আলোর অমল কমলখানি কে ফুটালে
আলোর অমল কমলখানি কে ফুটালে,
নীল আকাশের ঘুম ছুটালে॥
আমার মনের ভাব্নাগুলি বাহির হল পাখা তুলি,
ওই কমলের পথে তাদের সেই জুটালে॥
শরতবাণীর বীণা বাজে কমলদলে।
ললিত রাগের সুর ঝরে তাই শিউলিতলে।
তাই তো বাতাস বেড়ায় মেতে কচি ধানের সবুজ ক্ষেতে,
বনের প্রাণে মর্মরানির ঢেউ উঠালে॥
আষাঢ় কোথা হতে আজ পেলি ছাড়া
আষাঢ়, কোথা হতে আজ পেলি ছাড়া।
মাঠের শেষে শ্যামল বেশে ক্ষণেক দাঁড়া ॥
জয়ধ্বজা ওই-যে তোমার গগন জুড়ে।
পুব হতে কোন্ পশ্চিমেতে যায় রে উড়ে,
নাচের নেশা লাগল তালের পাতায় পাতায়,
হাওয়ার দোলায় দোলায় শালের বনকে মাতায়।
আকাশ হতে আকাশে কার ছুটোছুটি,
বনে বনে মেঘের ছায়ায় লুটোপুটি–
ভরা নদীর ঢেউয়ে ঢেউয়ে কে দেয় নাড়া ॥
আষাঢ়সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল গেল রে দিন বয়ে
আষাঢ়সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল, গেল রে দিন বয়ে।
বাঁধন-হারা বৃষ্টিধারা ঝরছে রয়ে রয়ে॥
একলা বসে ঘরের কোণে কী ভাবি যে আপন-মনে,
সজল হাওয়া যূথীর বনে কী কথা যায় কয়ে॥
হৃদয়ে আজ ঢেউ দিয়েছে, খুঁজে না পাই কূল;
সৌরভে প্রাণ কাঁদিয়ে তোলে ভিজে বনের ফুল।
আঁধার রাতে প্রহরগুলি কোন্ সুরে আজ ভরিয়ে তুলি,
কোন্ ভুলে আজ সকল ভুলি আছি আকুল হয়ে॥
আহ্বান আসিল মহোৎসবে
আহ্বান আসিল মহোৎসবে
অম্বরে গম্ভীর ভেরিরবে॥
পূর্ববায়ু চলে ডেকে শ্যামলের অভিষেকে–
অরণ্যে অরণ্যে নৃত্য হবে॥
নির্ঝরকল্লোল-কলকলে
ধরণীর আনন্দ উচ্ছলে।
শ্রাবণের বীণাপাণি মিলালো বর্ষণবাণী
কদম্বের পল্লবে পল্লবে॥
উতল-ধারা বাদল ঝরে
উতল-ধারা বাদল ঝরে। সকল বেলা একা ঘরে॥
সজল হাওয়া বহে বেগে, পাগল নদী ওঠে জেগে,
আকাশ ঘেরে কাজল মেঘে, তমালবনে আঁধার করে॥
ওগো বঁধু দিনের শেষে এলে তুমি কেমন বেশে–
আঁচল দিয়ে শুকাব জল, মুছাব পা আকুল কেশে।
নিবিড় হবে তিমির-রাতি, জ্বেলে দেব প্রেমের বাতি,
পরানখানি দেব পাতি– চরণ রেখো তাহার ‘পরে॥
ভুলে গিয়ে জীবন মরণ লব তোমায় ক’রে বরণ–
করিব জয় শরম-ত্রাসে, দাঁড়াব আজ তোমার পাশে–
বাঁধন বাধা যাবে জ্ব’লে সুখ দুঃখ দেব দ’লে,
ঝড়ের রাতে তোমার সাথে বাহির হব অভয়ভরে॥
উতল-ধারা বাদল ঝরে, দুয়ার খুলে এলে ঘরে।
চোখে আমার ঝলক লাগে, সকল মনে পুলক জাগে,
চাহিতে চাই মুখের বাগে– নয়ন মেলে কাঁপি ডরে॥
এই মৌমাছিদের ঘরছাড়া কে করেছে রে
এই মৌমাছিদের ঘরছাড়া কে করেছে রে
তোরা আমায় ব’লে দে ভাই, ব’লে দে রে॥
ফুলের গোপন পরান-মাঝে নীরব সুরে বাঁশি বাজে–
ওদের সেই সুরেতে কেমনে মন হরেছে রে॥
যে মধুটি লুকিয়ে আছে, দেয় না ধরা কারো কাছে,
সেই মধুতে কেমনে মন ভরেছে রে॥
