- বইয়ের নামঃ নাট্যগীতি
- লেখকের নামঃ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
- প্রকাশনাঃ মুঠোবই
- বিভাগসমূহঃ রবীন্দ্রসংগীত
অভয় দাও তো বলি আমার
অভয় দাও তো বলি আমার
wish কী–
একটি ছটাক সোডার জলে
পাকী তিন পোয়া হুইস্কি ।।
অসুন্দরের পরম বেদনায় সুন্দরের আহ্বান
অসুন্দরের পরম বেদনায় সুন্দরের আহ্বান।
সূর্যরশ্মি কালো মেঘের ললাটে পরায় ইন্দ্রধনু, তার লজ্জাকে সান্ত্বনা দেবার তরে।
মর্তের অভিশাপে স্বর্গের করুণা যখন নামে তখনি তো সুন্দরের আবির্ভাব।
প্রিয়তমে, সেই করুণাই কি তোমার হৃদয়কে কাল মধুর করে নি।
রাগ: ?
তাল: ?
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): অগ্রহায়ণ, ১৩২৮
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): নভেম্বর, ১৯২১
স্বরলিপিকার: শৈলজারঞ্জন মজুমদার
এই গানটি “শাপমোচন” গ্রন্থে আছে
আঁধার শাখা উজল করি হরিত-পাতা-ঘোমটা পরি
আঁধার শাখা উজল করি হরিত-পাতা-ঘোমটা পরি
বিজন বনে, মালতীবালা, আছিস কেন ফুটিয়া ।।
শোনাতে তোরে মনের ব্যথা শুনিতে তোর মনের কথা
পাগল হয়ে মধুপ কভু আসে না হেথা ছুটিয়া ।।
মলয় তব প্রণয়-আশে ভ্রমে না হেথা আকুল শ্বাসে,
পায় না চাঁদ দেখিতে তোর শরমে-মাখা মুখানি ।
শিয়রে তোর বসিয়া থাকি মধুর স্বরে বনের পাখি
লভিয়া তোর সুরভিশ্বাস যায় না তোরে বাখানি ।।
আজ আসবে শ্যাম গোকুলে ফিরে
আজ আসবে শ্যাম গোকুলে ফিরে।
আবার বাজবে বাঁশি যমুনাতীরে
আমরা কী করব। কী বেশ ধরব।
কী মালা পড়ব। বাঁচব কি মরব সুখে।
কী তারে বলব ! কথা কি রবে মুখে।
শুধু তার মুখপানে চেয়ে চেয়ে
দাঁড়ায়ে ভাসব নয়ননীরে।।
আজি উন্মাদ মধুনিশি ওগো চৈত্রনিশীথশশী
আজি উন্মাদ মধুনিশি ওগো চৈত্রনিশীথশশী।
তুমি এ বিপুল ধরণীর পানে কী দেখিছ একা বসি
চৈত্রনিশীথশশী।।
কত নদীতীরে কত মন্দিরে কত বাতায়নতলে
কত কানাকানি, মন-জানাজানি সাধাসাধি কত ছলে।
শাখা-প্রশাখার দ্বার-জানালার আড়ালে আড়ালে পশি
কত সুখদুখ কত কৌতুক দেখিতেছ একা বসি
চৈত্রনিশীথশশী।।
মোরে দেখো চাহি— কেহ কোথা নাহি, শূন্যভবনছাদে
নৈশ পবন কাঁদে।
তোমারি মতন একাকী আপনি চাহিয়া রয়েছি বসি
চৈত্রনিশীথশশী।।
আমরা বসব তোমার সনে
আমরা বসব তোমার সনে।–
তোমার শরিক হব রাজার রাজা,
তোমার আধেক সিংহাসনে।।
তোমার দ্বারী মোদের করেছে শির নত –
তারা জানে না যে মোদের গরব কত ।
তাই বাহির হতে তোমায় ডাকি,
তুমি ডেকে লও গো আপন জনে ।।
আমাদের সখীরে কে নিয়ে যাবে রে
আমাদের সখীরে কে নিয়ে যাবে রে—
তারে কেড়ে নেব, ছেড়ে দেব না—না—না।
কে জানে কোথা হতে কে এসেছে।
কেন সে মোদের সখী নিতে আসে—দেব’ না।।
সখীরা পথে গিয়ে দাঁড়াব, হাতে তার ফুলের বাঁধন জড়াব,
বেঁধে তায় রেখে দেব’ কুসুমবনে— সখীরে নিয়ে যেতে দেব’ না।।
আমি কেবল ফুল জোগাব
আমি কেবল ফুল জোগাব
তোমার দুটি রাঙা হাতে ।
বুদ্ধি আমার খেলে নাকো
পাহারা বা মন্ত্রণাতে ।।
আর কি আমি ছাড়ব তোরে
আর কি আমি ছাড়ব তোরে ।
মন দিয়ে মন নাই বা পেলেম,
জোর ক’রে রাখিব ধ’রে ।
শূন্য করে হৃদয়পুরী মন যদি করিলে চুরি
তুমিই তবে থাকো সেথায় শূন্য হৃদয় পূর্ণ ক’রে ।।
রাগ: তোড়ি
তাল: অজ্ঞাত
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): 1289
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): 1882
এই গানটি “বউ-ঠাকুরানীর হাট” গ্রন্থে আছে
আয় রে আয় রে সাঁঝের বা, লতাটিরে দুলিয়ে যা
আয় রে আয় রে সাঁঝের বা, লতাটিরে দুলিয়ে যা—
ফুলের গন্ধ দেব তোরে আঁচলটি তোর ভ’রে ভ’রে ।।
আয় রে আয় রে মধুকর, ডানা দিয়ে বাতাস কর্—
ভোরের বেলা গুন্গুনিয়ে ফুলের মধু যাবি নিয়ে ।।
আয় রে চাঁদের আলো আয়, হাত বুলিয়ে দে রে গায়—
পাতার কোলে মাথা থুয়ে ঘুমিয়ে পড়বি শুয়ে শুয়ে ।
পাখি রে, তুই কোস্ নে কথা— ওই যে ঘুমিয়ে প’ল লতা ।।
———
রাগ: গৌড়সারং
তাল: একতাল
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): 1290
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): 1884
ইচ্ছে ! –ইচ্ছে
ইচ্ছে ! –ইচ্ছে !
