এল যে শীতের বেলা বরষ-পরে
এল যে শীতের বেলা বরষ-পরে।
এবার ফসল কাটো, লও গো ঘরে॥
করো ত্বরা, করো ত্বরা, কাজ আছে মাঠ-ভরা–
দেখিতে দেখিতে দিন আঁধার করে॥
বাহিরে কাজের পালা হইবে সারা
আকাশে উঠিবে যবে সন্ধ্যাতারা–
আসন আপন হাতে পেতে রেখো আঙিনাতে
যে সাথি আসিবে রাতে তাহারি তরে॥
এস এস বসন্ত ধরাতলে
এস’ এস’ বসন্ত, ধরাতলে–
আন’ মুহু মুহু নব তান, আন’ নব প্রাণ, নব গান।
আন’ গন্ধমদভরে অলস সমীরণ।
আন’ বিশ্বের অন্তরে অন্তরে নিবিড় চেতনা।
আন’ নব উল্লাসহিল্লোল,
আন’ আন’ আনন্দছন্দের হিন্দোলা ধরাতলে।
ভাঙ’ ভাঙ’ বন্ধনশৃঙ্খল।
আন’ আন’ উদ্দীপ্ত প্রাণের বেদনা ধরাতলে।
এস’ থরথর-কম্পিত মর্মরমুখরিত নবপল্লবপুলকিত
ফুল- আকুল মালতীবল্লিবিতানে– সুখছায়ে মধুবায়ে।
এস’ বিকশিত উন্মুখ, এস’ চিরউৎসুক নন্দনপথচিরযাত্রী।
এস’ স্পন্দিত নন্দিত চিত্তনিলয়ে গানে গানে, প্রাণে প্রাণে।
এস’ অরুণচরণ কমলবরন তরুণ উষার কোলে।
এস’ জ্যোৎস্নাবিবশ নিশীথে, কলকল্লোল তটিনী-তীরে,
সুখ- সুপ্ত সরসী-নীরে। এস’ এস’।
এস’ তড়িৎ-শিখা-সম ঝঞ্ঝাচরণে সিন্ধুতরঙ্গদোলে।
এস’ জাগরমুখর প্রভাতে।
এস’ নগরে প্রান্তরে বনে।
এস’ কর্মে বচনে মনে। এস’ এস’।
এস’ মঞ্জীরগুঞ্জর চরণে।
এস’ গীতমুখর কলকণ্ঠে।
এস’ মঞ্জুল মল্লিকামাল্যে।
এস’ কোমল কিশলয়বসনে।
এস’ সুন্দর, যৌবনবেগে।
এস’ দৃপ্ত বীর, নব তেজে।
ওহে দুর্মদ, করো জয়যাত্রা,
চল’ জরাপরাভব-সমরে
পবনে কেশররেণু ছড়ায়ে,
চঞ্চল কুন্তল উড়ায়ে॥
এসে শরতের অমল মহিমা
এসে শরতের অমল মহিমা, এসো হে ধীরে।
চিত্ত বিকাশিবে চরণ ঘিরে॥
বিরহতরঙ্গে অকূলে সে দোলে
দিবাযামিনী আকুল সমীরে॥
এসেছিনু দ্বারে তব শ্রাবণরাতে
এসেছিনু দ্বারে তব শ্রাবণরাতে,
প্রদীপ নিভালে কেন অঞ্চলঘাতে॥
অন্তরে কালো ছায়া পড়ে আঁকা
বিমুখ মুখের ছবি মনে রয় ঢাকা,
দুঃখের সাথি তারা ফিরিছে সাথে॥
কেন দিলে না মাধুরীকণা, হায় রে কৃপণা।
লাবণ্যলক্ষ্মী বিরাজে, ভুবনমাঝে,
তারি লিপি দিলে না হাতে॥
এসেছিলে তবু আস নাই জানায়ে গেলে
এসেছিলে তবু আস নাই জানায়ে গেলে
সমুখের পথ দিয়ে পলাতকা ছায়া ফেলে॥
তোমার সে উদাসীনতা সত্য কিনা জানি না সে,
চঞ্চল চরণ গেল ঘাসে ঘাসে বেদনা মেলে॥
তখন পাতায় পাতায় বিন্দু বিন্দু ঝরে জল,
শ্যামল বনান্তভূমি করে ছলোছল্।
তুমি চলে গেছ ধীরে ধীরে সিক্ত সমীরে,
পিছনে নীপবীথিকায় রৌদ্রছায়া যায় খেলে॥
এসো এসো এসো হে বৈশাখ
এসো, এসো, এসো হে বৈশাখ।
তাপসনিশ্বাসবায়ে মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে,
বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক॥
যাক পুরাতন স্মৃতি, যাক ভুলে-যাওয়া গীতি,
