বিধির বাঁধন কাটবে তুমি
বিধির বাঁধন কাটবে তুমি এমন শক্তিমান—
তুমি কি এমন শক্তিমান!
আমাদের ভাঙাগড়া তোমার হাতে এমন অভিমান—
তোমাদের এমনি অভিমান॥
চিরদিন টানবে পিছে, চিরদিন রাখবে নীচে—
এত বল নাই রে তোমার, সবে না সেই টান॥
শাসনে যতই ঘেরো আছে বল দুর্বলেরও,
হও-না যতই বড়ো আছেন ভগবান।
আমাদের শক্তি মেরে তোরাও বাঁচবি নে রে,
বোঝা তোর ভারী হলেই ডুববে তরীখান।
স্বরবিতান ৪৬
বুক বেঁধে তুই দাঁড়া দেখি
বুক বেঁধে তুই দাঁড়া দেখি, বারে বারে হেলিস নে ভাই!
শুধু তুই ভেবে ভেবেই হাতের লক্ষ্ণী ঠেলিস নে ভাই॥
একটা কিছু করে নে ঠিক, ভেসে ফেরা মরার অধিক—
বারেক এ দিক বারেক ও দিক, এ খেলা আর খেলিস নে ভাই॥
মেলে কিনা মেলে রতন করতে তবু হবে যতন—
না যদি হয় মনের মতন চোখের জলটা ফেলিস নে ভাই!
ভাসাতে হয় ভাসা ভেলা, করিস নে আর হেলাফেলা—
পেরিয়ে যখন যাবে বেলা তখন আঁখি মেলিস নে ভাই॥
স্বরবিতান ৪৬
ব্যর্থ প্রাণের আবর্জনা
ব্যর্থ প্রাণের আবর্জনা পুড়িয়ে ফেলে আগুন জ্বালো।
একলা রাতের অন্ধকারে আমি চাই পথের আলো॥
দুন্দুভিতে হল রে কার আঘাত শুরু,
বুকের মধ্যে উঠল বেজে গুরুগুরু—
পালায় ছুটে সুপ্তিরাতের স্বপ্নে-দেখা মন্দ ভালো॥
নিরুদ্দেশের পথিক আমায় ডাক দিলে কি—
দেখতে তোমায় না যদি পাই নাই-বা দেখি।
ভিতর থেকে ঘুচিয়ে দিলে চাওয়া পাওয়া,
ভাব্নাতে মোর লাগিয়ে দিলে ঝড়ের হাওয়া
বজ্রশিখায় এক পলকে মিলিয়ে দিলে সাদা কালো॥
স্বরবিতান ৫৬
মা কি তুই পরের দ্বারে
মা কি তুই পরের দ্বারে পাঠাবি তোর ঘরের ছেলে?
তারা যে করে হেলা, মারে ঢেলা, ভিক্ষাঝুলি দেখতে পেলে॥
করেছি মাথা নিচু, চলেছি যাহার পিছু
যদি বা দেয় সে কিছু অবহেলে—
তবু কি এমনি করে ফিরব ওরে আপন মায়ের প্রসাদ ফেলে?।
কিছু মোর নেই ক্ষমতা সে যে ঘোর মিথ্যে কথা,
এখনো হয় নি মরণ শক্তিশেলে—
আমাদের আপন শক্তি আপন ভক্তি চরণে তোর দেব মেলে॥
নেব গো মেগে-পেতে যা আছে তোর ঘরেতে,
দে গো তোর আঁচল পেতে চিরকেলে—
আমাদের সেইখেনে মান, সেইখেনে প্রাণ, সেইখেনে দিই হৃদয় ঢেলে॥
স্বরবিতান ৪৬
মাতৃমন্দির-পুণ্য-অঙ্গন কর
মাতৃমন্দির-পুণ্য-অঙ্গন কর’ মহোজ্জ্বল আজ হে
বর -পুত্রসঙ্ঘ বিরাজ’ হে।
শুভ শঙ্খ বাজহ বাজ’ হে।
ঘন তিমিররাত্রির চির প্রতীক্ষা
পূর্ণ কর’, লহ’ জ্যোতিদীক্ষা,
যাত্রীদল সব সাজ’ হে।
শুভ শঙ্খ বাজহ বাজ’ হে।
বল জয় নরোত্তম, পুরুষসত্তম,
জয় তপস্বিরাজ হে।
জয় হে, জয় হে, জয় হে, জয় হে।
এস’ বজ্রমহাসনে মাতৃ-আশীর্ভাষণে,
সকল সাধক এস’ হে, ধন্য কর’ এ দেশ হে।