সেই তো ভাঙছে, সেই তো গড়ছে,
সেই তো দিচ্ছে নিচ্ছে।।
সেই তো আঘাত করছে তলায়, সেই তো বাঁধন ছিঁড়ে পালায়–
বাঁধন পরতে সেই তো আবার ফিরছে।।
রাগ: আড়ানা
তাল: কাহারবা
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): 1340
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): 1933
স্বরলিপিকার: শান্তিদেব ঘোষ
এই গানটি “তাসের দেশ” গ্রন্থে আছে
এই তো ভরা হল ফুলে ফুলে ফুলের ডালা
এই তো ভরা হল ফুলে ফুলে ফুলের ডালা।
ভরা হল– কে নিবি কে নিবি গো, গাঁথিবি বরণমালা।
চম্পা চামেলি সেঁউতি বেলি
দেখে যা সাজি আজি রেখেছি মেলি–
নবমালতীগন্ধ-ঢালা।।
বনের মাধুরী হরণ করো তরুণ আপন দেহে।
নববধূ, মিলনশুভলগন-রাত্রে লও গো বাসরগেহে–
উপবনের সৌরভভাষা,
রসতৃষিত মধুপের আশা।
রাত্রিজাগর রজনীগন্ধা–
করবী রূপসীর অলকানন্দা–
গোলাপে গোলাপে মিলিয়া মিলিয়া রচিবে মিলনের পালা।।
একদা প্রাতে কুঞ্জতলে অন্ধ বালিকা
একদা প্রাতে কুঞ্জতলে অন্ধ বালিকা
পত্রপুটে আনিয়া দিল পুষ্পমালিকা।।
কণ্ঠে পরি অশ্রুজল ভরিল নয়নে,
বক্ষে লয়ে চুমিনু তার স্নিগ্ধ বয়নে।।
কহিনু তারে, ‘অন্ধকারে দাঁড়ায়ে রমণী,
কী ধন তুমি করিছ দান না জানো আপনি।
পুষ্পসম অন্ধ তুমি অন্ধ বালিকা,
দেখ নি নিজে মোহন কী যে তোমার মালিকা।’
এতদিন পরে মোরে
এতদিন পরে মোরে
আপন হাতে বেঁধে দিলে মুক্তিডোরে।
সাবধানীদের পিছে পিছে
দিন কেটেছে কেবল মিছে,
ওদের বাঁধা পথের বাঁধন হতে টেনে নিলে আপন ক’রে ।।
এবার চলিনু তবে
এবার চলিনু তবে ।।
সময় হয়েছে নিকট, এখন বাঁধন ছিঁড়িতে হবে।
উচ্ছল জল করে ছলছল,
জাগিয়া উঠেছে কলকোলাহল,
তরণীপতাকা চলচঞ্চল কাঁপিছে অধীর রবে।
সময় হয়েছে নিকট, এখন বাঁধন ছিঁড়িতে হবে ।।
আমি নিষ্ঠুর কঠিন কঠোর, নির্মম আমি আজি।
আর নাই দেরি, ভৈরবভেরী বাহিরে উঠেছে বাজি।
তুমি ঘুমাইছ নিমীলনয়নে,
কাঁপিয়া উঠিছ বিরহস্বপনে,
প্রভাতে জাগিয়া শূন্য শয়নে কাঁদিয়া চাহিয়া রবে।
সময় হয়েছে নিকট, এখন বাঁধন ছিঁড়িতে হবে ।।
অরুণ তোমার তরুণ অধর করুণ তোমার আঁখি—
অমিয়রচন সোহাগবচন অনেক রয়েছে বাকি।
পাখি উড়ে যাবে সাগরের পার,
সুখময় নীড় পড়ে রবে তার,
মহাকাশ হতে ওই বারে-বার আমারে ডাকিছে সবে।
সময় হয়েছে নিকট, এখন বাঁধন ছিঁড়িতে হবে।।
বিশ্বজগৎ আমারে মাগিলে কে মোর আত্মপর।
আমার বিধাতা আমাতে জাগিলে কোথায় আমার ঘর ।
কিসেরই বা সুখ, ক’ দিনের প্রাণ।
ওই উঠিয়াছে সংগ্রামগান,
অমর মরণ রক্তচরণ নাচিছে সগৌরবে।
সময় হয়েছে নিকট, এখন বাঁধন ছিঁড়িতে হবে ।।
ও কী কথা বল সখী, ছি ছি, ও কথা মনে এনো না
ও কী কথা বল সখী, ছি ছি, ও কথা মনে এনো না।।
আজি সুখের দিনে জগত হাসিছে,
হেরো লো দশ দিশি হরষে ভাসিছে—
আজি ও ম্লান মুখ প্রাণে যে সহে না।
সুখের দিনে, সখী, কেন ও ভাবনা ।।
ওই জানালার কাছে বসে আছে করতলে রাখি মাথা
ওই জানালার কাছে বসে আছে করতলে রাখি মাথা—
তার কোলে ফুল পড়ে রয়েছে, সে যে ভুলে গেছে মালা গাঁথা ।।
শুধু ঝুরু ঝুরু বায়ু বহে যায় তার কানে কানে কী যে কহে যায়—
তাই আধো শুয়ে আধো বসিয়ে ভাবিতেছে কত কথা ।।
চোখের উপরে মেঘ ভেসে যায়, উড়ে উড়ে যায় পাখি—
সারা দিন ধ’রে বকুলের ফুল ঝ’রে পড়ে থাকি থাকি ।
মধুর আলস, মধুর আবেশ, মধুর মুখের হাসিটি—
মধুর স্বপনে প্রাণের মাঝারে বাজিছে মধুর বাঁশিটি ।।
ওগো দয়াময়ী চোর, এত দয়া মনে তোর
ওগো দয়াময়ী চোর, এত দয়া মনে তোর !
বড়ো দয়া ক’রে কণ্ঠে আমার জড়াও মায়ার ডোর ।
বড়ো দয়া ক’রে চুরি ক’রে লও শূন্য হৃদয় মোর ।।
রাগ: ভৈরবী
তাল: অজ্ঞাত
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): 1307
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): 1900
ওর মানের এ বাঁধ টুটবে না কি টুটবে না
ওর মানের এ বাঁধ টুটবে না কি টুটবে না।
ওর মনের বেদন থাকবে মনে, প্রাণের কথা ফুটবে না ?।
কঠিন পাষাণ বুকে লয়ে নাই রহিল অটল হয়ে
প্রেমেতে ওই পাথর ক্ষ’য়ে চোখের জল কি ছুটবে না ?।
কত দিন একসাথে ছিনু ঘুমঘোরে
কত দিন একসাথে ছিনু ঘুমঘোরে,
তবু জানিতাম নাকো ভালোবাসি তোরে ।
মনে আছে ছেলেবেলা কত যে খেলেছি খেলা,
কুসুম তুলেছি কত দুইটি আঁচল ভ’রে ।
ছিনু সুখে যতদিন দুজনে বিরহহীন
তখন কি জানিতাম ভালোবাসি তোরে !
অবশেষে এ কপাল ভাঙিল যখন,
ছেলেবেলাকার যত ফুরালো স্বপন,
লইয়া দলিত মন হইনু প্রবাসী—
তখন জানিনু, সখী, কত ভালোবাসি ।।
কথা কোস্ নে লো রাই, শ্যামের বড়াই বড়ো বেড়েছে
কথা কোস্ নে লো রাই, শ্যামের বড়াই বড়ো বেড়েছে ।
কে জানে ও কেমন ক’রে মন কেড়েছে ।।
শুধু ধীরে বাজায় বাঁশি, শুধু হাসে মধুর হাসি—
গোপিনীদের হৃদয় নিয়ে তবে ছেড়েছে ।।
কবরীতে ফুল শুকালো
কবরীতে ফুল শুকালো
কাননের ফুল ফুটল বনে ।।
দিনের আলো প্রকাশিল,
মনের সাধ রহিল মনে ।।
কাছে তার যাই যদি কত যেন পায় নিধি
কাছে তার যাই যদি কত যেন পায় নিধি,
তবু হরষের হাসি ফুটে-ফুটে ফুটে না ।
কখনো বা মৃদু হেসে আদর করিতে এসে
সহসা শরমে বাধে, মন উঠে উঠে না ।
রোষের ছলনা করি দূরে যাই, চাই ফিরি—
চরণ-বারণ-তরে উঠে-উঠে উঠে না ।
কাতর নিশ্বাস ফেলি আকুল নয়ন মেলি
চাহি থাকে, লাজবাঁধ তবু টুটে টুটে না ।
যখন ঘুমায়ে থাকি মুখপানে মেলি আঁখি
চাহি থাকে, দেখি দেখি সাধ যন মিটে না ।
সহসা উঠিলে জাগি তখন কিসের লাগি
শরমেতে ম’রে গিয়ে কথা যেন ফুটে না ।
লাজময়ী, তোর চেয়ে দেখি নি লাজুক মেয়ে,
প্রেমবরিষার স্রোতে লাজ তবু টুটে না ।।
কাজ ভোলাবার কে গো তোরা
কাজ ভোলাবার কে গো তোরা !
