ও আষাঢ়ের পূর্ণিমা আমার
ও আষাঢ়ের পূর্ণিমা আমার, আজি রইলে আড়ালে–
স্বপনের আবরণে লুকিয়ে দাঁড়ালে॥
আপনারই মনে জানি না একেলা হৃদয়-আঙিনায় করিছ কী খেলা–
তুমি আপনায় খুঁজিয়া ফেরো কি তুমি আপনায় হারালে॥
একি মনে রাখা একি ভুলে যাওয়া।
একি স্রোতে ভাসা, একি কূলে যাওয়া।
কভুবা নয়নে কভুবা পরানে কর লুকোচুরি কেন যে কে জানে।
কভুবা ছায়ায় কভুবা আলোয় কোন্ দোলায় যে নাড়ালে॥
ও আমার চাঁদের আলো
ও আমার চাঁদের আলো, আজ ফাগুনের সন্ধ্যাকালে
ধরা দিয়েছ যে আমার পাতায় পাতায় ডালে ডালে॥
যে-গান তোমার সুরের ধারায় বন্যা জাগায় তারায় তারায়
মোর আঙিনায় বাজল গো, বাজল সে-সুর আমার প্রাণের তালে তালে॥
সব কুঁড়ি মোর ফুটে ওঠে তোমার হাসির ইশারাতে।
দখিন-হাওয়া দিশাহারা আমার ফুলের গন্ধে মাতে।
শুভ্র, তুমি করলে বিলোল আমার প্রাণে রঙের হিলোল–
মর্মরিত মর্ম গো,
মর্ম আমার জড়ায় তোমার হাসির জালে॥
ও চাঁদ তোমায় দোলা দেবে কে
ও চাঁদ, তোমায় দোলা দেবে কে!
ও চাঁদ, তোমায় দোলা–
কে দেবে কে দেবে তোমায় দোলা–
আপন আলোর স্বপন-মাঝে বিভল ভোলা॥
কেবল তোমার চোখের চাওয়ায় দোলা দিলে হাওয়ায় হাওয়ায়,
বনে বনে দোল জাগালো ওই চাহনি তুফানতোলা॥
আজ মানসের সরোবরে
কোন্ মাধুরীর কমলকানন দোলাও তুমি ঢেউয়ের ‘পরে।
তোমার হাসির আভাস লেগে বিশ্ব-দোলন দোলার বেগে
উঠল জেগে আমার গানের কল্লোলিনী কলরোলা॥
ও মঞ্জরী ও মঞ্জরী আমের মঞ্জরী
ও মঞ্জরী, ও মঞ্জরী আমের মঞ্জরী,
আজ হৃদয় তোমার উদাস হয়ে পড়ছে কি ঝরি॥
আমার গান যে তোমার গন্ধে মিশে দিশে দিশে
ফিরে ফিরে ফেরে গুঞ্জরি॥
পূর্ণিমাচাঁদ তোমার শাখায় শাখায়
তোমার গন্ধ-সাথে আপন আলো মাথায়।
ওই দখিন-বাতাস গন্ধে পাগল ভাঙল আগল,
ঘিরে ঘিরে ফিরে সঞ্চরি॥
ওই ভাঙল হাসির বাঁধ
ওই ভাঙল হাসির বাঁধ।
অধীর হয়ে মাতল কেন পূর্ণিমার ওই চাঁদ॥
উতল হাওয়া ক্ষণে ক্ষণে মুকুল-ছাওয়া বকুলবনে
দোল দিয়ে যায়, পাতায় পাতায়, ঘটায় পরমাদ॥
ঘুমের আঁচল আকুল হল কী উল্লাসের ভরে।
স্বপন যত ছড়িয়ে প’ল দিকে দিগন্তরে।
আজ রাতের এই পাগলামিরে বাঁধবে ব’লে কে ওই ফিরে,
শালবীথিকায় ছায়া গেঁথে তাই পেতেছে ফাঁদ॥
ওই মালতীলতা দোলে
ওই মালতীলতা দোলে
পিয়ালতরুর কোলে পুব-হাওয়াতে॥
মোর হৃদয়ে লাগে দোলা, ফিরি আপনভোলা–
মোর ভাবনা কোথায় হারা মেঘের মতন যায় চলে॥
জানি নে কোথায় জাগো ওগো বন্ধু পরবাসী–
কোন্ নিভৃত বাতায়নে।
সেথা নিশীথের জল-ভরা কণ্ঠে
কোন্ বিরহিণীর বাণী তোমারে কী যায় ব’লে॥
ওই আসে ওই অতি ভৈরব হরষে
ওই আসে ওই অতি ভৈরব হরষে
জলসিঞ্চিত ক্ষিতিসৌরভরভসে
ঘনগৌরবে নবযৌবনা বরষা
শ্যামগম্ভীর সরসা।
গুরু গর্জনে নীল অরণ্য শিহরে,
নিখিলচিত্তহরষা
ঘনগৌরবে আসিছে মত্ত বরষা ॥
কোথা তোরা অয়ি তরুণী পথিকললনা,
জনপদবধূ তড়িতচকিতনয়না,
মালতীমালিনী কোথা প্রিয়পরিচারিকা,
কোথা তোরা অভিসারিকা।
ঘনবনতলে এসো ঘননীলবসনা,
ললিত নৃত্যে বাজুক স্বর্ণরসনা,
আনো বীণা মনোহারিকা।
