বাজিকরের বাজি দেখিবার জন্য সন্ধ্যার পূর্ব হইতেই আনেকে ধীরে ধীরে জমা হইতেছে। যাহার শরীর অসুস্থ সেও রীতিমত গরম কাপড়ে আপাদমস্তক মুড়ি দিয়া সন্ধ্যার মধ্যেই উপযুক্ত স্থান দখল করিয়া বসিয়াছে। কথা ছিল সাতটার গাড়িতে বাজিকর আসিবে এবং অর্ধ ঘণ্টার মধ্যেই তাহার বিদ্যা হস্তকৌশল ইত্যাদি পরিদর্শন করাইবে; তাহার পর দশটার সময় ভোজনাদি হইবে। সাড়ে-সাতটার জন্য সকলেই উৎসুক হইয়া ছিল, কিন্তু সাতটার সময় একটা অসম্ভব ঘটনা ঘটিল। বাজিকরের পরিবর্তে একখানা টেলিগ্রাফ আসিয়া উপস্থিত হইল। ‘জাদুকর হঠাৎ বড় পীড়িত হইয়াছে—আসিতে পারিবে না।’ সঙ্গে সঙ্গে মেরির মাথাটা ঘুরিয়া গেল। এখন উপায়? দক্ষিণ হস্তে চার্লসের হস্তে কাগজখানা দিয়া বলিল, ‘যাহা হয় কর। কেহ আমার কথা জিজ্ঞাসা করিলে বলিও, সহসা পীড়িত হইয়া শয্যা আশ্রয় করিয়াছি।’
টেলিগ্রাফ পড়িয়া চার্লসও বিষম অভিভূত হইল; সেও কহিল, ‘উপায়? সাতটা হইতে দশটা পর্যন্ত কাটে কিরূপে?’
আপাততঃ এ কথা চাপা রহিল। ক্রমশঃ লোকে হল্ পূর্ণ হইয়া গেল। আগ্রহ এবং উৎকণ্ঠা সকলের মুখে; ক্রমে যত সময় যাইতে লাগিল, তত সকলে ব্যস্ত হইতে লাগিল। যাহারা কিছু অসুস্থ ছিল, তাহারা গৃহে প্রত্যাগমনের উপায় খুঁজিতে লাগিল। সর্বত্রই একটা অস্ফুট চাপা কলরব হইতে লাগিল, ভাবগতিক দেখিয়া মেরির নিজের কেশ উৎপাটন করিবার ইচ্ছা হইল। ক্রমশঃ কথাটা জানাজানি হইল—তখন হতাশ হইয়া কেহ বা সংগীতের কথা উত্থাপন করিল, কোন বৃদ্ধ বা তাহার সঙ্গিনীকে হুইস্ট টেবিলের দিকে টানিয়া লইয়া গেল, কোন যুবক তাহার বন্ধুর হাত ধরিয়া ধীরে ধীরে বিলিয়ার্ড হলের দিকে চলিল,—এইরূপে সাতটা হইতে দশটা পর্যন্ত কেমন করিয়া কাটান যাইতে পারে তাহা সবাই ভাবিতে বসিল। সকলকে অন্য কোন উপায়ে নিযুক্ত রাখিবার কোনরূপ আয়োজন করিয়া রাখা হয় নাই বলিয়া মেরি মৃদুকণ্ঠে চার্লসকে অনুযোগ করিল, কিন্তু উপায় কেহই উদ্ভাবন করিতে সমর্থ হইল না।
আপাদমস্তক আলস্টরে আবৃত করিয়া আজ লিওপোল্ড আসিয়াছিল, হলের এক কোণে একটা সোফায় বসিয়া নিকটস্থ একজন যুবতীর সহিত বাক্যালাপ করিতেছিল। জিজ্ঞাসা করিল, ‘জাদুকর আসিল না কেন?’
যুবতী কহিল, ‘তাহার সহসা পীড়া হইয়াছে।’
‘তাহা হইলে?’
‘তাহা হইলে আর কি? দশটা পর্যন্ত যাহার যাহা খুশি করুক। মেরির অবস্থা বড় শোচনীয় হইয়াছে—সে অতিশয় লজ্জিত হইয়া পড়িয়াছে।’
লিও একটু ভাবিয়া বলিল, ‘আমি গাহিতে জানি। বোধ হয় নিতান্ত মন্দ শুনাইবে না,—কি বল?’
রমণীটি অতিশয় সংগীতপ্রিয়। সে একেবারে লিওর হাত ধরিয়া পিয়ানোর নিকট টানিয়া আনিয়া বসাইয়া দিল। স্বহস্তে ডালা খুলিয়া দিয়া বলিল, ‘বাজাও।’
পিয়ানো ডাকিয়া উঠিল—’ঝম ঝম ঝম!’