রঙিন সাজে কে যে পাঠায়
কোন্ সে ভুবন-মনো-চোরা !
কঠিন পাথর সারে সারে
দেয় পাহারা গুহার দ্বারে,
হাসির ধারায় ডুবিয়ে তারে
ঝরাও রসের সুধা-ঝোরা !
স্বপন-তরীর তোরা নেয়ে
লাগল প্রাণে নেশার হাওয়া,
পাগ্লা পরান চলে গেয়ে।
কোন্ উদাসীর উপবনে
বাজল বাঁশি ক্ষণে ক্ষণে,
ভুলিয়ে দিল ঈশান কোণে
ঝঞ্ঝা ঘনায় ঘনঘোরা ।
কার হাতে যে ধরা দেব, প্রাণ
কার হাতে যে ধরা দেব, প্রাণ,
তাই ভাবতে বেলা অবসান ।।
ডান দিকেতে তাকাই যখন বাঁয়ের লাগি কাঁদে রে মন—
বাঁয়ের লাগি ফিরলে তখন দক্ষিণেতে পড়ে টান ।।
কিছুই তো হল না
কিছুই তো হল না ।
সেই সব— সেই সব— সেই হাহাকাররব,
সেই অশ্রুবারিধারা, হৃদয়বেদনা ।।
কিছুতে মনের মাঝে শান্তি নাহি পাই,
কিছুই না পাইলাম যাহা কিছু চাই ।
ভালো তো গো বাসিলাম, ভালোবাসা পাইলাম,
এখনো তো ভালোবাসি— তবুও কী নাই ।।
কী করিব বলো, সখা, তোমার লাগিয়া
কী করিব বলো, সখা, তোমার লাগিয়া ।
কী করিলে জুড়াইতে পারিব ও হিয়া ।।
এই পেতে দিনু বুক, রাখো, সখা, রাখো মুখ—
ঘুমাও তুমি গো, আমি রহিনু জাগিয়া ।
খুলে বলো, বলো সখা, কী দুঃখ তোমার—
অশ্রুজলে মিলাইব অশ্রুজলধার !
একদিন বলেছিলে মোর ভালোবাসা
পাইলে পুরিবে তব হৃদয়ের আশা ।
কই সখা, প্রাণ মন করেছি তো সমর্পণ—
দিয়েছি তো যাহা-কিছু আছিল আমার ।
তবু কেন শুকালো না অশ্রুজলধার ।।
কী জানি কী ভেবেছ মনে
কী জানি কী ভেবেছ মনে
খুলে বলো ললনে ।
কী কথা হায় ভেসে যায়
ওই ছলোছলো দুটি নয়নে।
কে তুমি গো খুলিয়াছ স্বর্গের দুয়ার
কে তুমি গো খুলিয়াছ স্বর্গের দুয়ার
ঢালিতেছ এত সুখ, ভেঙে গেল— গেল বুক—
যেন এত সুখ হৃদে ধরে না গো আর ।
তোমার চরণে দিনু প্রেম-উপহার—
না যদি চাও গো দিতে প্রতিদান তার
নাই বা দিলে তা মোরে, থাকো হৃদি আলো করে,
হৃদয়ে থাকুক জেগে সৌন্দর্য তোমার ।।
কেন রে চাস ফিরে ফিরে, চলে আয় রে চলে আয়
কেন রে চাস ফিরে ফিরে, চলে আয় রে চলে আয়।।
এরা প্রাণের কথা বোঝে না যে, হৃদয়কুসুম দলে যায়।।
হেসে হেসে গেয়ে গান দিতে এসেছিলি প্রাণ,
নয়নের জল সাথে নিয়ে চলে আয় রে চলে আয়।।
কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা মনে মনে
কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা মনে মনে!
মেলে দিলেম গানের সুরের এই ডানা মনে মনে।
তেপান্তরের পাথার পেরোই রূপ-কথার,
পথ ভুলে যাই দূর পারে সেই চুপ্-কথার–
পারুলবনের চম্পারে মোর হয় জানা মনে মনে।।
সূর্য যখন অস্তে পড়ে ঢুলি মেঘে মেঘে আকাশ-কুসুম তুলি।
সাত সাগরের ফেনায় ফেনায় মিশে
আমি যাই ভেসে দূর দিশে–
পরীর দেশের বন্ধ দুয়ার দিই হানা মনে মনে।।
ক্ষমা করো মোরে সখী, শুধায়ো না আর
ক্ষমা করো মোরে সখী, শুধায়ো না আর—
মরমে লুকানো থাক মরমের ভার ।।
যে গোপন কথা, সখী, সতত লুকায়ে রাখি
ইষ্টদেবমন্ত্রসম পূজি অনিবার ।
তাহা মানুষের কানে ঢালিতে যে লাগে প্রাণে—
লুকানো থাক তা, সখী, হৃদয়ে আমার ।।
ভালোবাসি, শুধায়ো না কারে ভালোবাসি ।
সে নাম কেমনে, সখী, কহিব প্রকাশি ।
আমি তুচ্ছ হতে তুচ্ছ— সে নাম যে অতি উচ্চ,
সে নাম যে নহে যোগ্য এই রসনার ।।
ক্ষুদ্র এই বনফুল পৃথিবীকাননে
আকাশের তারকারে পূজে মনে মনে—
দিন-দিন পূজা করি শুকায়ে পড়ে সে ঝরি,
আজন্ম-নীরবে রহি যায় প্রাণ তার ।।
খেলা কর্ খেলা কর্ তোরা কামিনীকুসুমগুলি
খেলা কর্ খেলা কর্ তোরা কামিনীকুসুমগুলি ।
দেখ্ সমীরণ লতাকুঞ্জে গিয়া কুসুমগুলির চিবুক ধরিয়া
ফিরায়ে এ ধার, ফিরায়ে ও ধার, দুইটি কপোল চুমে বারবার
মুখানি উঠায়ে তুলি ।
তোরা খেলা কর্ তোরা খেলা কর্ কামিনীকুসুমগুলি ।
কভু পাতা-মাঝে লুকায়ে মুখ, কভু বায়ু-কাছে খুলে দে বুক,
মাথা নাড়ি নাড়ি নাচ্ কভু নাচ্ বায়ু-কোলে দুলি দুলি ।
দু দণ্ড বাঁচিবি, খেলা তবে খেলা— প্রতি নিমিষেই ফুরাইছে বেলা,
বসন্তের কোলে খেলাশ্রান্ত প্রাণ ত্যজিবি ভাবনা ভুলি ।।
