» আমার নয়ন-ভুলানো এলে
আমার নয়ন-ভুলানো এলে,
আমি কী হেরিলাম হৃদয় মেলে॥
শিউলিতলার পাশে পাশে ঝরা ফুলের রাশে রাশে
শিশির-ভেজা ঘাসে ঘাসে অরুণরাঙা চরণ ফেলে
নয়ন-ভুলানো এলে॥
আলোছায়ার আঁচলখানি লুটিয়ে পড়ে বনে বনে,
ফুলগুলি ওই মুখে চেয়ে কী কথা কয় মনে মনে॥
তোমায় মোর করব বরণ, মুখের ঢাকা করো হরণ,
ওইটুকু ওই মেঘাবরণ দু হাত দিয়ে ফেলো ঠেলে॥
বনদেবীর দ্বারে দ্বারে শুনি গভীর শঙ্খধ্বনি,
আকাশবীণার তারে তারে জাগে তোমার আগমনী।
কোথায় সোনার নূপুর বাজে, বুঝি আমার হিয়ার মাঝে
সকল ভাবে সকল কাজে পাষাণ-গালা সুধা ঢেলে–
নয়ন-ভুলানো এলে॥
আমার রাত পোহালো শারদ প্রাতে
আমার রাত পোহালো শারদ প্রাতে।
বাঁশি, তোমায় দিয়ে যাব কাহার হাতে।
তোমার বুকে বাজল ধ্বনি
বিদায়গাথা, আগমনী, কত যে–
ফাল্গুনে শ্রাবণে, কত প্রভাতে রাতে॥
যে কথা রয় প্রাণের ভিতর অগোচরে
গানে গানে নিয়েছিলে চুরি করে।
সময় যে তার হল গত
নিশিশেষের তারার মতো–
শেষ করে দাও শিউলিফুলের মরণ-সাথে॥
আমার মালার ফুলের দলে আছে লেখা
আমার মালার ফুলের দলে আছে লেখা বসন্তের মন্ত্রলিপি।
এর মাধুর্যে আছে যৌবনের আমন্ত্রণ।
সাহানা রাগিণী এর রাঙা রঙে রঞ্জিত,
মধুকরের ক্ষুধা অশ্রুত ছন্দে গন্ধে তার গুঞ্জরে॥
আন্ গো ডালা গাঁথ্ গো মালা,
আন্ মাধবী মালতী অশোকমঞ্জরী, আয় তোরা আয়।
আন্ করবী রঙ্গন কাঞ্চন রজনীগন্ধা প্রফুল্লমল্লিকা, আয় তোরা আয়।
মালা পর্ গো মালা পর্ সুন্দরী–
ত্বরা কর্ গো ত্বরা কর্।
আজি পূর্ণিমা রাতে জাগিছে চন্দ্রমা,
বকুলকুঞ্জ দক্ষিণবাতাসে দুলিছে কাঁপিছে
থরোথরো মৃদু মর্মরি।
নৃত্যপরা বনাঙ্গনা বনাঙ্গনে সঞ্চরে,
চঞ্চলিত চরণ ঘেরি মঞ্জীর তার গুঞ্জরে আহা।
দিস নে মধুরাতি বৃথা বহিয়ে উদাসিনী, হায় রে।
শুভলগন গেলে চলে ফিরে দেবে না ধরা–
সুধাপসরা ধুলায় দেবে শূন্য করি, শুকাবে বঞ্জুলমঞ্জরী।
চন্দ্রকরে অভিষিক্ত নিশীথে ঝিল্লিমুখর বনছায়ে
তন্দ্রাহারাপিকবিরহকাকলি-কূজিত দক্ষিণবায়ে
মালঞ্চ মোর ভরল ফুলে ফুলে ফুলে গো,
কিংশুকশাখা চঞ্চল হল দুলে দুলে দুলে গো॥
আমারে যদি জাগালে আজি নাথ
আমারে যদি জাগালে আজি নাথ,
ফিরো না তবে ফিরো না, করো করুণ আঁখিপাত॥
নিবিড় বন-শাখার ‘পরে আষাঢ়-মেঘে বৃষ্টি ঝরে,
বাদল-ভরা আলস-ভরে ঘুমায়ে আছে রাত॥
বিরামহীন বিজুলিঘাতে নিদ্রাহারা প্রাণ
বরষাজলধারার সাথে গাহিতে চাহে গান।
হৃদয় মোর চোখের জলে বাহির হল তিমিরতলে,
আকাশ খোঁজে ব্যাকুল বলে বাড়ায়ে দুই হাত॥
আমি তখন ছিলেম মগন গহন ঘুমের ঘোরে
আমি তখন ছিলেম মগন গহন ঘুমের ঘোরে
যখন বৃষ্টি নামল তিমিরনিবিড় রাতে।
দিকে দিকে সঘন গগন মত্ত প্রলাপে প্লাবন-ঢালা শ্রাবণধারাপাতে
