একলা বসে বাদল-শেষে শুনি কত কী
একলা বসে বাদল-শেষে শুনি কত কী–
‘এবার আমার গেল বেলা’ বলে কেতকী॥
বৃষ্টি-সারা মেঘ যে তারে ডেকে গেল আকাশপারে,
তাই তো সে যে উদাস হল– নইলে যেত কি॥
ছিল সে যে একটি ধারে বনের কিনারায়,
উঠত কেঁপে তড়িৎ-আলোর চকিত ইশারায়।
শ্রাবণঘন-অন্ধকারে গন্ধ যেত অভিসারে–
সন্ধ্যাতারা আড়াল থেকে খবর পেত কি॥
একি গভীর বাণী এল ঘন মেঘের আড়াল ধ’রে
একি গভীর বাণী এল ঘন মেঘের আড়াল ধ’রে
সকল আকাশ আকুল ক’রে॥
সেই বাণীর পরশ লাগে, নবীন প্রাণের বাণী জাগে,
হঠাৎ দিকে দিগন্তরে ধরার হৃদয় ওঠে ভরে॥
সে কে বাঁশি বাজিয়েছিল কবে প্রথম সুরে তালে,
প্রাণেরে ডাক দিয়েছিল সুদূর আঁধার আদিকালে।
তার বাঁশির ধ্বনিখানি আজ আষাঢ় দিল আনি,
সেই অগোচরের তরে আমার হৃদয় নিল হ’রে॥
একি আকুলতা ভুবনে
একি আকুলতা ভুবনে! একি চঞ্চলতা পবনে॥
একি মধুরমদির রসরাশি আজি শূন্যতলে চলে ভাসি,
ঝরে চন্দ্রকরে একি হাসি, ফুল- গন্ধ লুটে গগনে॥
একি প্রাণভরা অনুরাগে আজি বিশ্বজগতজন জাগে,
আজি নিখিল নীলগগনে সুখ- পরশ কোথা হতে লাগে।
সুখে শিহরে সকল বনরাজি, উঠে মোহনবাঁশরি বাজি,
হেরো পূর্ণবিকশিত আজি মম অন্তর সুন্দর স্বপনে॥
একি মায়া লুকাও কায়া জীর্ণ শীতের সাজে
একি মায়া, লুকাও কায়া জীর্ণ শীতের সাজে।
আমার সয় না, সয় না, সয় না প্রাণে, কিছুতে সয় না যে॥
কৃপণ হয়ে হে মহারাজ, রইবে কি আজ
আপন ভুবন-মাঝে॥
বুঝতে নারি বনের বীণা তোমার প্রসাদ পাবে কিনা,
হিমের হাওয়ায় গগন-ভরা ব্যাকুল রোদন বাজে॥
কেন মরুর পারে কাটাও বেলা রসের কাণ্ডারী।
লুকিয়ে আছে কোথায় তোমার রূপের ভাণ্ডারী।
রিক্তপাতা শুষ্ক শাখে কোকিল তোমার কই গো ডাকে–
শূন্য সভা, মৌন বাণী, আমরা মরি লাজে॥
এতদিন যে বসেছিলেম পথ চেয়ে আর কাল গুনে
এতদিন যে বসেছিলেম পথ চেয়ে আর কাল গুনে
দেখা পেলেম ফাল্গুনে॥
বালক বীরের বেশে তুমি করলে বিশ্বজয়–
এ কী গো বিস্ময়।
অবাক আমি তরুণ গলার গান শুনে॥
গন্ধে উদাস হাওয়ার মতো উড়ে তোমার উত্তরী,
কর্ণে তোমার কৃষ্ণচূড়ার মঞ্জরী।
তরুণ হাসির আড়ালে কোন্ আগুন ঢাকা রয়–
এ কী গো বিস্ময়।
অস্ত্র তোমার গোপন রাখ কোন্ তূণে॥
এনেছ ওই শিরীষ বকুল আমের মুকুল
এনেছ ওই শিরীষ বকুল আমের মুকুল সাজিখানি হাতে করে।
কবে যে সব ফুরিয়ে দেবে, চলে যাবে দিগন্তরে॥
পথিক, তোমায় আছে জানা, করব না গো তোমায় মানা–
যাবার বেলায় যেয়ো যেয়ো বিজয়মালা মাথায় প’রে॥
তবু তুমি আছ যতক্ষণ
অসীম হয়ে ওঠে হিয়ায় তোমারি মিলন।
যখন যাবে তখন প্রাণে বিরহ মোর ভরবে গানে–
দূরের কথা সুরে বাজে সকল বেলা ব্যথায় ভ’রে॥
এবার অবগুণ্ঠন খোলো
এবার অবগুণ্ঠন খোলো।
গহন মেঘমায়ায় বিজন বনছায়ায়
তোমার আলসে অবলুণ্ঠন সারা হল॥
শিউলিসুরভি রাতে বিকশিত জ্যোৎস্নাতে
মৃদু মর্মরগানে তব মর্মের বাণী বোলো ॥
বিষাদ-অশ্রুজলে মিলুক শরমহাসি–
মালতীবিতানতলে বাজুক বঁধুর বাঁশি।
শিশিরসিক্ত বায়ে বিজড়িত আলোছায়ে
বিরহ-মিলনে-গাঁথা নব প্রণয়দোলায় দোলো ॥
এবার বিদায়বেলার সুর ধরো ধরো
এবার বিদায়বেলার সুর ধরো ধরো, ও চাঁপা, ও করবী!