অশ্রুবাষ্প সুদূরে মিলাক॥
মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা,
অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা।
রসের আবেশরাশি শুষ্ক করি দাও আসি,
আনো আনো আনো তব প্রলয়ের শাঁখ।
মায়ার কুজ্ঝটিজাল যাক দূরে যাক॥
এসো এসো হে তৃষ্ণার জল
এসো এসো হে তৃষ্ণার জল, কলকল্ ছলছল্–
ভেদ করো কঠিনের ক্রূর বক্ষতল কলকল্ ছলছল্॥
এসো এসো উৎসস্রোতে গূঢ় অন্ধকার হতে
এসো হে নির্মল কলকল্ ছলছল্॥
রবিকর রহে তব প্রতীক্ষায়।
তুমি যে খেলার সাথি, সে তোমারে চায়।
তাহারি সোনার তান তোমাতে জাগায় গান,
এসো হে উজ্জ্বল, কলকল্ ছলছল্॥
হাঁকিছে অশান্ত বায়,
‘আয়, আয়, আয়।’ সে তোমায় খুঁজে যায়।
তাহার মৃদঙ্গরবে করতালি দিতে হবে,
এসো হে চঞ্চল, কলকল্ ছলছল্॥
মরুদৈত্য কোন্ মায়াবলে
তোমারে করেছে বন্দী পাষাণশৃঙ্খলে।
ভেঙে ফেলে দিয়ে কারা এসো বন্ধহীন ধারা,
এসো হে প্রবল, কলকল্ ছলছল্॥
এসো গো জ্বেলে দিয়ে যাও প্রদীপখানি
এসো গো, জ্বেলে দিয়ে যাও প্রদীপখানি
বিজন ঘরের কোণে, এসো গো।
নামিল শ্রাবণসন্ধ্যা, কালো ছায়া ঘনায় বনে বনে॥
আনো বিস্ময় মম নিভৃত প্রতীক্ষায় যূথীমালিকার মৃদু গন্ধে–
নীলবসন-অঞ্চল-ছায়া
সুখরজনী-সম মেলুক মনে॥
হারিয়ে গেছে মোর বাঁশি,
আমি কোন্ সুরে ডাকি তোমারে।
পথে চেয়ে-থাকা মোর দৃষ্টিখানি
শুনিতে পাও কি তাহার বাণী–
কম্পিত বক্ষের পরশ মেলে কি সজল সমীরণে॥
এসো নীপবনে ছায়াবীথিতলে
এসো নীপবনে ছায়াবীথিতলে, এসো করো স্নান নবধারাজলে॥
দাও আকুলিয়া ঘন কালো কেশ, পরো দেহ ঘেরি মেঘনীল বেশ–
কাজলনয়নে, যূথীমালা গলে, এসো নীপবনে ছায়াবীথিতলে॥
আজি ক্ষণে ক্ষণে হাসিখানি, সখী, অধরে নয়নে উঠুক চমকি।
মল্লারগানে তব মধুস্বরে দিক্ বাণী আনি বনমর্মরে।
ঘনবরিষনে জলকলকলে এসো নীপবনে ছায়াবীথিতলে॥
এসো শ্যামল সুন্দর
এসো শ্যামল সুন্দর,
আনো তব তাপহরা তৃষাহরা সঙ্গসুধা।
বিরহিণী চাহিয়া আছে আকাশে॥
সে যে ব্যথিত হৃদয় আছে বিছায়ে
তমালকুঞ্জপথে সজল ছায়াতে,
নয়নে জাগিছে করুণ রাগিণী॥
বকুলমুকুল রেখেছে গাঁথিয়া,
বাজিছে অঙ্গনে মিলনবাঁশরি।
আনো সাথে তোমার মন্দিরা
চঞ্চল নৃত্যের বাজিবে ছন্দে সে–
বাজিবে কঙ্কণ, বাজিবে কিঙ্কিণী,
ঝঙ্কারিবে মঞ্জীর রুণু রুণু॥
এসো হে এসো সজল ঘন বাদলবরিষনে
এসো হে এসো সজল ঘন বাদলবরিষনে–
বিপুল তব শ্যামল স্নেহে এসো হে এ জীবনে॥
এসো হে গিরিশিখর চুমি, ছায়ায় ঘিরি কাননভূমি–
গগন ছেয়ে এসো হে তুমি গভীর গরজনে॥
ব্যথিয়া উঠে নীপের বন পুলক-ভরা ফুলে,
উছলি উঠে কলরোদন নদীর কূলে কূলে।
এসো হে এসো হৃদয়-ভরা, এসো হে এসো পিপাসাহরা,
এসো হে আঁখি-শীতল-করা, ঘনায়ে এসো মনে॥