সে দিন তিমিরনিবিড় রাতে॥
আমার স্বপ্নস্বরূপ বাহির হয়ে এল, সে যে সঙ্গ পেল
আমার সুদূর পারের স্বপ্নদোসর-সাথে
সে দিন তিমিরনিবিড় রাতে॥
আমার দেহের সীমা গেল পারায়ে– ক্ষুব্ধ বনের মন্দ্ররবে গেল হারায়ে।
মিলে গেল কুঞ্জবীথির সিক্ত যূথীর গন্ধে মত্তহাওয়ার ছন্দে,
মেঘে মেঘে তড়িৎশিখার ভুজঙ্গপ্রয়াতে সে দিন তিমিরনিবিড় রাতে॥
আমি পথভোলা এক পথিক এসেছি
‘আমি পথভোলা এক পথিক এসেছি।
সন্ধ্যাবেলার চামেলি গো, সকালবেলার মল্লিকা
আমায় চেন কি।’
‘চিনি তোমায় চিনি, নবীন পান্থ–
বনে বনে ওড়ে তোমার রঙিন বসনপ্রান্ত।
ফাগুন প্রাতের উতলা গো, চৈত্র রাতের উদাসী
তোমার পথে আমরা ভেসেছি।’
‘ঘরছাড়া এই পাগলটাকে এমন ক’রে কে গো ডাকে
করুণ গুঞ্জরি,
যখন বাজিয়ে বীণা বনের পথে বেড়াই সঞ্চরি।’
‘আমি তোমায় ডাক দিয়েছি ওগো উদাসী,
আমি আমের মঞ্জরী।
তোমায় চোখে দেখার আগে তোমার স্বপন চোখে লাগে,
বেদন জাগে গো–
না চিনিতেই ভালো বেসেছি।’
যখন ফুরিয়ে বেলা চুকিয়ে খেলা তপ্ত ধুলার পথে
যাব ঝরা ফুলের রথে–
তখন সঙ্গ কে লবি’
‘লব আমি মাধবী।’
‘যখন বিদায়-বাঁশির সুরে সুরে শুকনো পাতা যাবে উড়ে
সঙ্গে কে র’বি।’
‘আমি রব, উদাস হব ওগো উদাসী,
আমি তরুণ করবী।’
‘বসন্তের এই ললিত রাগে বিদায়-ব্যথা লুকিয়ে জাগে–
ফাগুন দিনে গো
কাঁদন-ভরা হাসি হেসেছি।
আমি শ্রাবণ-আকাশে ওই দিয়েছি পাতি
আমি শ্রাবণ-আকাশে ওই দিয়েছি পাতি
মম জল-ছলো-ছলো আঁখি মেঘে মেঘে।
বিরহদিগন্ত পারায়ে সারা রাতি অনিমেষে আছে জেগে॥
যে গিয়েছে দেখার বাহিরে আছে তারি উদ্দেশে চাহি রে,
স্বপ্নে উড়িছে তারি কেশরাশি পুরবপবনবেগে॥
শ্যামল তমালবনে
যে পথে সে চলে গিয়েছিল বিদায়গোধূলি-খনে
বেদনা জড়ায়ে আছে তারি ঘাসে, কাঁপে নিশ্বাসে–
সেই বারে বারে ফিরে ফিরে চাওয়া ছায়ায় রয়েছে লেগে॥
আমি কী গান গাব যে ভেবে না পাই
আমি কী গান গাব যে ভেবে না পাই–
মেঘলা আকাশে উতলা বাতাসে খুঁজে বেড়াই॥
বনের গাছে গাছে জেগেছে ভাষা ভাষাহারা নাচে–
মন ওদের কাছে চঞ্চলতার রাগিণী যাচে,
সারাদিন বিরামহীন ফিরি যে তাই॥
আমার অঙ্গে সুরতরঙ্গে ডেকেছে বান,
রসের প্লাবনে ডুবিয়া যাই।
কী কথা রয়েছে আমার মনের ছায়াতে
স্বপ্নপ্রদোষে– আমি তারে যে চাই॥
আর নাই যে দেরি
আর নাই যে দেরি, নাই যে দেরি।
সামনে সবার পড়ল ধরা তুমি যে, ভাই, আমাদেরই॥
হিমের বাহু-বাঁধন টুটি পাগ্লা-ঝোরা পাবে ছুটি,
উত্তরে এই হাওয়া তোমার বইবে উজান কুঞ্জ ঘেরি॥
নাই যে দেরি নাই যে দেরি।
শুনছ না কি জলে স্থলে জাদুকরের বাজল ভেরী।
দেখছ না কি এই আলোকে খেলছে হাসি রবির চোখে–
সাদা তোমার শ্যামল হবে, ফিরব মোরা তাই যে হেরি॥