কোথা বিরহিণী, কোথা তোরা অভিসারিকা ॥
আনো মৃদঙ্গ মুরজ মুরলী মধুরা,
বাজাও শঙ্খ, হুলুরব করো বধুরা–
এসেছে বরষা, ওগো নব-অনুরাগিণী,
ওগো প্রিয়সুখভাগিনী।
কুঞ্জকুটিরে অয়ি ভাবাকুললোচনা,
ভূর্জপাতায় নবগীত করো রচনা
মেঘমল্লাররাগিণী।
এসেছে বরষা, ওগো নব-অনুরাগিণী॥
কেতকীকেশরে কেশপাশ করো সুরভি,
ক্ষীণ কটিতটে গাঁথি লয়ে পরো করবী॥
কদম্বরেণু বিছাইয়া দাও শয়নে,
অঞ্জন আঁকো নয়নে।
তালে তালে দুটি কঙ্কন কনকনিয়া
ভবনশিখীরে নাচাও গণিয়া গণিয়া
স্মিতবিকশিত বয়নে–
কদম্বরেণু বিছাইয়া ফুলশয়নে॥
এসেছে বরষা, এসেছে নবীনা বরষা,
গগন ভরিয়া এসেছে ভুবনভরসা ॥
দুলিছে পবনে সনসন বনবীথিকা,
গীতিময় তরুলতিকা।
শতেক যুগের কবিদলে মিলি আকাশে
ধ্বনিয়া তুলিছে মত্তমদির বাতাসে
শতেক যুগের গীতিকা।
শতশতগীতমুখরিত বনবীথিকা ॥
ওই কি এলে আকাশপারে দিক-ললনার প্রিয়
ওই কি এলে আকাশপারে দিক-ললনার প্রিয়–
চিত্তে আমার লাগল তোমার ছায়ার উত্তরীয়॥
মেঘের মাঝে মৃদঙ তোমার বাজিয়ে দিলে কি ও,
ওই তালেতে মাতিয়ে আমায় নাচিয়ে দিয়ো দিয়ো ॥
ওই বুঝি কালবৈশাখী
ওই বুঝি কালবৈশাখী
সন্ধ্যা-আকাশ দেয় ঢাকি॥
ভয় কী রে তোর ভয় কারে, দ্বার খুলে দিস চার ধারে–
শোন্ দেখি ঘোর হুঙ্কারে নাম তোরই ওই যায় ডাকি॥
তোর সুরে আর তোর গানে
দিস সাড়া তুই ওর পানে।
যা নড়ে তায় দিক নেড়ে, যা যাবে তা যাক ছেড়ে,
যা ভাঙা তাই ভাঙবে রে– যা রবে তাই থাক বাকি॥
ওই-যে ঝড়ের মেঘের কোলে
ওই-যে ঝড়ের মেঘের কোলে
বৃষ্টি আসে মুক্তকেশে আঁচলখানি দোলে॥
ওরই গানের তালে তালে আমে জামে শিরীষ শালে
নাচন লাগে পাতায় পাতায় আকুল কল্লোলে॥
আমার দুই আঁখি ওই সুরে
যায় হারিয়ে সজল ধারায় ওই ছায়াময় দূরে।
ভিজে হাওয়ায় থেকে থেকে কোন্ সাথি মোর যায় যে ডেকে,
একলা দিনের বুকের ভিতর ব্যথার তুফান তোলে॥
ওগো শেফালিবনের মনের কামনা
ওগো শেফালিবনের মনের কামনা,
কেন সুদূর গগনে গগনে
আছ মিলায়ে পবনে পবনে।
কেন কিরণে কিরণে ঝলিয়া
যাও শিশিরে শিশিরে গলিয়া।
কেন চপল আলোতে ছায়াতে
আছ লুকায়ে আপন মায়াতে।
তুমি মুরতি ধরিয়া চকিতে নামো-না,
ওগো শেফালিবনের মনের কামনা ॥
আজি মাঠে মাঠে চলো বিহরি,
তৃণ উঠুক শিহরি শিহরি।
নামো তালপল্লববীজনে,
নামো জলে ছায়াছবিসৃজনে।
এসো সৌরভ ভরি আঁচলে,
আঁখি আঁকিয়া সুনীল কাজলে।
মম চোখের সমুখে ক্ষণেক থামো-না,
ওগো শেফালিবনের মনের কামনা ॥
ওগো সোনার স্বপন, সাধের সাধনা,
কত আকুল হাসি ও রোদনে,
রাতে দিবসে স্বপনে বোধনে,
জ্বালি জোনাকি প্রদীপমালিকা,
ভরি নিশীথতিমিরথালিকা,
প্রাতে কুসুমের সাজি সাজায়ে,
সাঁজে ঝিল্লি-ঝাঁঝর বাজায়ে,
কত করেছে তোমার স্তুতি-আরাধনা,
ওগো সোনার স্বপন, সাধের সাধনা ॥
ওই বসেছ শুভ্র আসনে
আজি নিখিলের সম্ভাষণে।
আহা শ্বেতচন্দনতিলকে
আজি তোমারে সাজায়ে দিল কে।
আহা বরিল তোমারে কে আজি
তার দুঃখশয়ন তেয়াজি–
তুমি ঘুচালে কাহার বিরহকাঁদনা,
ওগো সোনার স্বপন, সাধের সাধনা ॥