ডাকিছ কে তুমি তাপিত জনে তাপহরণ স্নেহকোলে
ডাকিছ কে তুমি তাপিত জনে তাপহরণ স্নেহকোলে ॥
নয়নসলিলে ফুটেছে হাসি,
ডাক শুনে সবে ছুটে চলে তাপহরণ স্নেহকোলে ॥
ফিরিছে যারা পথে পথে, ভিক্ষা মাগিছে দ্বারে দ্বারে
শুনেছে তাহারা তব করুণা–
দুখীজনে তুমি নেবে তুলে তাপহরণ স্নেহকোলে ॥
ডাকিছ শুনি জাগিনু প্রভু
ডাকিছ শুনি জাগিনু প্রভু, আসিনু তার পাশে।
আঁখি ফুটিল, চাহি উঠিল চরণদরশ-আশে ॥
খুলিল দ্বার, তিমিরভার দূর হইল ত্রাসে।
হেরিল পথ বিশ্বজগত, ধাইল নিজ বাসে ॥
বিমলকিরণ প্রেম-আঁখি সুন্দর পরকাশে–
নিখিল তায় অভয় পায়, সকল জগত হাসে ॥
কানন সব ফুল্ল আজি, সৌরভ তব ভাসে–
মুগ্ধ হৃদয় মত্ত মধুপ প্রেমকুসুমবাসে ॥
উজ্জ্বল যত ভকতহৃদয়, মোহতিমির নাশে।
দাও, নাথ, প্রেম-অমৃত বঞ্চিত তব দাসে ॥
ডাকিল মোরে জাগার সাথি
ডাকিল মোরে জাগার সাথি।
প্রাণের মাঝে বিভাস বাজে, প্রভাত হল আঁধার রাতি॥
বাজায় বাঁশি তন্দ্রা-ভাঙা, ছড়ায় তারি বসন রাঙা–
ফুলের বাসে এই বাতাসে কী মায়াখানি দিয়েছে গাঁথি॥
গোপনতম অন্তরে কী লেখনরেখা দিয়েছে লেখি !
মন তো তারি নাম জানে না, রূপ আজিও নয় যে চেনা,
বেদনা মম বিছায়ে দিয়ে রেখেছি তারি আসন পাতি॥
ডাকে বার বার ডাকে
ডাকে বার বার ডাকে,
শোনো রে, দুয়ারে দুয়ারে আঁধারে আলোকে ॥
কত সুখদুঃখশোকে কত মরণে জীবনলোকে
ডাকে বজ্রভয়ঙ্কর রবে,
সুধাসঙ্গীতে ডাকে দ্যুলোকে ভূলোকে ॥
ডাকো মোরে আজি এ নিশীথে
ডাকো মোরে আজি এ নিশীথে
নিদ্রামগন যবে বিশ্বজগত,
হৃদয়ে আসিয়ে নীরবে ডাকো হে
তোমারি অমৃতে ॥
জ্বালো তব দীপ এ অন্তরতিমিরে,
বার বার ডাকো মম অচেত চিতে ॥
ডুবি অমৃতপাথারে– যাই ভুলে চরাচর
ডুবি অমৃতপাথারে– যাই ভুলে চরাচর,
মিলায় রবি শশী ॥
নাহি দেশ, নাহি কাল, নাহি হেরি সীমা–
প্রেমমুরতি হৃদয়ে জাগে,
আনন্দ নাহি ধরে ॥
তব সিংহাসনের আসন হতে এলে তুমি নেমে
তব সিংহাসনের আসন হতে এলে তুমি নেমে–
মোর বিজন ঘরের দ্বারের কাছে দাঁড়ালে নাথ, থেমে॥
একলা বসে আপন-মনে গাইতেছিলেম গান;
তোমার কানে গেল সে সুর, এলে তুমি নেমে,
মোর বিজন ঘরের দ্বারের কাছে দাঁড়ালে নাথ, থেমে॥
তোমার সভায় কত-না গান, কতই আছেন গুণী–
গুণহীনের গানখানি আজ বাজল তোমার প্রেমে!