সকল যোগী, সকল ত্যাগী, এস’ দুঃসহদুঃখভাগী—
এস’ দুর্জয়শক্তিসম্পদ মুক্তবন্ধ সমাজ হে।
এস’ জ্ঞানী, এস’ কর্মী নাশ’ ভারতলাজ হে।
এস’ মঙ্গল, এস’ গৌরব,
এস’ অক্ষয়পুণ্যসৌরভ,
এস’ তেজঃসূর্য উজ্জ্বল কীর্তি-অম্বর মাঝ হে
বীরধর্মে পুণ্যকর্মে বিশ্বহৃদয় রাজ’ হে।
শুভ শঙ্খ বাজহ বাজ’ হে।
জয় জয় নরোত্তম, পুরুষসত্তম,
জয় তপস্বিরাজ হে।
জয় হে, জয় হে, জয় হে, জয় হে॥
গীতপঞ্চাশিকা । স্বরবিতান ৪৭
যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে
যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে।
একলা চলো, একলা চলো, একলা চলো, একলা চলো রে॥
যদি কেউ কথা না কয়, ওরে ওরে ও অভাগা,
যদি সবাই থাকে মুখ ফিরায়ে সবাই করে ভয়—
তবে পরান খুলে
ও তুই মুখ ফুটে তোর মনের কথা একলা বলো রে॥
যদি সবাই ফিরে যায়, ওরে ওরে ও অভাগা,
যদি গহন পথে যাবার কালে কেউ ফিরে না চায়—
তবে পথের কাঁটা
ও তুই রক্তমাখা চরণতলে একলা দলো রে॥
যদি আলো না ধরে, ওরে ওরে ও অভাগা,
যদি ঝড়-বাদলে আঁধার রাতে দুয়ার দেয় ঘরে—
তবে বজ্রানলে
আপন বুকের পাঁজর জ্বালিয়ে নিয়ে একলা জ্বলো রে॥
যদি তোর ভাবনা থাকে
যদি তোর ভাবনা থাকে ফিরে যা-না। তবে তুই ফিরে যা-না।
যদি তোর ভয় থাকে তো করি মানা॥
যদি তোর ঘুম জড়িয়ে থাকে গায়ে ভুলবি যে পথ পায়ে পায়ে,
যদি তোর হাত কাঁপে তো নিবিয়ে আলো সবারে করবি কানা॥
যদি তোর ছাড়তে কিছু না চাহে মন করিস ভারী বোঝা আপন—
তবে তুই সইতে কভু পারবি নে রে এ বিষম পথের টানা॥
যদি তোর আপনা হতে অকারণে সুখ সদা না জাগে মনে
তবে তুই তর্ক ক’রে সকল কথা করিবি নানাখানা॥
স্বরবিতান ৪৬
যে তোমায় ছাড়ে ছাড়ুক
যে তোমায় ছাড়ে ছাড়ুক, আমি তোমায় ছাড়ব না মা!
আমি তোমার চরণ—
মা গো, আমি তোমার চরণ করব শরণ, আর কারো ধার ধারব না মা॥
কে বলে তোর দরিদ্র ঘর, হৃদয় তোর রতনরাশি—
আমি জানি গো তার মূল্য জানি, পরের আদর কাড়ব না মা॥
মানের আশে দেশবিদেশে যে মরে সে মরুক ঘুরে—
তোমার ছেঁড়া কাঁথা আছে পাতা, ভুলতে সে যে পারব না মা!।
ধনে মানে লোকের টানে ভুলিয়ে নিতে চায় যে আমায়—
ও মা, ভয় যে জাগে শিয়র-বাগে, কারো কাছেই হারব না মা॥
স্বরবিতান ৪৬
যে তোরে পাগল বলে
যে তোরে পাগল বলে তারে তুই বলিস নে কিছু॥
আজকে তোরে কেমন ভেবে অঙ্গে যে তোর ধুলো দেবে
কাল সে প্রাতে মালা হাতে আসবে রে তোর পিছু-পিছু॥
আজকে আপন মানের ভরে থাক্ সে বসে গদির’পরে—
কালকে প্রেমে আসবে নেমে, করবে সে তার মাথা নিচু॥
স্বরবিতান ৪৬