্রামবাসী বড় জাঁকজমকের সহিত প্রফুল্ল মনে সেই দিকপানে ছুটিয়া চলিয়াছে—।
সেখানে কি হইতেছে তোমরা কেহ জিজ্ঞাসা করিবে কি?
দু’টি আবেদন
এক
ভারতের সর্বাঙ্গীণ মুক্তি-আন্দোলনে জাতীয় কংগ্রেসই ছিল এতাবৎ একমাত্র রাজনীতিক প্রতিষ্ঠান। কিন্তু ইহার শক্তি ছিল ক্ষুদ্র, উদ্যম ছিল অকিঞ্চিৎকর, পরিসর ছিল সঙ্কীর্ণ, এবং জীবন ছিল নৈরাশ্যপীড়িত, দেশের যৌবনশক্তি না যতদিন ইহাতে যোগ দিয়াছিল। ইহা যে অত্যুক্তি নয় একটু চিন্তা করিয়া দেখিলেই তাহা দেখা যাইবে।
কংগ্রেসকে শক্তিশালী করিয়াছে দেশের যৌবন, তথাপি সেই কংগ্রেসের কাটা-ছাঁটা, ধরা-বাঁধা মুষ্টিভিক্ষায় যৌবনের ক্ষুধা মিটিল না; তাই যুব-সমিতির সৃষ্টি। এই তো সেদিনের কথা,—জন্মের তারিখ গণনায় ইহার হিসাব মিলিবে না, কিন্তু যে মুহূর্তে সে নিঃসংশয়ে অনুভব করিয়াছে তাহার বাধা নাই, বিনাশ নাই, সে অপরাজেয় এবং তাহার ‘পরেই এ দুর্ভাগা দেশের সব চেয়ে বড় দাবী, সেই দিন হইতেই এই সমিতির বিস্তৃতির আর বিরাম নাই। সঙ্ঘ-শক্তির অপরিমেয় বিকাশে আজ এই প্রতিষ্ঠান অগ্নিকাণ্ডের ন্যায় ভারতের সর্বত্র ব্যাপ্ত হইয়া পড়িয়াছে।
স্বদেশের মুক্তি-সংগ্রামে বাঙ্গলার স্থান যে কোথায় এ কথা নিজে বাঙ্গালী হইয়া উচ্চারণ করিলে আমার অবিনয়ের অপরাধ স্পর্শিবে। কিন্তু এই বঙ্গদেশের মাঝখানে হাওড়া জেলার নাম সসম্ভ্রমে উল্লেখ করিতে আর কোন সঙ্কোচ নাই। ইহার বিগত ইতিহাস যাঁহারা জানেন তাঁহারাই এ কথার সত্যতা বুঝিবেন।
অন্যান্য স্থানের ন্যায় হাওড়ার যুব-সমিতির সম্মিলনও আসন্নপ্রায়। ইহার অনেক কাজ রহিয়াছে। তাই সর্বসাধারণের কাছে, বিশেষ করিয়া দেশের তরুণসম্প্রদায়ের কাছে আমার একান্ত নিবেদন, তাঁহারা যেন একযোগে এই সম্মিলনীকে সার্থক ও সাফল্যমণ্ডিত করিতে অবহেলা না করেন। আপনাদের পক্ষ হইতে আমি বঙ্গদেশের সকল জেলার সকল কর্মীকেই আমন্ত্রণ করিব এবং নিঃসন্দেহে জানি আমার আহ্বান তাঁহারা কেহই উপেক্ষা করিতে পারিবেন না।
যৌবনে নিজের আর আমার দাবী-দাওয়া নাই, সামর্থ্যও নিঃশেষিতপ্রায়, তথাপি ইহার উদ্বোধনের ভার যুবকেরা স্নেহবশতঃ আমার হস্তেই ন্যস্ত করিয়াছেন। যথাশক্তি কর্তব্য সমাপন করিব প্রতিশ্রুত হইয়াছি।