লাগল সকল তানের মাঝে একটি করুণ সুর,
হাতে লয়ে বরণমালা এলে তুমি নেমে–
মোর বিজন ঘরের দ্বারের কাছে দাঁড়ালে নাথ, থেমে॥
তব অমল পরশরস, তব শীতল শান্ত পুণ্যকর অন্তরে দাও
তব অমল পরশরস, তব শীতল শান্ত পুণ্যকর অন্তরে দাও।
তব উজ্জ্বল জ্যোতি বিকাশি হৃদয়মাঝে মম চাও ॥
তব মধুময় প্রেমরসসুন্দরসুগন্ধে জীবন ছাও।
জ্ঞান ধ্যান তব, ভক্তি-অমৃত তব, শ্রী আনন্দ জাগাও ॥
তাঁহারে আরতি করে চন্দ্র তপন, দেব মানব বন্দে চরণ
তাঁহারে আরতি করে চন্দ্র তপন, দেব মানব বন্দে চরণ–
আসীন সেই বিশ্বশরণ তাঁর জগতমন্দিরে ॥
অনাদিকাল অনন্তগগন সেই অসীম-মহিমা-মগন–
তাহে তরঙ্গ উঠে সঘন আনন্দ-নন্দ-নন্দ রে ॥
হাতে লয়ে ছয় ঋতুর ডালিপায়ে দেয় ধরা কুসুম ঢালি–
কতই বরণ, কতই গন্ধ কত গীত কত ছন্দ রে ॥
বিহগগীত গগন ছায়– জলদ গায়, জলধি গায়–
মহাপবন হরষে ধায়, গাহে গিরিকন্দরে।
কত কত শত ভকত প্রাণ হেরিছে পুলকে, গাহিছে গান–
পুণ্য কিরণে ফুটিছে প্রেম, টুটিছে মোহবন্ধ রে ॥
তাই তোমার আনন্দ আমার ‘পর
তাই তোমার আনন্দ আমার ‘পর
তুমি তাই এসেছ নীচে।
আমায় নইলে ত্রিভুবনেশ্বর,
তোমার প্রেম হত যে মিছে।
আমায় নিয়ে মেলেছ এই মেলা,
আমার হিয়ায় চলছে রসের খেলা,
মোর জীবনে বিচিত্ররূপ ধরে
তোমার ইচ্ছা তরঙ্গিছে॥
তাই তো তুমি রাজার রাজা হয়ে
তব আমার হৃদয় লাগি
ফিরছ কত মনোহরণ-বেশে
প্রভু, নিত্য আছ জাগি।
তাই তো, প্রভু, হেথায় এল নেমে,
তোমারি প্রেম ভক্তপ্রাণের প্রেমে,
মূর্তি তোমার যুগল-সম্মিলনে সেথায় পূর্ণ প্রকাশিছে॥
তার অন্ত নাই গো যে আনন্দে গড়া আমার অঙ্গ
তার অন্ত নাই গো যে আনন্দে গড়া আমার অঙ্গ।
তার অণু-পরমাণু পেল কত আলোর সঙ্গ,
ও তার অন্ত নাই গো নাই।
তারে মোহনযন্ত্র দিয়ে গেছে কত ফুলের গন্ধ,
তারে দোলা দিয়ে দুলিয়ে গেছে কত ঢেউয়ের ছন্দ,
ও তার অন্ত নাই গো নাই।
আছে কত সুরের সোহাগ যে তার স্তরে স্তরে লগ্ন,
সে যে কত রঙের রসধারায় কতই হল মগ্ন,
ও তার অন্ত নাই গো নাই।
কত শুকতারা যে স্বপ্নে তাহার রেখে গেছে স্পর্শ,
কত বসন্ত যে ঢেলেছে তায় অকারণের হর্ষ,
ও তার অন্ত নাই গো নাই।
সে যে প্রাণ পেয়েছে পান করে যুগ-যুগান্তরের স্তন্য–
ভুবন কত তীর্থজলের ধারায় করেছে তায় ধন্য,
ও তার অন্ত নাই গো নাই।
সে যে সঙ্গিনী মোর, আমারে সে দিয়েছে বরমাল্য।
আমি ধন্য, সে মোর অঙ্গনে যে কত প্রদীপ জ্বালল–
ও তার অন্ত নাই গো নাই ॥
তিমিরদুয়ার খোলো– এসো, এসো নীরবচরণে
তিমিরদুয়ার খোলো– এসো, এসো নীরবচরণে।
জননী আমার, দাঁড়াও এই নবীন অরুণকিরণে ॥
পুণ্যপরশপুলকে সব আলস যাক দূরে।
গগনে বাজুক বীণা জগত-জাগানো সুরে।
জননী, জীবন জুড়াও তব প্রসাদসুধাসমীরণে।
জননী আমার, দাঁড়াও মম জ্যোতিবিভাসিত নয়নে ॥