তোমার শেষ ফুলে আজ সাজি ভরো॥
যাবার পথে আকাশতলে মেঘ রাঙা হল চোখের জলে,
ঝরে পাতা ঝরো ঝরো॥
হেরো হেরো ওই রুদ্র রবি
স্বপ্ন ভাঙায় রক্তছবি।
খেয়াতরীর রাঙা পালে আজ লাগল হাওয়া ঝড়ের তালে,
বেণুবনের ব্যাকুল শাখা থরোথরো॥
এবার ভাসিয়ে দিতে হবে আমার এই তরী
এবার ভাসিয়ে দিতে হবে আমার এই তরী–
তীরে ব’সে যায় যে বেলা, মরি গো মরি॥
ফুল-ফোটানো সারা ক’রে বসন্ত যে গেল স’রে,
নিয়ে ঝরা ফুলের ডালা বলো কী করি।
জল উঠেছে ছল্ছলিয়ে, ঢেউ উঠেছে দুলে,
মর্মরিয়ে ঝরে পাতা বিজন তরুমূলে।
শূন্যমনে কোথায় তাকাস।
ওরে, সকল বাতাস সকল আকাশ
আজি ওই পারের ওই বাঁশির সুরে উঠে শিহরি॥
এবার এল সময় রে তোর শুক্নো-পাতা-ঝরা
এবার এল সময় রে তোর শুক্নো-পাতা-ঝরা–
যায় বেলা যায়, রৌদ্র হল খরা ॥
অলস ভ্রমর ক্লান্তপাখা মলিন ফুলের দলে
অকারণে দোল দিয়ে যায় কোন্ খেয়ালের ছলে।
স্তব্ধ বিজন ছায়াবীথি
বনের-ব্যথা-ভরা ॥
মনের মাঝে গান থেমেছে, সুর নাহি আর লাগে–
শ্রান্ত বাঁশি আর তো নাহি জাগে।
যে গেঁথেছে মালাখানি সে গিয়েছে ভুলে,
কোন্কালে সে পারে গেল সুদূর নদীকূলে।
রইল রে তোর অসীম আকাশ,
অবাধপ্রসার ধরা ॥
এবার তো যৌবনের কাছে মেনেছ
এবার তো যৌবনের কাছে মেনেছ, হার মেনেছ?
‘মেনেছি’।
আপন-মাঝে নূতনকে আজ জেনেছ?
‘জেনেছি’॥
আবরণকে বরণ করে ছিলে কাহার জীর্ণ ঘরে।
আপনাকে আজ বাহির করে এনেছ?
‘এনেছি’॥
এবার আপন প্রাণের কাছে মেনেছ, হার মেনেছ?
‘মেনেছি’।
মরণ মাঝে অমৃতকে জেনেছ?
‘জেনেছি’।
লুকিয়ে তোমার অমরপুরী ধুলা-অসুর করে চুরি,
তাহারে আজ মরণ-আঘাত হেনেছ?
‘হেনেছি’॥
এবেলা ডাক পড়েছে কোন্খানে
এবেলা ডাক পড়েছে কোন্খানে
ফাগুনের ক্লান্ত ক্ষণের শেষ গানে।
সেখানে স্তব্ধ বীণার তারে তারে সুরের খেলা ডুবসাঁতারে–
সেখানে চোখ মেলে যার পাই নে দেখা
তাহারে মন জানে গো, মন জানে॥
এবেলা মন যেতে চায় কোন্খানে
নিরালায় লুপ্ত পথের সন্ধানে।
সেখানে মিলনদিনের ভোলা হাসি লুকিয়ে বাজায় করুণ বাঁশি,
সেখানে যে কথাটি হয় না বলা সে কথা রয় কানে গো, রয় কানে॥