চিঁড়েতন হর্তন ইস্কাবন
চিঁড়েতন হর্তন ইস্কাবন
অতি সনাতন ছন্দে কর্তেছে নর্তন।
কেউ বা ওঠে কেউ পড়ে,
কেউ বা একটু নাহি নড়ে,
কেউ শুয়ে শুয়ে ভুঁয়ে করে কালকর্তন।।
নাহি কহে কথা কিছু–
একটু না হাসে, সামনে যে আসে
চলে তারি পিছু পিছু।
বাঁধা তার পুরাতন চালটা,
নাই কোনো উল্টা-পাল্টা– নাই পরিবর্তন।।
রাগ: ইমন
তাল: কাহারবা
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): 1340
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): 1933
স্বরলিপিকার: শান্তিদেব ঘোষ
এই গানটি “তাসের দেশ” গ্রন্থে আছে
চির-পুরানো চাঁদ
চির-পুরানো চাঁদ,
চিরদিবস এমনি থেকো আমার এই সাধ।।
পুরানো হাসি পুরানো সুধা মিটায় মম পুরানো ক্ষুধা—
নূতন কোনো চকোর যেন পায় না পরসাদ।।
জ্বল্ জ্বল্ চিতা, দ্বিগুণ দ্বিগুণ
জ্বল্ জ্বল্ চিতা, দ্বিগুণ দ্বিগুণ—
পরান সঁপিবে বিধবা বালা ।
জ্বলুক জ্বলুক চিতার আগুন,
জুড়াবে এখনি প্রাণের জ্বালা ।।
শোন্ রে যবন, শোন্ রে তোরা,
যে জ্বালা হৃদয়ে জ্বালালি সবে
সাক্ষী র’লেন দেবতা তার—
এর প্রতিফল ভুগিতে হবে ।।
দেখ্ রে জগৎ, মেলিয়ে নয়ন,
দেখ্ রে চন্দ্রমা, দেখ্ রে গগন,
স্বর্গ হতে সব দেখো দেবগণ—
জ্বলদ্-অক্ষরে রাখো গো লিখে ।
স্পর্ধিত যবন, তোরাও দেখ্ রে,
সতীত্ব-রতন করিতে রক্ষণ
রাজপুত-সতী আজিকে কেমন
সঁপিছে পরান অনলশিখে ।।
জয় জয় জয় হে জয় জ্যোতির্ময়
জয় জয় জয় হে জয় জ্যোতির্ময়–
মোহকলুষঘন কর’ ক্ষয়, কর’ ক্ষয়।।
অগ্নিপরশ তব কর’ কর’ দান,
কর’ নির্মল মম তনুমন প্রাণ–
বন্ধনশৃঙ্খল নাহি সয়, নাহি সয় ।।
গূঢ় বিঘ্ন যত কর’ উৎপাটিত ।
অমৃতদ্বার তব কর’ উদ্ঘাটিত ।
যাচি যাত্রিদল, হে কর্ণধার,
সুপ্তিসাগর কর’ কর’ পার–
স্বপ্নের সঞ্চয় হোক লয়, হোক লয়।।
ঝর ঝর রক্ত ঝরে কাটা মুণ্ড বেয়ে
ঝর ঝর রক্ত ঝরে কাটা মুণ্ড বেয়ে।
ধরণী রাঙা হল রক্তে নেয়ে ।।
ডাকিনী নৃত্য করে প্রসাদ -রক্ত-তরে—
তৃষিত ভক্ত তোমার আছে চেয়ে ।।
তরুতলে ছিন্নবৃন্ত মালতীর ফুল
তরুতলে ছিন্নবৃন্ত মালতীর ফুল—
মুদিয়া আসিছে আঁখি তার, চাহিয়া দেখিল চারি ধার ।।
শুষ্ক তৃণরাশি-মাঝে একেলা পড়িয়া,
চারি দিকে কেহ নাই আর— নিরদয় অসীম সংসার ।।
কে আছে গো দিবে তার তৃষিত অধরে
একবিন্দু শিশিরের কণা— কেহ না, কেহ না ।।
মধুকর কাছে এসে বলে, ‘মধু কই। মধু চাই, চাই ।’
ধীরে ধীরে নিশ্বাস ফেলিয়া ফুল বলে, ‘কিছু নাই, নাই।’
‘ফুলবালা, পরিমল দাও’ বায়ু আসি কহিতেছে কাছে ।
মলিন বদন ফিরাইয়া ফুল বলে, ‘আর কী বা আছে।’
মধ্যাহ্নকিরণ চারি দিকে খরদৃষ্টে চেয়ে অনিমিখে—
ফুলটির মৃদু প্রাণ হায়,
ধীরে ধীরে শুকাইয়া যায় ।।
তুই রে বসন্তসমীরণ
তুই রে বসন্তসমীরণ ।
তোর নহে সুখের জীবন ।।
কিবা দিবা কিবা রাতি পরিমলমদে মাতি
কাননে করিস বিচরণ ।।
নদীরে জাগায়ে দিস লতারে রাগায়ে দিস
চুপিচুপি করিয়া চুম্বন
তোর নহে সুখের জীবন ।।
শোন্ বলি বসন্তের বায়,
হৃদয়ের লতাকুঞ্জে আয় ।
নিভৃত নিকুঞ্জ ছায় হেলিয়া ফুলের গায়
শুনিয়া পাখির মৃদু গান
লতার-হৃদয়ে-হারা সুখে-অচেতন-পারা
ঘুমায়ে কাটায়ে দিবি প্রাণ ।
তাই বলি বসন্তের বায়,
হৃদয়ের লতাকুঞ্জে আয় ।।
তুমি আছ কোন্ পাড়া ? তোমার পাই নে যে সাড়া
তুমি আছ কোন্ পাড়া ? তোমার পাই নে যে সাড়া ।
পথের মধ্যে হাঁ ক’রে যে রইলে হে খাড়া ।।
রোদে প্রাণ যায় দুপুর বেলা, ধরেছে উদরে জ্বালা—
এর কাছে কি হৃদয়জ্বালা ।
তোমার সকল সৃষ্টিছাড়া ।।
রাঙা অধর, নয়ন কালো ভরা পেটেই লাগে ভালো—
এখন পেটের মধ্যে নাড়ীগুলো দিয়েছে তাড়া ।।
তুমি পড়িতেছ হেসে তরঙ্গের মতো এসে
তুমি পড়িতেছ হেসে তরঙ্গের মতো এসে
হৃদয়ে আমার।
যৌবনসমুদ্রমাঝে কোন্ পূর্ণিমায় আজি
এসেছে জোয়ার।
উচ্ছল পাগল নীরে তালে তালে ফিরে ফিরে
এ মোর নির্জন তীরে কী খেলা তোমার !
