- বইয়ের নামঃ প্রকৃতি
- লেখকের নামঃ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
- প্রকাশনাঃ মুঠোবই
- বিভাগসমূহঃ রবীন্দ্রসংগীত
অনন্তের বাণী তুমি বসন্তের মাধুরী-উৎসবে
অনন্তের বাণী তুমি, বসন্তের মাধুরী-উৎসবে
আনন্দের মধুপাত্র পরিপূর্ণ করি দিবে কবে॥
বঞ্জুলনিকুঞ্জতলে সঞ্চরিবে লীলাচ্ছলে,
চঞ্চল অঞ্চলগন্ধে বনচ্ছায়া রোমাঞ্চিত হবে॥
মন্থর মঞ্জুল ছন্দে মঞ্জীরের গুঞ্জনকল্লোল
আন্দোলিবে ক্ষণে ক্ষণে অরণ্যের হৃদয়হিন্দোল।
নয়নপল্লবে হাসি হিল্লোলি উঠিবে ভাসি,
মিলনমল্লিকামাল্য পরাইবে পরানবল্লভে॥
অনেক দিনের মনের মানুষ যেন এলে কে
অনেক দিনের মনের মানুষ যেন এলে কে
কোন্ ভুলে-যাওয়া বসন্ত থেকে॥
যা-কিছু সব গেছ ফেলে খুঁজতে এলে হৃদয়ে,
পথ চিনেছ চেনা ফুলের চিহ্ন দেখে॥
বুঝি মনে তোমার আছে আশা–
আমার ব্যথায় তোমার মিলবে বাসা।
দেখতে এলে সেই-যে বীণা বাজে কিনা হৃদয়ে,
তারগুলি তার ধুলায় ধুলায় গেছে কি ঢেকে।
অমল ধবল পালে লেগেছে মন্দ মধুর হাওয়া
অমল ধবল পালে লেগেছে মন্দ মধুর হাওয়া–
দেখি নাই কভু দেখি নাই এমন তরণী বাওয়া॥
কোন্ সাগরের পার হতে আনে কোন্ সুদূরের ধন–
ভেসে যেতে চায় মন,
ফেলে যেতে চায় এই কিনারায় সব চাওয়া সব পাওয়া॥
পিছনে ঝরিছে ঝরো ঝরো জল, গুরু গুরু দেয়া ডাকে–
মুখে এসে পড়ে অরুণকিরণ ছিন্ন মেঘের ফাঁকে।
ওগো কাণ্ডারী, কে গো তুমি, কার হাসিকান্নার ধন।
ভেবে মরে মোর মন–
কোন্ সুরে আজ বাঁধিবে যন্ত্র, কী মন্ত্র হবে গাওয়া॥
অশ্রুভরা বেদনা দিকে দিকে জাগে
অশ্রুভরা বেদনা দিকে দিকে জাগে।
আজি শ্যামল মেঘের মাঝে বাজে কার কামনা ॥
চলিছে ছুটিয়া অশান্ত বায়,
ক্রন্দন কার তার গানে ধ্বনিছে–
করে কে সে বিরহী বিফল সাধনা ॥
আঁধার অম্বরে প্রচণ্ড ডম্বরু বাজিল
আঁধার অম্বরে প্রচণ্ড ডম্বরু বাজিল গম্ভীর গরজনে।
অশত্থপল্লবে অশান্ত হিল্লোল সমীরচঞ্চল দিগঙ্গনে॥
নদীর কল্লোল, বনের মর্মর, বাদল-উচ্ছল নির্ঝরঝর্ঝর,
ধ্বনি তরঙ্গিল নিবিড় সঙ্গীতে– শ্রাবণসন্ন্যাসী রচিল রাগিণী॥
কদম্বকুঞ্জের সুগন্ধমদিরা অজস্র লুটিছে দুরন্ত ঝটিকা।
তড়িৎশিখা ছুটে দিগন্ত সন্ধিয়া, ভয়ার্ত যামিনী উঠিছে ক্রন্দিয়া–
নাচিছে যেন কোন্ প্রমত্ত দানব মেঘের দুর্গের দুয়ার হানিয়া ॥
আঁধার কুঁড়ির বাঁধন টুটে
আঁধার কুঁড়ির বাঁধন টুটে চাঁদের ফুল উঠেছে ফুটে॥
তার গন্ধ কোথায়, গন্ধ কোথায় রে।
গন্ধ আমার গভীর ব্যথায় হৃদয়-মাঝে লুটে॥
ও কখন যাবে সরে, আকাশ হতে পড়বে ঝরে।
ওরে রাখব কোথায়, রাখব কোথায় রে।
রাখব ওরে আমার ব্যথায় গানের পত্রপুটে॥
আকাশ আমায় ভরল আলোয়
আকাশ আমায় ভরল আলোয়, আকাশ আমি ভরব গানে।
সুরের আবীর হানব হাওয়ায়, নাচের আবীর হাওয়ায় হানে॥