অনেকেই এখনো এদিকে চাহে নাই, পিয়ানোর শব্দে তাহারা ফিরিয়া চাহিল। ঝঙ্কারে ঝঙ্কারে তখন মর্তের পিয়ানো স্বর্গের সংগীত বলিতেছিল। যাহারা বুঝিত, তাহারা বুঝিল এরূপ অলৌকিক ক্ষিপ্রহস্ত, এরূপ পারদর্শী অসামান্য শিক্ষিত অঙ্গুলি বোধ হয় ইতিপূর্বে কখনও এ পিয়ানো স্পর্শ করে নাই। পার্শ্বের কামরায় যাহারা তাস লইয়া বসিয়াছিল তাহারা ক্রীড়া স্থগিত করিল; বিলিয়ার্ড হলের দিকে যাহারা পদচালনা করিয়াছিল, তাহারা আপাততঃ দাঁড়াইয়া পড়িল। সকলেই পরস্পরের মুখ চাহিয়া জিজ্ঞাসা করিল ‘কে?’
কেহই লিওকে ভাল করিয়া দেখে নাই, তাই কেহই চিনিতে পারিল না। যে চিনিত সে কথা কহিল না। তাহার পর, পিয়ানো যাহা অস্ফুট বলিতেছিল, কণ্ঠ তাহা স্পষ্টতম করিল। সে কণ্ঠের তুলনা হয় না। অশীতিপর বৃদ্ধও মনে করিল, তাহার জীবনে এরূপ কণ্ঠস্বর শুনে নাই। ধর্মপরায়ণা বৃদ্ধা মনে করিল জগতের শেষ দিনটিতে বুঝি দেবতাগণ এইরূপ সংগীত করিবেন। লহরে লহরে সে স্বর কক্ষ ভরিয়া আকাশে উঠিতে লাগিল; ঘূর্ণবায়ু যেমন রাস্তার ধূলা, কুটা, তৃণ, কঙ্কর সমস্তই একসাথে ঘুরাইয়া লইয়া আকাশে উঠে, এ স্বরও তেমনি বালক, যুবক, প্রৌঢ়, বৃদ্ধ প্রভৃতি সকলের মন একসাথে উপরে উড়াইয়া চলিল। এরূপ মুগ্ধ করিতে জাদুকর বোধ হয় পারিত না। নিস্পন্দ নীরব—কাহারো মুখে কথা নাই, অনেকের শরীরে চৈতন্যের লক্ষণটুকু পর্যন্ত নাই। ঠিক কোন্ সময়ে গীতটি শেষ হইল, অনেকেই তাহা বুঝিতে পারিল না, তাহার পর পিয়ানো যখন ঝম ঝম ঝম করিয়া তাহার শেষ ঝঙ্কারটুকু মুগ্ধ আকাশের তরঙ্গশ্রেণীর শেষ গতিটুকু বিতরণ করিয়া স্তব্ধ হইল, তখন সেই আহূত জনমণ্ডলী নিতান্ত উচ্ছৃঙ্খলভাবে একেবারে পিয়ানোর চতুষ্পার্শ্বে ঘিরিয়া দাঁড়াইল, প্রত্যেকে প্রত্যেকের মুখপানে চাহিয়া জিজ্ঞাসা করিল, ‘কে?’ কেহ উত্তর দিতে পারিল না।
লিও নিজের মুখ নিচু করিয়া রাখিয়াছিল। আবার পিয়ানো ঝম ঝম করিয়া উঠিল, নিমেষে মুগ্ধ, বিস্মিত জনমণ্ডলী সরিয়া গেল,—যে যেখানে পাইল স্তব্ধ হইয়া বসিয়া পড়িল, শুনিল নির্জীব পিয়ানো সজীব হইয়া কত কি কথা বলিয়া যাইতেছে, পুনর্বার কণ্ঠস্বর তাহা স্পষ্টতর করিয়া দিল। লিও বিরহের গান গাহিতেছিল;—কোন্ সুদূর সমুদ্রকূলে বসিয়া পরিত্যক্ত রাজকন্যা তাহার প্রণয়ীর জন্য সমুদ্রকে ডাকিয়া বলিতেছে, ‘ওগো সমুদ্র আমার স্বামীকে ফিরাইয়া দাও;—ফিরাইয়া দাও;—কোন্ অতলগর্ভে তাহাকে নিমজ্জিত করিয়া লুকাইয়া রাখিয়াছে; হায়, দয়া করিয়া ফিরাইয়া দাও, না হইলে আমাকেও তোমার একটি তরঙ্গ পাঠাইয়া টানিয়া লও। এ দুঃসহ জীবনের ভার আর বহিতে পারি না।’ গানের ভাবটা এইরূপ। শ্রোতৃবর্গের মধ্যে কাহার কিভাবে কাটিতেছিল তাহা পূর্বে বলিয়াছি, কিন্তু মেরির কথা বলি নাই। সে এতক্ষণ একটা কোচের বাজুতে মাথা রাখিয়া আকুলভাবে কাঁদিতেছিল। তাহার মনে হইতেছিল—বুঝি তাহার সমস্ত হৃদয়খানা সঙ্গীত হইয়া কাঁদিয়া ফিরিতেছে;—সমুদ্র কি, তাহা সে জানে না, শুধু আকুল মর্মভেদী ক্রন্দনে দয়া ভিক্ষা চাহিতেছে—সে আমার হারাইয়া গিয়াছে—ওগো, ফিরাইয়া দাও!—ফিরাইয়া দাও!