মোর সর্ব বক্ষ জুড়ে কত নৃত্যে কত সুরে
এস কাছে যাও দূরে শতলক্ষবার।।
কুসুমের মতো শ্বসি পড়িতেছ খসি খসি
মোর বক্ষ-’পরে
গোপন শিহিরছলে বিন্দু বিন্দু অশ্রুজলে
প্রাণ সিক্ত ক’রে ।
নিঃশব্দ সৌরভরাশি পরানে পশিছে আসি
সুখস্বপ্ন পরকাশি নিভৃত অন্তরে।
পরশপুলকে ভোর চোখে আসে ঘুমঘোর,
তোমার চুম্বন মোর সর্বাঙ্গে সঞ্চরে।
তোমার কটি-তটের ধটি কে দিল রাঙিয়া
তোমার কটি-তটের ধটি কে দিল রাঙিয়া —
কোমল গায়ে দিল পরায়ে রঙিন আঙিয়া ।।
বিহানবেলা আঙিনাতলে এসেছ তুমি কী খেলাছলে—
চরণ দুটি চলিতে ছুটি পড়িছে ভাঙিয়া ।
তোমার কটি-তটের ধটি কে দিল রাঙিয়া ।।
কিসের সুখে সহাস মুখে নাচিছ বাছনি—
দুয়ার-পাশে জননী হাসে হেরিয়া নাচনি।
তাথেই-থেই তালির সাথে কাঁকন বাজে মায়ের হাতে—
রাখাল-বেশে ধরেছ হেসে বেণুর পাঁচনি।
কিসের সুখে সহাস মুখে নাচিছ বাছনি।
নিখিল শোনে আকুল-মনে নূপুর-বাজনা,
তপন-শশী হেরিছে বসি তোমার সাজনা।
ঘুমাও যবে মায়ের বুকে আকাশ চেয়ে রহে ও মুখে,
জাগিলে পরে প্রভাত করে নয়ন-মাজনা।
নিখিল শোনে আকুল-মনে নূপুর-বাজনা ।।
রাগ: কাফি
তাল: ঝম্পক
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): ৫ শ্রাবণ, ১৩১০
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): জুলাই, ১৯০৩
রচনাস্থান: আলমোড়া
তোমায় সাজাব যতনে কুসুমে রতনে
তোমায় সাজাব যতনে কুসুমে রতনে
কেয়ূরে কঙ্কণে কুঙ্কুমে চন্দনে।।
কুন্তলে বেষ্টিব স্বর্ণজালিকা, কণ্ঠে দোলাইব মুক্তামালিকা,
সীমন্তে সিন্দুর অরুণ বিন্দুর– চরণ রঞ্জিব অলক্ত-অঙ্কনে।।
সখীরে সাজাব সখার প্রেমে অলক্ষ্য প্রাণের অমূল্য হেমে।
সাজাব সকরুণ বিরহবেদনায়, সাজাব অক্ষয় মিলনসাধনায়–
মধুর লজ্জা রচিব সজ্জা যুগল প্রাণের বাণীর বন্ধনে।।
রাগ: কালাংড়া
তাল: কাহারবা
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): অগ্রহায়ণ, ১৩৪০
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): নভেম্বর, ১৯৩৩
স্বরলিপিকার: শৈলজারঞ্জন মজুমদার
এই গানটি “শাপমোচন” গ্রন্থে আছে
তোলন-নামন পিছন-সামন
তোলন-নামন পিছন-সামন।
বাঁয়ে ডাইনে চাই নে, চাই নে ।
বোসন-ওঠন ছড়ান-গুটন ।
উল্টা-পাল্টা ঘূর্ণি চালটা– বাস্ ! বাস্! বাস্ !
রাগ: ইমন
তাল: কাহারবা
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): মাঘ, ১৩৪৫
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): 1939
স্বরলিপিকার: শান্তিদেব ঘোষ
এই গানটি “তাসের দেশ” গ্রন্থে আছে
থাকতে আর তো পারলি নে মা, পারলি কই
থাকতে আর তো পারলি নে মা, পারলি কই ।
কোলের সন্তানেরে ছাড়লি কই।।
দোষী আছি অনেক দোষে, ছিলি বসে ক্ষণিক রোষে—
মুখ তো ফিরালি শেষে। অভয় চরণ কাড়লি কই।।
দেখব কে তোর কাছে আসে
দেখব কে তোর কাছে আসে—
তুই রবি একেশ্বরী,
একলা আমি রইব পাশে ।।
নহ মাতা, নহ কন্যা, নহ বধূ, সুন্দরী রূপসী হে নন্দনবাসিনী উর্বশী
নহ মাতা, নহ কন্যা, নহ বধূ, সুন্দরী রূপসী হে নন্দনবাসিনী উর্বশী।
গোষ্ঠে যবে নামে সন্ধ্যা শ্রান্ত দেহে স্বর্ণাঞ্চল টানি
তুমি কোনো গৃহপ্রান্তে নাহি জ্বালো সন্ধ্যাদীপখানি।
দ্বিধায় জড়িত পদে কম্প্রবক্ষে নম্রনেত্রপাতে
স্মিতহাস্যে নাহি চল লজ্জিত বাসরশয্যাতে অর্ধরাতে।
উষার উদয়-সম অনবগুণ্ঠিতা তুমি অকুণ্ঠিতা।।
সুরসভাতলে যবে নৃত্য করো পুলকে উল্লসি
হে বিলোল হিল্লোল উর্বশী,
ছন্দে নাচি উঠে সিন্ধুমাঝে তরঙ্গের দল,
শস্যশীর্ষে শিহরিয়া কাঁপি উঠে ধরার অঞ্চল,
তোমার মদির গন্ধ অন্ধ বায়ু বহে চারি ভিতে,
মধুমত্ত ভৃঙ্গ-সম মুগ্ধ কবি ফিরে লুব্ধ চিতে উদ্দাম গীতে।
নূপুর গুঞ্জরি চলো আকুল-অঞ্চলা বিদ্যুতচঞ্চলা।।
না সখা, মনের ব্যথা কোরো না গোপন
না সখা, মনের ব্যথা কোরো না গোপন ।
যবে অশ্রুজল হায় উচ্ছ্বসি উঠিতে চায়
রুধিয়া রেখো না তাহা আমারি কারণ ।
চিনি, সখা, চিনি তব ও দারুণ হাসি—
ওর চেয়ে কত ভালো অশ্রুজলরাশি ।
মাথা খাও— অভাগীরে কোরো না বঞ্চনা,
ছদ্মবেশে আবরিয়া রেখো না যন্ত্রণা ।
মমতার অশ্রুজলে নিভাইব সে অনলে,
ভালো যদি বাস তবে রাখো এ প্রার্থনা ।।
নাচ্ শ্যামা, তালে তালে
নাচ্ শ্যামা, তালে তালে ।।
রুনু রুনু ঝুনু বাজিছে নূপুর, মৃদু মৃদু মধু উঠে গীতসুর,
বলয়ে বলয়ে বাজে ঝিনি ঝিনি, তালে তালে উঠে করতালিধ্বনি—
নাচ্ শ্যামা, নাচ্ তবে ।।
নিরালয় তোর বনের মাঝে সেথা কি এমন নূপুর বাজে !
এমন মধুর গান ? এমন মধুর তান ?
