মেরি আগ্রহের সহিত বলিল, ‘বাটী বিক্রয় হইবে?’
‘বোধ হয়।’
‘হয় হউক—উত্তম কথা। আমার টাকা চাই। সাত দিনের মধ্যে—না হয় নালিশ করিও।’
বৃদ্ধ অনেক দেখিয়াছে কিন্তু এমনটি দেখে নাই। বলিল, ‘এত অল্প বয়সে তাহাকে পথের ভিখারী করিবে? কাহাকে দেশত্যাগী করা উচিত কি?’
মেরি চক্ষু রাঙ্গাইল। ‘টাকা তোমার নয়, আমার। আমি তাহাকে পদতলে টানিয়া লইতে চাই।’
শেষ কথাটা বৃদ্ধ ভাল শুনিতে পাইল না, বলিল, ‘কি করিতে চাও?’
‘কিছু না। শুধু টাকা চাই। আজ নোটিশ দাও—ঠিক সাত দিনের দিন।’
দশ
নোটিশ পাইয়া লিওপোল্ডের সমস্ত সংসার অন্ধকার বোধ হইল। সমস্ত রাত্রি চিন্তা করিয়াও সে কূল দেখিতে পাইল না।
প্রাতঃকালে, মেরি আপনার কক্ষে বসিয়া রক্তবর্ণ চক্ষু নত করিয়া কি ভাবিতেছিল, এমন সময় ভৃত্য আসিয়া কহিল, ‘নীচে লিও দাঁড়াইয়া আছে।’
মেরি মুখ তুলিয়া বলিল, ‘কে?’
‘লিও।’
‘দূর করিয়া দাও।’ ভৃত্য ভাবিল মন্দ নয়। সে চলিয়া যাইতেছিল—মেরি তাহাকে ডাকিয়া কহিল—’দাঁড়াও, দূর করিয়া দিও না। সে বড় অভিমানী—অপমান সহিতে পারে না—মিষ্টি কথায় যাইতে বলিও। বলিও, আমি বাড়ি নাই,—দেখিয়ো কিছুতে যেন সে মনে ক্লেশ না পায়, কিছুতে যেন সে বুঝিতে না পারে আমি ইচ্ছাপূর্বক দেখা করিলাম না। বুঝিলে?’
ভৃত্য ঘাড় নাড়িল। সে লিওকে খুব চিনিত;—বাটীর সকলেই চিরকাল তাহাকে সম্মান করিয়াছে; মেরি আজ্ঞা করিলেও কেহ তাহাকে অপমান করিতে পারিত না। সে নীচে চলিয়া গেল।
নিঃশব্দ পদক্ষেপে মেরি ভৃত্যের পশ্চাতে নামিয়া আসিল। ঈষৎ উন্মোচিত দ্বারের অন্তরাল হইতে দেখিল, লিও দাঁড়াইয়া আছে। মুখ বড় শীর্ণ, যেন কিছু পীড়িত। ভৃত্য কহিল ‘তিনি বাটী নাই।’
‘কোথায় গিয়াছেন?’
ভৃত্য বুদ্ধি করিয়া বলিল, ‘কাল রাত্রে লন্ডন গিয়াছেন।’
‘কবে আসিবেন?’
‘জানি না। বোধ হয় কাল।’
নিকটস্থ একটা চেয়ারের উপর লিও বসিয়া পড়িল। শরীর নিতান্ত পরিশ্রান্ত বোধ হইতেছিল।
ভৃত্য তাহা অনুমান করিয়া বলিল, ‘বসুন। আপনাকে বড় ক্লান্ত বোধ হইতেছে। এক গ্লাস বিয়ার আনিয়া দিব কি?’
লিও বলিল, ‘না।’
ভৃত্য ছাড়িল না। বলিল, ‘শরীর অসুস্থ বোধ হইতেছে। বিয়ারে উপকার হইবে।’
লিও অল্প হাসিয়া ধন্যবাদ দিয়া কহিল, ‘আমার দুই দিন হইতে জ্বর হইয়াছে, দুই দিন উপবাসী আছি—তাই এমন বোধ হইতেছে।’
এই সময় কবাট-জোড়াটা খুব দুলিয়া শব্দ করিয়া উঠিল। লিও চাহিয়া দেখিল—’ও কি!’
ভৃত্যও চাহিল—’বোধ হয় বাতাস।’
মেরি পা টিপিয়া দ্রুতপদে পলাইয়া গেল।
এই গ্রামে টমাস হগ বলিয়া একজন মহাজন বাস করিত। লিওপোল্ড বরাবর তাহার নিকট আসিয়া উপস্থিত হইল। ডাকিয়া বলিল, ‘হগ, আমার বাটী বিক্রয় হইবে তুমি কিনিবে?’
