মেরি উপরে বসিয়া ছিল, ভৃত্য সংবাদ দিল, ‘লিও টাকা লইয়া আসিয়াছে।’ মেরি Bond লইয়া নীচে নামিয়া আসিল। কিন্তু টাকার কথায় সে আদৌ বিশ্বাস করে নাই, এবং এজন্য আপনাকেও প্রস্তুত করে নাই। সমস্ত দিন ধরিয়া সে এইরূপ একটা কল্পনা করিতেছিল, সে ভাবিতেছিল আজ তাহার চিরবাঞ্ছিত ধরা দিবে, আজ তাহার উচ্ছৃঙ্খল অতৃপ্তি পদতলে লুটাইয়া পড়িবে। তখন সে কি করিবে, কেমন করিয়া আপনার গাম্ভীর্য বজায় রাখিয়া সে সময়ের প্রবল ঝঞ্ঝাবায়ু মাথায় পাতিয়া লইবে, তাহাই স্থির করিয়াছিল। ঋণ পরিশোধ করিয়া লিও যে তাহাকে জন্মের মত পরিত্যাগ করিয়া যাইতে পারে, এ দুরদৃষ্টের এক বিন্দুও তাহার মনে উদয় হয় নাই। লিও তাহার বশ্যতা স্বীকার করিবে, কেননা সবাই করিয়াছে। এতদিন যে করিতেছিল না সে কেবল তাহার মূর্খতার ফল।
মেরি উপায়সিদ্ধির জাল বুনিতেছিল, কিন্তু এতদিন তাহা পারিয়া উঠে নাই,—এক দিক বুনিতে অন্য দিকের সুতা ছিঁড়িয়া যাইতেছিল। কিন্তু এতদিনে দুই দিকে বেশ শক্ত করিয়া বাঁধিয়া চমৎকার জাল তৈয়ার হইয়াছে, এবার শিকার ধরা পড়িবেই।
কতকটা হৃষ্টচিত্তে মেরি নামিয়া আসিল। বসিবার কক্ষে লিও দাঁড়াইয়াছিল। আসিয়াই দেখিল তাহার হাতে একতাড়া নোট রহিয়াছে, মেরি কাঠের মত হইয়া গেল। লিও হাসিয়া হস্তগ্রহণ করিল। মেরি মুখ অবনত করিল। মনে হইল হাত বুঝি বড় উষ্ণ, আর এ হাসি বুঝি উপহার দিবার জন্য কাহারো নিকট চাহিয়া আনিয়াছে।
লিও কহিল,’টাকা নাও। আজ সাত দিনের শেষ দিন।’
মেরি হাত পাতিল। লিও একে একে নোটের তাড়া গুনিয়া দিয়া বলিল, ‘হইয়াছে?’
মেরি পূর্বের মত মাথা নাড়িয়া Bond ফিরাইয়া দিল। একমুহূর্তে তাহার সমুদয় কৌশল, আশা, ভরসা সমস্ত ফাটিয়া গিয়াছে—ভিতরের হৃৎপিণ্ডও ফাটিবার উপক্রম করিতেছে; শরীরের সমস্ত শক্তি একত্রিত করিয়া এ সময়ে সে প্রাণপণে সচেতন রহিল; এ সময়ে অচেতন হইলে চলিবে না।
লিও কহিল, ‘আজ বোধ হয় এই শেষ। শেষ সময়ে তোমাকে দুটো কথা বলিতে চাই, শুনিবে কি?’
মেরি মাথা নাড়িয়া বলিল,’শুনিব।’
‘তবে এ কথাটি রাখিও। কাহাকেও সৎ দেখিয়া শীঘ্র বিবাহ করিও; তোমার অর্থ আছে—অর্থের জন্য ভাবিও না; শুধু সৎ এবং উচ্চ দেখিয়া কাহাকে বিবাহ করিয়া সুখী হইয়ো;—এরূপ ধনসম্পত্তি লইয়া অরক্ষিতা অবস্থায় বেশি দিন থাকিয়ো না।’
মেরি একটিবার মাত্র মুখ তুলিয়া লিওর মুখপানে চাহিয়া অবনত হইল।
লিও কহিল, ‘আর একটি কথা!’ এই সময়ে দুজনেই দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলিল। ‘আর একটি কথা,—মনে রাখিও, লজ্জা যেমন স্ত্রীলোকের ভূষণ, অভিমানও তাই; কিন্তু বাড়াবাড়ি করিলে বড় কুফল ঘটে।’
এ কথা তাহাকে শিখাইতে হইবে না। জগতের মাঝে এ সত্য আজ মেরি অপেক্ষা বোধ হয় কেহই অধিক বুঝে না।
তারপর পাঁচটা বাজিল, ঘাড়ির পানে চাহিয়া লিও বলিল, ‘তবে যাই—আমার সময় হইয়াছে।’
চলিয়া যায় দেখিয়া রুদ্ধকণ্ঠে বহু ক্লেশে মেরি কহিল,—’একটি কথা বলিয়া যাও—’
লিও ফিরিয়া আসিয়া কহিল, ‘কি কথা?’