কমলকরের করতালি হেন দেখিতে পেতিস কবে ?—
নাচ্ শ্যামা, নাচ্ তবে ।।
নীরব রজনী দেখো মগ্ন জোছনায়
নীরব রজনী দেখো মগ্ন জোছনায় ।
ধীরে ধীরে, অতি ধীরে, অতি ধীরে গাও গো ।।
ঘুমঘোরময় গান বিভাবরী গায়—
রজনীর কণ্ঠ-সাথে সুকণ্ঠ মিলাও গো ।।
নিশার কুহকবলে নীরবতাসিন্ধুতলে
মগ্ন হয়ে ঘুমাইছে বিশ্বচরাচর—
প্রশান্ত সাগরে হেন তরঙ্গ না তুলে যেন
অধীর উচ্ছ্বাসময় সঙ্গীতের স্বর ।
তটিনী কী শান্ত আছে— ঘুমাইয়া পড়িয়াছে
বাতাসের মৃদুহস্ত-পরশে এমনি
ভুলে যদি ঘুমে ঘুমে তটের চরণ চুমে
সে চুম্বনধ্বনি শুনে চমকে আপনি ।
তাই বলি, অতি ধীরে, অতি ধীরে গাও গো—
রজনীর কণ্ঠ-সাথে সুকণ্ঠ মিলাও গো ।।
পথে যেতে তোমার সাথে মিলন হল দিনের শেষে
পথে যেতে তোমার সাথে মিলন হল দিনের শেষে ।
দেখতে গিয়ে, সাঁঝের আলো মিলিয়ে গেল এক নিমেষে ।
দেখা তোমায় হোক বা না-হোক
তাহার লাগি করব না শোক–
ক্ষণেক তুমি দাঁড়াও, তোমার চরণ ঢাকি এলো কেশে ।।
রাগ: অজ্ঞাত
তাল: অজ্ঞাত
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): পৌষ, ১৩২১
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): জানুয়ারি, ১৯১৫
এই গানটি “চতুরঙ্গ” গ্রন্থে আছে
পোড়া মনে শুধু পোড়া মুখখানি জাগে রে
পোড়া মনে শুধু পোড়া মুখখানি জাগে রে ।
এত আছে লোক, তবু পোড়া চোখে
আর কেহ নাহি লাগে রে ।।
প্রিয়ে, তোমার ঢেঁকি হলে যেতেম বেঁচে
প্রিয়ে, তোমার ঢেঁকি হলে যেতেম বেঁচে
রাঙা চরণতলে নেচে নেচে ।।
ঢিপ্ঢিপিয়ে যেতেম মারা, মাথা খুঁড়ে হতেম সারা—
কানের কাছে কচ্কচিয়ে মানটি তোমার নিতেম যেচে ।।
————
রাগ: রামপ্রসাদী
তাল: দাদরা
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): 1290
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): 1884
বলেছিল ‘ধরা দেব না’, শুনেছিল সেই বড়াই
বলেছিল ‘ধরা দেব না’, শুনেছিল সেই বড়াই।
বীরপুরুষের সয় নি গুমোর, বাধিয়ে দিয়েছে লড়াই।
তার পরে শেষে কী যে হল কার,
কোন্ দশা হল জয়পতাকার।–
কেউ বলে জিৎ, কেউ বলে হার, আমরা গুজব ছড়াই ।।
রাগ: অজ্ঞাত
তাল: অজ্ঞাত
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): কার্তিক, ১৩৪০
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): 1933
বসন্তপ্রভাতে এক মালতীর ফুল
বসন্তপ্রভাতে এক মালতীর ফুল
প্রথম মেলিল আঁখি তার, চাহিয়া দেখিল চারি ধার ।।
উষারানী দাঁড়াইয়া শিয়রে তাহার
দেখিছে ফুলের ঘুম-ভাঙা । হরষে কপোল তার রাঙা ।।
মধুকর গান গেয়ে বলে, ‘মধু কই । মধু দাও দাও ।’
হরষে হৃদয় ফেটে গিয়ে ফুল বলে, ‘এই লও লও ।’
বায়ু আসি কহে কানে কানে, ‘ফুলবালা, পরিমল দাও ।’
আনন্দে কাঁদিয়া কহে ফুল, ‘যাহা আছে সব লয়ে যাও ।’
হরষ ধরে না তার চিতে, আপনারে চাহে বিলাইতে,
বালিকা আনন্দে কুটি-কুটি পাতায় পাতায় পড়ে লুটি ।।
বাঁধন কেন ভূষণ-বেশে
বাঁধন কেন ভূষণ-বেশে
তোরে ভোলায়, হায় অভাগী।
মরণ কেন মোহন হেসে
তোরে দোলায়, হায় অভাগী।।
বাজে রে বাজে ডমরু বাজে হৃদয়মাঝে, হৃদয়মাঝে
বাজে রে বাজে ডমরু বাজে হৃদয়মাঝে, হৃদয়মাঝে।
নাচে রে নাচে চরণ নাচে প্রাণের কাছে, প্রাণের কাছে ।
প্রহর জাগে, প্রহরী জাগে– তারায় তারায় কাঁপন লাগে ।
মরমে মরমে বেদনা ফুটে– বাঁধন টুটে, বাঁধন টুটে ।।
রাগ: ইমনকল্যাণ
তাল: তেওরা
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): 1318
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): 1911
স্বরলিপিকার: অনাদিকুমার দস্তিদার
এই গানটি “মুক্তধারা” গ্রন্থে আছে
বাজে রে বাজে রে
বাজে রে বাজে রে
ওই রুদ্রতালে বজ্রভেরী–
দলে দলে চলে প্রলয়রঙ্গে বীরসাজে রে !
দ্বিধা ত্রাস আলস নিদ্রা ভাঙে লাজে রে !
উড়ে দীপ্ত বিজয়কেতু শূন্য মাঝে রে !
আছে কে পড়িয়া পিছে মিছে কাজে রে ।।
বাহির হলেম আমি আপন ভিতর হতে
বাহির হলেম আমি আপন ভিতর হতে,
নীল আকাশে পাড়ি দেব খ্যাপা হাওয়ার স্রোতে।।
আমের মুকুল ফুটে ফুটে যখন পড়ে ঝ’রে ঝ’রে
মাটির আঁচল ভ’রে ভ’রে–
ঝরাই আমার মনের কথা ভরা ফাগুন-চোতে।।
কোথা তুই প্রাণের দোসর বেড়াস ঘুরি ঘুরি–
বনবীথির আলোছায়ায় করিস লুকোচুরি।
আমার একলা বাঁশি পাগলামি তার পাঠায় দিগন্তরে
তোমার গানের তরে–
কবে বসন্তেরে জাগিয়ে দেব আমাতে আর তোতে।।
বিপাশার তীরে ভ্রমিবারে যাই
বিপাশার তীরে ভ্রমিবারে যাই, প্রতিদিন প্রাতে দেখিবারে পাই
লতা-পাতা-ঘেরা জানালা-মাঝারে একটি মধুর মুখ ।।
চারি দিকে তার ফুটে আছে ফুল— কেহ বা হেলিয়া পরশিছে চুল,
দুয়েকটি শাখা কপাল ছুঁইয়া, দুয়েকটি আছে কপোলে নুইয়া,
কেহ বা এলায়ে চেতনা হারায়ে চুমিয়া আছে চিবুক ।
বসন্তপ্রভাতে লতার মাঝারে মুখানি মধুর অতি—
অধর-দুটির শাসন টুটিয়া রাশি রাশি হাসি পড়িছে ফুটিয়া,
দুটি আঁখি-’পরে মেলিছে মিশিছে তরল চপল জ্যোতি ।।
বুঝেছি বুঝেছি সখা, ভেঙেছে প্রণয়
বুঝেছি বুঝেছি সখা, ভেঙেছে প্রণয় !
