ও আমার দেশের মাটি
ও আমার দেশের মাটি, তোমার ‘পরে ঠেকাই মাথা।
তোমাতে বিশ্বময়ীর, তোমাতে বিশ্বমায়ের আঁচল পাতা॥
তুমি মিশেছ মোর দেহের সনে,
তুমি মিলেছ মোর প্রাণে মনে,
তোমার ঐ শ্যামলবরন কোমল মূর্তি মর্মে গাঁথা॥
ওগো মা, তোমার কোলে জনম আমার, মরণ তোমার বুকে।
তোমার ‘পরে খেলা আমার দুঃখে সুখে।
তুমি অন্ন মুখে তুলে দিলে,
তুমি শীতল জলে জুড়াইলে,
তুমি যে সকল-সহা সকল-বহা মাতার মাতা॥
ও মা, অনেক তোমার খেয়েছি গো, অনেক নিয়েছি মা—
তবু জানি নে-যে কী বা তোমায় দিয়েছি মা!
আমার জনম গেল বৃথা কাজে,
আমি কাটানু দিন ঘরের মাঝে—
তুমি বৃথা আমায় শক্তি দিলে শক্তিদাতা॥
ওদের বাঁধন যতই শক্ত হবে
ওদের বাঁধন যতই শক্ত হবে ততই বাঁধন টুটবে,
মোদের ততই বাঁধন টুটবে।
ওদের যতই আঁখি রক্ত হবে মোদের আঁখি ফুটবে,
ততই মোদের আঁখি ফুটবে॥
আজকে যে তোর কাজ করা চাই, স্বপ্ন দেখার সময় তো নাই—
এখন ওরা যতই গর্জাবে, ভাই তন্দ্রা ততই ছুটবে,
মোদের তন্দ্রা ততই ছুটবে॥
ওরা ভাঙতে যতই চাবে জোরে গড়বে ততই দ্বিগুণ করে,
তোরা ভরসা না ছাড়িস কভু, জেগে আছেন জগত্-প্রভু—
ওরা ধর্ম যতই দলবে ততই ধুলায় ধ্বজা লুটবে,
ওদের ধুলায় ধ্বজা লুটবে॥
স্বরবিতান ৪৬
ওরে, তোরা নেই বা কথা বললি
ওরে, তোরা নেই বা কথা বললি,
দাঁড়িয়ে হাটের মধ্যিখানে নেই জাগালি পল্লী॥
মরিস মিথ্যে ব’কে ঝ’কে, দেখে কেবল হাসে লোকে,
নাহয় নিয়ে আপন মনের আগুন মনে মনেই জ্বললি॥
অন্তরে তোর আছে কী যে নেই রটালি নিজে নিজে,
নাহয় বাদ্যগুলো বন্ধ রেখে চুপেচাপেই চললি॥
কাজ থাকে তো কর্ গে না কাজ, লাজ থাকে তো ঘুচা গে লাজ,
ওরে, কে যে তোরে কী বলেছে নেই বা তাতে টললি॥
স্বরবিতান ৪৬
ওরে, নূতন যুগের ভোরে
ওরে, নূতন যুগের ভোরে
দিস নে সময় কাটিয়ে বৃথা সময় বিচার করে॥
কী রবে আর কী রবে না, কী হবে আর কী হবে না
ওরে হিসাবি,
এ সংশয়ের মাঝে কি তোর ভাবনা মিশাবি?।
যেমন করে ঝর্না নামে দুর্গম পর্বতে
নির্ভাবনায় ঝাঁপ দিয়ে পড় অজাজিতের পথে।
জাগবে ততই শক্তি যতই হানবে তোরে মানা,
অজানাকে বশ ক’রে তুই করবি আপন জানা।
চলায় চলায় বাজবে জয়ের ভেরী—
পায়ের বেগেই পথ কেটে যায়, করিস নে আর দেরি॥
ভারততীর্থ। স্বরবিতান ৪৭
খ্যাপা তুই আছিস আপন খেয়াল ধরে।
খ্যাপা তুই আছিস আপন খেয়াল ধরে।
যে আসে তোরই পাশে, সবাই হাসে দেখে তোরে॥
জগতে যে যার আছে আপন কাজে দিবানিশি।
তারা পায় না বুঝে তুই কী খুঁজে ক্ষেপে-বেড়াস জনম ভ’রে॥
তোর নাই অবসর, নাইকো দোসর ভবের মাঝে।
তোরে চিনতে যে চাই, সময় না পাই নানান কাজে।
ওরে, তুই কী শুনাতে এত প্রাতে মরিস ডেকে?