হগ বিস্মিত হইয়া বলিল, ‘বাটী বিক্রয় করিবে? কেন?’
‘সে কথা না শুনিলে কিনিবে না?’
‘নিশ্চয় নয়। কিন্তু কত টাকায় বিক্রয় করিবে?’
‘তের হাজার পাউন্ড পাইলেই বিক্রয় করিব।’
‘এত টাকা? কি প্রয়োজন?’
‘বলিতেছি। পিতা Captain Noll-এর নিকট আট হাজার পাউন্ড লইয়া বাটী বন্ধক রাখিয়াছিলেন। সুদে-আসলে তাহা প্রায় চৌদ্দ হাজার হইয়াছে। দুই হাজার পাউন্ড পরিশোধ করিয়াছি—আর বারো হাজার বাকি আছে। তাহাই পরিশোধ করিতে চাই।’
Thomas Hogg মাথায় হাত দিয়া বসিয়া পড়িল। ‘উঃ—তাঁহারা দুজনে বিশেষ বন্ধু ছিলেন, তবুও এত সুদ! আমারাও যে এত লই না!’
লিও উত্তর দিল না। বলিল,’কিনিবে?’
‘কিনিতে পারি, কিন্তু অত টাকা দিতে পারি না। বারো হাজারের বেশি কিছুতেই নয়।’
লিও চিন্তা করিয়া বলিল,’আমার অনেক আসবাব আছে—তা’ ছাড়া এক ঘর পুস্তকও আছে—সমস্ত লইয়াও কি তের হাজার দেওয়া যায় না?
হগ কহিল,’যায়। কিন্তু বাটী বন্ধক আছে—তুমি যে টাকা পরিশোধ করিবে, তাহার প্রমাণ কি?’
লিও হাসিল। ‘আমাদের বংশে কেহ চুরি করে নাই—আমিও চোর নহি। তোমার বিশ্বাস না হয়, আমার সহিত এস, বন্ড তোমার হাতে দিব।’
হগ বিশ্বাস করিল। সমস্ত টাকা গুনিয়া দিয়া বলিল,’কাল রেজেস্ট্রি করিয়া দিও—কিন্তু এক কথা বলি, যদি কখন তোমার টাকা সংগ্রহ হয় আমার নিকট আসিও, তোমার বাটী তোমাকেই ফিরাইয়া দিব।’
সে রাত্রে লিওর পুরাতন ভৃত্য দুইটি বড় বেশি রকম কাঁদিতে লাগিল। আকস্মিক এরূপ সংবাদে তাহাদের মাথায় যেন বজ্রাঘাত হইল। প্রত্যেকে ছয় মাসের করিয়া অধিক বেতন পুরস্কার পাইয়াছে, তথাপি কাঁদিতে ছাড়িল না। আবশ্যকীয় দ্রব্যাদি গুছাইয়া বাঁধা হইল, বাকি যাহা রহিল, হগের লোক তাহা বুঝিয়া লইল। কাল সপ্তদিন পূর্ণ হইবে, পিতৃঋণ পরিশোধ করিয়া লিও কাল জন্মের মত কোরেল গ্রাম ছাড়িয়া যাইবে, চিরপুরাতন ভৃত্যেরা তাই কাঁদিয়া শেষ করিতে পারিতেছে না। লিও তাহাদিগকে সান্ত্বনা দিতেছে—যদি বাঁচিয়া থাকি দুই বৎসরের মধ্যে আবার আমার কাছে আসিতে পাইবে। লিওকে তাহারা বাল্যকাল হইতে সত্যবাদী বলিয়া বিশ্বাস করিত—সেইজন্য কতক শান্ত হইয়াছে।
লিও ভাবিতেছে—জনক-জননীর মুখ, মেরি, তাহার জননী, পুস্তকের রাশি, ফুলের বাগান, তাহার চির সহচর ঐ ক্ষুদ্র পাঠাগার—আর ভাবিতেছে মেরি তাহাকে গৃহত্যাগী করিয়াছে।
দুশ্চিন্তা ও নানা কারণে সে রাত্রে তাহার প্রবল জ্বর বোধ হইল। সমস্ত রাত্রি একরূপ অচৈতন্য অবস্থায় কাটিল—দ্বিপ্রহরের পর জ্বরত্যাগ হইল, কিন্তু শরীর নিতান্ত দুর্বল। সামান্য জিনিসপত্র যাহা সাথে লইয়াছিল তাহা স্টেশনে পাঠাইয়া দিয়া নোটের তাড়া হাতে লইয়া মেরির গৃহে উপস্থিত হইল।