ও মিছে আদর তবে না করিলে নয় ?।
ও শুধু বাড়ায় ব্যথা— সে-সব পুরানো কথা
মনে ক’রে দেয় শুধু, ভাঙে এ হৃদয় ।।
প্রতি হাসি প্রতি কথা প্রতি ব্যবহার
আমি যত বুঝি তত কে বুঝিবে আর ।
প্রেম যদি ভুলে থাক সত্য ক’রে বলো-নাকো—
করিব না মুহূর্তের তরে তিরস্কার ।।
আমি তো ব’লেই ছিনু, ক্ষুদ্র আমি নারী
তোমার ও প্রণয়ের নহি অধিকারী ।
আর-কারে ভালোবেসে সুখী যদি হও শেষে
তাই ভালোবেসো নাথ, না করি বারণ ।
মনে ক’রে মোর কথা মিছে পেয়ো নাকো ব্যথা,
পুরানো প্রেমের কথা কোরো না স্মরণ ।।
ড়ো থাকি কাছাকাছি
বড়ো থাকি কাছাকাছি,
তাই ভয়ে ভয়ে আছি ।
নয়ন বচন কোথায় কখন
বাজিলে বাঁচি না-বাঁচি।।
ভাঙা দেউলের দেবতা
ভাঙা দেউলের দেবতা,
তব বন্দনা রচিতে, ছিন্না বীণার তন্ত্রী বিরতা ।
সন্ধ্যাগগনে ঘোষে না শঙ্খ তোমার আরতিবারতা ।
তব মন্দির স্থিরগম্ভীর, ভাঙা দেউলের দেবতা ।।
তব জনহীন ভবনে
থেকে থেকে আসে ব্যাকুল গন্ধ নববসন্তপবনে ।
যে ফুলে রচে নি পূজার অর্ঘ্য, রাখে নি ও রাঙা চরণে,
সে ফুল ফোটার আসে সমাচার জনহীন ভাঙা ভবনে ।।
পূজাহীন তব পূজারি
কোথা সারা দিন ফিরে উদাসীন কার প্রসাদের ভিখারি ।
গোধূলিবেলায় বনের ছায়ায় চির-উপবাস-ভুখারি
ভাঙা মন্দিরে আসে ফিরে ফিরে পূজাহীন তব পূজারি ।
ভাঙা দেউলের দেবতা,
কত উৎসব হইল নীরব, কত পূজানিশা বিগতা ।
কত বিজয়ায় নবীন প্রতিমা কত যায় কত কব তা—
শুধু চিরদিন থাকে সেবাহীন ভাঙা দেউলের দেবতা ।।
ভালো যদি বাস, সখী, কী দিব গো আর
ভালো যদি বাস, সখী, কী দিব গো আর—
কবির হৃদয় এই দিব উপহার ।।
এত ভালোবাসা, সখী, কোন্ হৃদে বলো দেখি—
কোন্ হৃদে ফুটে এত ভাবের কুসুমভার ।।
তা হলে এ হৃদিধামে তোমারি তোমারি নামে
বাজিবে মধুর স্বরে মরমবীণার তার ।
যা-কিছু গাহিব গান ধ্বনিবে তোমারি নাম—
কী আছে কবির বলো, কী তোমারে দিব আর ।।
ভালোবাসিলে যদি সে ভালো না বাসে কেন সে দেখা দিল
ভালোবাসিলে যদি সে ভালো না বাসে কেন সে দেখা দিল ।
মধু অধরের মধুর হাসি প্রাণে কেন বরষিল ।
দাঁড়িয়ে ছিলেম পথের ধারে, সহসা দেখিলেম তারে—
নয়ন দুটি তুলে কেন মুখের পানে চেয়ে গেল ।।
ভিক্ষে দে গো, ভিক্ষে দে
ভিক্ষে দে গো, ভিক্ষে দে ।
দ্বারে দ্বারে বেড়াই ঘুরে, মুখ তুলে কেউ চাইলি নে ।
লক্ষ্মী তোদের সদয় হোন, ধনের উপর বাড়ুক ধন—
আমি একটি মুঠো অন্ন চাই গো, তাও কেন পাই নে ।
ওই রে সূর্য উঠল মাথায়, যে যার ঘরে চলেছে ।
পিপাসাতে ফাটছে ছাতি, চলতে আর যে পারি নে ।
ওরে তোদের অনেক আছে, আরো অনেক হবে—
একটি মুঠো দিবি শুধু আর কিছু চাহি নে ।।
ভুলে ভুলে আজ ভুলময়
ভুলে ভুলে আজ ভুলময় ।
ভুলের লতায় বাতাসের ভুলে
ফুলে ফুলে হোক ফুলময় ।
আনন্দ-ঢেউ ভুলের সাগরে
উছলিয়া হোক কূলময় ।।
মধুঋতু নিত্য হয়ে রইল তোমার মধুর দেশে
মধুঋতু নিত্য হয়ে রইল তোমার মধুর দেশে–
যাওয়া-আসার কান্নাহাসি হাওয়ায় সেথা বেড়ায় ভেসে ।
যায় যে জনা সেই শুধু যায়, ফুল ফোটা তো ফুরোয় না হায়–
ঝরবে যে ফুল সেই কেবলই ঝরে পড়ে বেলাশেষে ।।
যখন আমি ছিলেম কাছে তখন কত দিয়েছি গান–
এখন আমার দূরে যাওয়া, এরও কি গো নাই কোনো দান ।
পুষ্পবনের ছায়ায় ঢেকে এই আশা তাই গেলেম রেখে–
আগুন-ভরা ফাগুনকে তোর কাঁদায় যেন আষাঢ় এসে ।।
রাগ: অজ্ঞাত
তাল: অজ্ঞাত
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): 1322
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): 1916
মধুর মিলন। হাসিতে মিলেছে হাসি, নয়নে নয়ন
মধুর মিলন।
হাসিতে মিলেছে হাসি, নয়নে নয়ন।।
মরমর মৃদু বাণী মরমর মরমে,
কপোলে মিলায় হাসি সুমধুর শরমে— নয়নে স্বপন।।
তারাগুলি চেয়ে আছে, কুসুম গাছে গাছে—
বাতাস চুপিচুপি ফিরিছে কাছে কাছে।
মালাগুলি গেঁথে নিয়ে, আড়ালে লুকাইয়ে
সখীরা নেহারিছে দোঁহার আনন—
হেসে আকুল হল বকুলকানন, আ মরি মরি ।।
মা আমার, কেন তোরে ম্লান নেহারি
মা আমার, কেন তোরে ম্লান নেহারি—
আঁখি ছলছল, আহা।
ফুলবনে সখী-সনে খেলিতে খেলিতে হাসি হাসি দে রে করতারি।।
আয় রে বাছা, আয় রে কাছে আয়।
দু দিন রহিবি, দিন ফুরায়ে যায়—
কেমনে বিদায় দেব’ হাসিমুখ না হেরি।।
যখন দেখা দাও নি, রাধা, তখন বেজেছিল বাঁশি
যখন দেখা দাও নি, রাধা, তখন বেজেছিল বাঁশি !
এখন চোখে চোখে চেয়ে সুর যে আমার গেল ভাসি !
তখন নানা তানের ছলে
ডাক ফিরেছে জলে স্থলে,
এখন আমার সকল কাঁদা রাধার রূপে উঠল হাসি ।।
রাগ: অজ্ঞাত
তাল: অজ্ঞাত
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): 1322
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): 1915
এই গানটি “ঘরে বাইরে” গ্রন্থে আছে
যে ভালোবাসুক সে ভালোবাসুক সজনি লো, আমরা কে
যে ভালোবাসুক সে ভালোবাসুক সজনি লো, আমরা কে !
দীনহীন এই হৃদয় মোদের কাছেও কি কেহ ডাকে ।।
তবে কেন বলো ভেবে মরি মোরা কে কাহারে ভালোবাসে !
আমাদের কিবা আসে যায় বলো কেবা কাঁদে কেবা হাসে !
আমাদের মন কেহই চাহে না, তবে মনখানি লুকানো থাক্—
প্রাণের ভিতরে ঢাকিয়া রাখ্ ।।
যদি, সখী, কেহ ভুলে মনখানি লয় তুলে,
উলটি-পালটি ক্ষণেক ধরিয়া পরখ করিয়া দেখিতে চায়,
তখনি ধূলিতে ছুঁড়িয়া ফেলিবে নিদারুণ উপেখায়।
কাজ কী লো, মন লুকানো থাক্, প্রাণের ভিতরে ঢাকিয়া রাখ্—
হাসিয়া খেলিয়া ভাবনা ভুলিয়া হরষে প্রমোদে মাতিয়া থাক্ ।।
যেখানে রূপের প্রভা নয়ন-লোভা
যেখানে রূপের প্রভা নয়ন-লোভা
সেখানে তোমার মতন ভোলা কে ঠাকুরদাদা ।
যেখানে রসিকসভা পরম-শোভা
সেখানে এমন রসের ঝোলা কে ঠাকুরদাদা ।
যেখানে গলাগলি কোলাকুলি
তোমারি বেচা-কেনা সেই হাটে,
পড়ে না পদধূলি পথ ভুলি
যেখানে ঝগড়া করে ঝগ্ড়াটে ।।
যেখানে ভোলাভুলি খোলাখুলি
সেখানে তোমার মতন খোলা কে ঠাকুরদাদা ।।
যোগী হে, কে তুমি হৃদি-আসনে
যোগী হে, কে তুমি হৃদি-আসনে !