‘এত টাকা কোথায় পাইলে?’
লিও মৃদু হাসিল। ‘এ কথা কেন জিজ্ঞাসা কর? আমার কোন্ কথা তুমি জান না?’
‘কি জানি? অমন গান গাহিতে জান তাহা কি কখন বলিয়াছিলে?’
লিও এবার যথার্থই হাসিয়া ফেলিল—‘কৈ, তুমি ত কখন জিজ্ঞাসা কর নাই? জিজ্ঞাসা করিলে কত গান শুনাইয়া দিতে পারিতাম, এতদিনে হয়ত তুমিও আমার মত শিখিতে পারিতে।’
মেরি কহিল, ‘সে কথা নয়, টাকা কোথায় পাইলে বল?’
‘কোথায় আর পাইব? পিতা যাহা রাখিয়া গিয়াছিলেন, তাঁহার কার্যে তাহাই ব্যয় করিলাম। বাড়ি, ঘর, ফুলবাগান, আমার একরাশি পুস্তক—যাহা কিছু ছিল প্রায় সমস্তই বিক্রয় করিয়া তাঁহার ঋণ পরিশোধ করিয়াছি।’
মেরি কঠিন দৃষ্টিতে মুখপানে চাহিয়া বলিল—‘বেচিয়াছ?’
‘সব।’
‘থাকিবে কোথায়? খাইবে কি?’
‘আপাততঃ লন্ডনে যাইতেছি—সেখানে কোন কার্য খুঁজিয়া লইব। আশা আছে সমস্ত দিন উপবাস করিতে হইবে না।’
‘লন্ডনে কোথায় থাকিবে?’
‘দিন কতক বোধ হয় হসপিটালে থাকিব, তাহার পর যাহা হয় করিব।’
‘সেখানে কেন?’
‘সেখানে কিছু দিন কাটাইতে হইবে বলিয়া অনুমান করিতেছি। আজ চার দিন হইতে জ্বর হইয়াছে, কিছুতেই সারিতেছে না,—সদ্য লন্ডনে গিয়া যে ভাল থাকব এ আশাও করি না, টাকাকড়িও সঙ্গে অধিক নাই,—সে অবস্থায় কোথায় আর যাইব বল?’
মেরি শিহরিয়া উঠিল। ‘অ্যাঁ—আজ চার দিনের জ্বর সারে নাই?’
‘কৈ আর সারিয়াছে।’
এক দণ্ডে মেরির সমস্ত মুখের ভাব পরিবর্তন হইয়া গেল। কাতরতা, বিষাদ, নিরাশা, লজ্জা, অভিমান সে-মুখে আর কিছুই রহিল না। শুধু বিশ্বব্যাপী প্রবল স্নেহ ও দিগন্তবিস্তৃত বিপুল শঙ্কা! প্রথমে সে হাত দিয়া লিওর কপোল স্পর্শ করিয়া শরীরের উত্তাপ দেখিল,—ভাল বুঝিতে পারিল না। তাহার পর দুই হস্তে লিওর মুখ নিচু করিয়া নিজের কপোল তাহার কপোলে সংলগ্ন করিয়া উত্তাপের স্তর অনুভব করিল; তাহার পর বিনা বাক্যব্যয়ে হাত ধরিয়া টানিয়া লইয়া চলিল। দৃপ্ত চক্ষে অমানুষিক আভা।
লিও সভয়ে বলিল, ‘কোথা যাও?’
‘যেখানে ইচ্ছা; কোন কথা জিজ্ঞাসা করিও না।’
লিও ভাবিল, এ কি!
মেরি বরাবর তাহাকে টানিয়া লইয়া একেবারে উপরে উঠিল, তাহার পর আপনার শয়নকক্ষে প্রবেশ করিল। অট্টালিকার মধ্যে এই কক্ষটিই সর্বাপেক্ষা সুন্দর এবং সজ্জিত। এক পার্শ্বে একটা প্রকাণ্ড দুর্মূল্য পালঙ্ক সজ্জিত ছিল, মেরি তাহার উপর লিওকে টানিয়া লইয়া বসাইয়া দিল। বালিশগুলি একত্র করিয়া বলিল, ‘চুপ করিয়া এখানে শুইয়া থাক—।’