এ যে বিষম জ্বালা ঝালাপালা, দিবি সবায় পাগল করে।
ওরে, তুই কী এনেছিস, কী টেনেছিস ভাবের জালে?
তার কি মূল্য আছে কারো কাছে কোনো কালে?।
আমরা লাভের কাজে হাটের মাঝে ডাকি তোরে!
তুই কি সৃষ্টিছাড়া, নাইকো সাড়া, রয়েছিস কোন্ নেশায় ঘোরে?
এ জগত্ আপন মতে আপন পথে চলে যাবে—
বসে তুই আর-এক কোণে নিজের মনে নিজের ভাবে॥
ওরে ভাই, ভাবের সাথে ভবের মিলন হবে কবে—
মিছে তুই তারি লাগি আছিস জাগি না জানি কোন্ আশার জোরে॥
স্বরবিতান ৫১
ঘরে মুখ মলিন দেখে গলিস নে
ঘরে মুখ মলিন দেখে গলিস নে— ওরে ভাই,
বাইরে মুখ আঁধার দেখে টলিস নে— ওরে ভাই॥
যা তোমার আছে মনে সাধো তাই পরানপণে,
শুধু তাই দশজনারে বলিস নে— ওরে ভাই॥
একই পথ আছে ওরে, চলো সেই রাস্তা ধরে,
যে আসে তারই পিছে চলিস নে— ওরে ভাই!
থাক্-না আপন কাজে, যা খুশি বলুক-না যে,
তা নিয়ে গায়ের জ্বালায় জ্বলিস নে— ওরে ভাই॥
বাউল সুর
চলো যাই, চলো, যাই চলো
চলো যাই, চলো, যাই চলো, যাই—
চলো পদে পদে সত্যের ছন্দে
চলো দুর্জয় প্রাণের আনন্দে!
চলো মুক্তিপথে,
চলো বিঘ্নবিপদজয়ী মনোরথে
করো ছিন্ন, করো ছিন্ন, করো ছিন্ন—
স্বপ্নকুহক করো ছিন্ন।
থেকো না জড়িত অবরুদ্ধ
জড়তার জর্জর বন্ধে।
বলো জয় বলো, জয় বলো, জয়—
মুক্তির জয় বলো ভাই॥
চলো দুর্গমদূরপথযাত্রী চলো দিবারাত্রি,
করো জয়যাত্রা,
চলো বহি নির্ভয় বীর্যের বার্তা,
বলো জয় বলো, জয় বলো, জয়—
সত্যের জয় বলো ভাই॥
দুর করো সংশয়শঙ্কার ভার,
যাও চলি তিমিরদিগন্তের পার।
কেন যায় দিন হায় দুশ্চিন্তার দ্বন্দ্বে—
চলো দুর্জয় প্রাণের আনন্দে।
চলো জ্যোতির্লোকে জাগ্রত চোখে—
বলো জয় বলো, জয় বলো, জয়—
বলো নির্মল জ্যোতির জয় বলো ভাই॥
হও মৃত্যুতোরণ উত্তীর্ণ,
যাক, যাক ভেঙে যাক যাহা জীর্ণ।
চলো অভয় অমৃতময় লোকে, অজর অশোকে,
বলো জয় বলো, জয় বলো, জয়—
অমৃতের জয় বলো ভাই॥
স্বরবিতান ৪৭
ছি ছি, চোখের জলে ভেজাস নে
ছি ছি, চোখের জলে ভেজাস নে আর মাটি।
এবার কঠিন হয়ে থাক্-না ওরে, বক্ষোদুয়ার আঁটি—
জোরে বক্ষোদুয়ার আঁটি॥
পরানটাকে গলিয়ে ফেলে দিস নে, রে ভাই, পথে ঢেলে
মিথ্যে অকাজে—
ওরে নিয়ে তারে চলবি পারে কতই বাধা কাটি,
পথের কতই বাধা কাটি॥
দেখলে ও তোর জলের ধারা ঘরে পরে হাসবে যারা
তারা চার দিকে—
তাদের দ্বারেই গিয়ে কান্না জুড়িস, যায় না কি বুক ফাটি,
লাজে যায় না কি বুক ফাটি?।
দিনের বেলা জগত্-মাঝে সবাই যখন চলছে কাজে আপন গরবে—
তোরা পথের ধারে ব্যথা নিয়ে করিস ঘাঁটাঘাঁটি—
কেবল করিস ঘাঁটাঘাঁটি॥
স্বরবিতান ৪৬