বিভূতিভূষিত শুভ্র দেহ, নাচিছ দিক্-বসনে ।।
মহা-আনন্দে পুলক কায়, গঙ্গা উথলি উছলি যায়,
ভালে শিশুশশী হাসিয়া চায়—
জটাজূট ছায় গগনে ।।
শোন্ রে শোন্ অবোধ মন
শোন্ রে শোন্ অবোধ মন,–
শোন্ সাধুর উক্তি, কিসে মুক্তি সেই সুযুক্তি কর্ গ্রহণ।
ভবের শুক্তি ভেঙে মুক্তিমুক্তা কর্ অন্বেষণ,
ওরে ও ভোলা মন ।।
সখা, সাধিতে সাধাতে কত সুখ
সখা, সাধিতে সাধাতে কত সুখ
তাহা বুঝিলে না তুমি— মনে রয়ে গেল দুখ।।
অভিমান-আঁখিজল, নয়ন ছলছল—
মুছাতে লাগে ভালো কত
তাহা বুঝিলে না তুমি— মনে রয়ে গেল দুখ ।।
সখী, ভাবনা কাহারে বলে। সখী, যাতনা কাহারে বলে
সখী, ভাবনা কাহারে বলে। সখী, যাতনা কাহারে বলে ।
তোমরা যে বলো দিবস-রজনী ‘ভালোবাসা’ ‘ভালোবাসা’—
সখী, ভালোবাসা কারে কয়! সে কি কেবলই যাতনাময় ।
সে কি কেবলই চোখের জল? সে কি কেবলই দুখের শ্বাস ?
লোকে তবে করে কী সুখেরই তরে এমন দুখের আশ ।
আমার চোখে তো সকলই শোভন,
সকলই নবীন, সকলই বিমল, সুনীল আকাশ, শ্যামল কানন,
বিশদ জোছনা, কুসুম কোমল— সকলই আমার মতো ।
তারা কেবলই হাসে, কেবলই গায়, হাসিয়া খেলিয়া মরিতে চায়—
না জানে বেদন, না জানে রোদন, না জানে সাধের যাতনা যত ।
ফুল সে হাসিতে হাসিতে ঝরে, জোছনা হাসিয়া মিলায়ে যায়,
হাসিতে হাসিতে আলোকসাগরে আকাশের তারা তেয়াগে কায় ।
আমার মতন সুখী কে আছে। আয় সখী, আয় আমার কাছে—
সুখী হৃদয়ের সুখের গান শুনিয়া তোদের জুড়াবে প্রাণ ।
প্রতিদিন যদি কাঁদিবি কেবল একদিন নয় হাসিবি তোরা—
একদিন নয় বিষাদ ভুলিয়া সকলে মিলিয়া গাহিব মোরা।।
খী, আর কত দিন সুখহীন শান্তিহীন
সখী, আর কত দিন সুখহীন শান্তিহীন
হা হা করে বেড়াইব নিরাশ্রয় মন লয়ে ।
পারি নে, পারি নে আর— পাষাণ মনের ভার
বহিয়া পড়েছি, সখী, অতি শ্রান্ত ক্লান্ত হয়ে ।
সম্মুখে জীবন মম হেরি মরুভূমিসম,
নিরাশা বুকেতে বসি ফেলিতেছে বিষশ্বাস ।
উঠিতে শকতি নাই যে দিকে ফিরিয়া চাই
শূন্য—শূন্য—মহাশূন্য নয়নেতে পরকাশ ।
কে আছে, কে আছে সখী, এ শ্রান্ত মস্তক মম
বুকেতে রাখিবে ঢাকি যতনে জননীসম ।
মন, যত দিন যায়, মুদিয়া আসিছে হায়—
শুকায়ে শুকায়ে শেষে মাটিতে পড়িবে ঝরি ।।
সাধ ক’রে কেন, সখা, ঘটাবে গেরো
সাধ ক’রে কেন, সখা, ঘটাবে গেরো ।
এই বেলা মানে-মানে ফেরো ফেরো ।
পলক যে নাই আঁখির পাতায়,
তোমার মনটা কি খরচের খাতায়—
হাসি ফাঁসি দিয়ে প্রাণে বেঁধেছে গেরো ।
সখা, ফেরো ফেরো ।।
সে আসি কহিল, ‘প্রিয়ে, মুখ তুলে চাও
সে আসি কহিল, ‘প্রিয়ে, মুখ তুলে চাও।’
দুষিয়া তাহারে রুষিয়া কহিনু, ‘যাও !’
সখী ওলো সখী, সত্য করিয়া বলি, তবু সে গেল না চলি।
দাঁড়ালো সমুখে; কহিনু তাহারে, ‘সরো !’
ধরিল দু হাত; কহিনু, ‘আহা, কী কর !’
সখী ওলো সখী, মিছে না কহিব তোরে, তবু ছাড়িল না মোরে।
শ্রুতিমূলে মুখ আনিল সে মিছিমিছি।
নয়ন বাঁকায়ে কহিনু তাহারে, ‘ছি ছি !’
সখী ওলো সখী, কহি লো শপথ ক’রে তবু সে গেল না স’রে ।
অধরে কপোল পরশ করিল তবু।
কাঁপিয়া কহিনু, ‘এমন দেখি নি কভু।’
সখী ওলো সখী, একি তার বিবেচনা, তবু মুখ ফিরালো না।
আপন মালাটি আমারে পরায়ে দিল।
কহিনু তাহারে, ‘মালায় কী কাজ ছিল !’
সখী ওলো সখী, নাহি তার লাজ ভয়, মিছে তারে অনুনয়।।
আমার মালাটি চলিল গলায় লয়ে।
চাহি তার পানে রহিনু অবাক হয়ে।
সখী ওলো সখী, ভাসিতেছি আঁখিনীরে— কেন সে এল না ফিরে।।
হা-আ-আ-আই
হা-আ-আ-আই।
নাই কাজ নাই।
দিন যায়, দিন যায়।
আয় আয়, আয় আয়।
হাতে কাজ নাই।।
রাগ: পূরবী
তাল: কাহারবা
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): 1340
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): 1933
স্বরলিপিকার: শান্তিদেব ঘোষ
এই গানটি “তাসের দেশ” গ্রন্থে আছে
হৃদয়ে রাখো গো দেবী, চরণ তোমার
হৃদয়ে রাখো গো দেবী, চরণ তোমার ।
এসো মা করুণারানী, ও বিধুবদনখানি
হেরি হেরি আঁখি ভরি হেরিব আবার ।
এসো আদরিনী বাণী, সমুখে আমার ।।
মৃদু মৃদু হাসি হাসি বিলাও অমৃতরাশি,
আলোয় করেছ আলো, জ্যোতিপ্রতিমা—
তুমি গো লাবণ্যলতা, মূর্তি-মধুরিমা ।
বসন্তের বনবালা অতুল রূপের ডালা,
মায়ার মোহিনী মেয়ে ভাবের আধার—
ঘুচাও মনের মোর সকল আঁধার ।।
অদর্শন হলে তুমি ত্যেজি লোকালয়ভূমি
অভাগা বেড়াবে কেঁদে গহনে গহনে ।
হেরে মোরে তরুলতা বিষাদে কবে না কথা,
বিষণ্ণ কুসুমকুল বনফুলবনে ।
‘হা দেবী’ ‘হা দেবী’ বলি গুঞ্জরি কাঁদিবে অলি,
ঝরিবে ফুলের চোখে শিশির-আসার—
হেরিব জগত শুধু আঁধার—আঁধার ।।