এই সকাল বেলার বাদল-আঁধারে
এই সকাল বেলার বাদল-আঁধারে
আজি বনের বীণায় কী সুর বাঁধা রে॥
ঝরো ঝরো বৃষ্টিকলরোলে তালের পাতা মুখর ক’রে তোলে রে,
উতল হাওয়া বেণুশাখায় লাগায় ধাঁদা রে॥
ছায়ার তলে তলে জলের ধারা ওই
হেরো দলে দলে নাচে তাথৈ থৈ– তাথৈ থৈ।
মন যে আমার পথ-হারানো সুরে সকল আকাশ বেড়ায় ঘুরে ঘুরে রে,
শোনে যেন কোন্ ব্যাকুলের করুণ কাঁদা রে॥
এই কথাটাই ছিলেম ভুলে
এই কথাটাই ছিলেম ভুলে–
মিলব আবার সবার সাথে ফাল্গুনের এই ফুলে ফুলে॥
অশোক বনে আমার হিয়া ওগো নূতন পাতায় উঠবে জিয়া,
বুকের মাতন টুটবে বাঁধন যৌবনেরই কূলে কূলে
ফাল্গুনের এই ফুলে ফুলে॥
বাঁশিতে গান উঠবে পূরে
নবীন-রবির-বাণী-ভরা আকাশবীণার সোনার সুরে।
আমার মনের সকল কোণে ওগো ভরবে গগন আলোক-ধনে,
কান্নাহাসির বন্যারই নীর উঠবে আবার দুলে দুলে
ফাল্গুনের এই ফুলে ফুলে॥
এই শ্রাবণ-বেলা বাদল-ঝরা
এই শ্রাবণ-বেলা বাদল-ঝরা যূথীবনের গন্ধে ভরা ॥
কোন্ ভোলা দিনের বিরহিনী, যেন তারে চিনি চিনি–
ঘন বনের কোণে কোণে ফেরে ছায়ার-ঘোমটা-পরা ॥
কেন বিজন বাটের পানে তাকিয়ে আছি কে তা জানে।
হঠাৎ কখন অজানা সে আসবে আমার দ্বারের পাশে,
বাদল-সাঁঝের আঁধার-মাঝে গান গাবে প্রাণ-পাগল করা ॥
এই শ্রাবণের বুকের ভিতর আগুন আছে
এই শ্রাবণের বুকের ভিতর আগুন আছে।
সেই আগুনের কালোরূপ যে আমার চোখের ‘পরে নাচে॥
ও তার শিখার জটা ছড়িয়ে পড়ে দিক হতে ওই দিগন্তরে,
তার কালো আভার কাঁপন দেখো তালবনের ওই গাছে গাছে॥
বাদল-হাওয়া পাগল হল সেই আগুনের হুহুঙ্কারে।
দুন্দুভি তার বাজিয়ে বেড়ায় মাঠ হতে কোন্ মাঠের পারে।
ওরে, সেই আগুনের পুলক ফুটে কদম্ববন রঙিয়ে উঠে,
সেই আগুনের বেগ লাগে আজ আমার গানের পাখার পাছে॥
এক ফাগুনের গান সে আমার
এক ফাগুনের গান সে আমার আর ফাগুনের কূলে কূলে
কার খোঁজে আজ পথ হারালো নতুন কালের ফুলে ফুলে॥
শুধায় তারে বকুল-হেনা, ‘কেউ আছে কি তোমার চেনা।’
সে বলে, ‘হায় আছে কি নাই
না বুঝে তাই বেড়াই ভুলে
নতুন কালের ফুলে ফুলে।’
এক ফাগুনের মনের কথা আর ফাগুনের কানে কানে
গুঞ্জরিয়া কেঁদে শুধায়, ‘মোর ভাষা আর কেই বা জানে।’
আকাশ বলে, ‘কে জানে সে কোন্ ভাষা যে বেড়ায় ভেসে।’
‘হয়তো জানি’ ‘হয়তো জানি’
বাতাস বলে দুলে দুলে
নতুন কালের ফুলে ফুলে॥
একটুকু ছোঁওয়া লাগে
একটুকু ছোঁওয়া লাগে, একটুকু কথা শুনি–
তাই দিয়ে মনে মনে রচি মম ফাল্গুনী।
কিছু পলাশের নেশা, কিছু বা চাঁপায় মেশা,
তাই দিয়ে সুরে সুরে রঙে রসে জাল বুনি॥
যেটুকু কাছেতে আসে ক্ষণিকের ফাঁকে ফাঁকে
চকিত মনের কোণে স্বপনের ছবি আঁকে।
যেটুকু যায় রে দূরে ভাবনা কাঁপায় সুরে,
তাই নিয়ে যায় বেলা নূপুরের তাল গুনি॥