ওরে পলাশ, ওরে পলাশ,
রাঙা রঙের শিখায় শিখায় দিকে দিকে আগুন জ্বলাস–
আমার মনের রাগরাগিণী রাঙা হল রঙিন তানে॥
দখিন হাওয়ার কুসুমবনের বুকের কাঁপন থাকে না যে।
নীল আকাশে সোনার আলোয় কচি পাতার নূপুর বাজে।
ওরে শিরীষ, ওরে শিরীষ,
মৃদু হাসির অন্তরালে গন্ধজালে শূন্য ঘিরিস–
তোমার গন্ধ আমার কণ্ঠে আমার হৃদয় টেনে আনে॥
আকাশ হতে খসল তারা আঁধার রাতে পথহারা
আকাশ হতে খসল তারা আঁধার রাতে পথহারা ॥
প্রভাত তারে খুঁজতে যাবে– ধরার ধূলায় খুঁজে পাবে
তৃণে তৃণে শিশিরধারা ॥
দুখের পথে গেল চলে– নিবল আলো, মরল জ্বলে।
রবির আলো নেমে এসে মিলিয়ে নেবে ভালোবেসে,
দুঃখ তখন হবে সারা ॥
আকাশতলে দলে দলে মেঘ যে ডেকে যায়
আকাশতলে দলে দলে মেঘ যে ডেকে যায়
‘আ য় আ য় আ য়’॥
জামের বনে আমের বনে রব উঠেছে তাই–
‘যা ই যা ই যা ই।
উড়ে যাওয়ার সাধ জাগে তার পুলক-ভরা ডালে
পাতায় পাতায়॥
নদীর ধারে বারে বারে মেঘ যে ডেকে যায়–
‘আ য় আ য় আ য়’।
কাশের বনে ক্ষণে ক্ষণে রব উঠেছে তাই–
‘যা ই যা ই যা ই’।
মেঘের গানে তরীগুলি তান মিলিয়ে চলে
পাল-তোলা পাখায়॥
আকাশভরা সূর্য-তারা
আকাশভরা সূর্য-তারা, বিশ্বভরা প্রাণ,
তাহারি মাঝখানে আমি পেয়েছি মোর স্থান,
বিস্ময়ে তাই জাগে আমার গান॥
অসীম কালের যে হিল্লোলে জোয়ার-ভাঁটার ভুবন দোলে
নাড়ীতে মোর রক্তধারায় লেগেছে তার টান,
বিস্ময়ে তাই জাগে আমার গান॥
ঘাসে ঘাসে পা ফেলেছি বনের পথে যেতে,
ফুলের গন্ধে চমক লেগে উঠেছে মন মেতে,
ছড়িয়ে আছে আনন্দেরই দান,
বিস্ময়ে তাই জাগে আমার গান।
কান পেতেছি, চোখ মেলেছি, ধরার বুকে প্রাণ ঢেলেছি,
জানার মাঝে অজানারে করেছি সন্ধান,
বিস্ময়ে তাই জাগে আমার গান॥
আজ খেলা ভাঙার খেলা খেলবি আয়
আজ খেলা ভাঙার খেলা খেলবি আয়।
সুখের বাসা ভেঙে ফেলবি আয়।
মিলনমালার আজ বাঁধন তো টুটবে,
ফাগুন-দিনের আজ স্বপন তো ছুটবে,
উধাও মনের পাখা মেলবি আয়॥
অস্তগিরির ওই শিখরচূড়ে
ঝড়ের মেঘের আজ ধ্বজা উড়ে।
কালবৈশাখীর হবে যে-নাচন,
সাথে নাচুক তোর মরণবাঁচন,
হাসি কাঁদন পায়ে ঠেলবি আয়॥
আজ দখিন-বাতাসে
আজ দখিন-বাতাসে
নাম-না-জানা কোন্ বনফুল ফুটল বনের ঘাসে।
‘ও মোর পথের সাথী,পথে পথে গোপনে যায় আসে।’
কৃষ্ণচূড়া চূড়ায় সাজে, বকুল তোমার মালার মাঝে,
শিরীষ তোমার ভরবে সাজি ফুটেছে সেই আশে।
‘এ মোর পথের বাঁশির সুরে সুরে লুকিয়ে কাঁদে হাসে।’
ওরে দেখ বা নাই দেখ, ওরে যাও বা না-যাও ভুলে।
ওরে নাই-বা দিলে দোলা, ওরে নাই-বা নিলে তুলে।
সভায় তোমার ও কেহ নয়, ওর সাথে নেই ঘরের প্রণয়,
যাওয়া-আসার আভাস নিয়ে রয়েছে একপাশে।
‘ওগো ওর সাথে মোর প্রাণের কথা নিশ্বাসে নিশ্বাসে।’