আজি দখিন-দুয়ার খোলা
আজি দখিন-দুয়ার খোলা,
এসো হে, এসো হে, এসো হে আমার বসন্ত এসো।
দিব হৃদয়দোলায় দোলা,
এসো হে, এসো হে, এসো হে আমার বসন্ত এসো॥
নব শ্যামল শোভন রথে এসো বকুল-বিছানো পথে,
এসো বাজায়ে ব্যাকুল বেণু মেখে পিয়ালফুলের রেণু,
এসো হে, এসো হে, এসো হে আমার বসন্ত এসো॥
এসো ঘনপল্লবপুঞ্জে এসো হে, এসো হে, এসো হে।
এসো বনমল্লিকাকুঞ্জে এসো হে, এসো হে, এসো হে।
মৃদু মধুর মদির হেসে এসো পাগল হাওয়ার দেশে,
তোমার উতলা উত্তরীয় তুমি আকাশে উড়ায়ে দিয়ো–
এসো হে, এসো হে, এসো হে আমার বসন্ত, এসো॥
আন্ গো তোরা কার কী আছে
আন্ গো তোরা কার কী আছে,
দেবার হাওয়া বইল দিকে দিগন্তরে–
এই সুসময় ফুরায় পাছে।
কুঞ্জবনের অঞ্জলি যে ছাপিয়ে পড়ে,
পলাশকানন ধৈর্য হারায় রঙের ঝড়ে,
বেণুর শাখা তালে মাতাল পাতার নাচে॥
প্রজাপতি রঙ ভাসালো নীলাম্বরে,
মৌমাছিরা ধ্বনি উড়ায় বাতাস-‘পরে।
দখিন-হাওয়া হেঁকে বেড়ায় “জাগো জাগো’,
দোয়েল কোয়েল গানের বিরাম জানে না গো–
রক্ত রঙের জাগল প্রলাপ অশোক-গাছে॥
আবার শ্রাবণ হয়ে এলে ফিরে
আবার শ্রাবণ হয়ে এলে ফিরে,
মেঘ-আঁচলে নিলে ঘিরে॥
সূর্য হারায়, হারায় তারা আঁধারে পথ হয়-যে হারা,
ঢেউ দিয়েছে নদীর নীরে॥
সকল আকাশ, সকল ধরা বর্ষণেরই-বাণী-ভরা।
ঝরো ঝরো ধারায় মাতি বাজে আমার আঁধার রাতি,
বাজে আমার শিরে শিরে॥
আবার এসেছে আষাঢ় আকাশ ছেয়ে
আবার এসেছে আষাঢ় আকাশ ছেয়ে,
আসে বৃষ্টির সুবাস বাতাস বেয়ে॥
এই পুরাতন হৃদয় আমার আজি পুলকে দুলিয়া উঠিছে আবার বাজি
নূতন মেঘের ঘনিমার পানে চেয়ে॥
রহিয়া রহিয়া বিপুল মাঠের ‘পরে নব তৃণদলে বাদলের ছায়া পড়ে।
‘এসেছে এসেছে’ এই কথা বলে প্রাণ, ‘এসেছে এসেছে’ উঠিতেছে এই গান–
নয়নে এসেছে, হৃদয়ে এসেছে ধেয়ে॥
আমরা নূতন প্রাণের চর
আমরা নূতন প্রাণের চর হা হা।
আমরা থাকি পথে ঘাটে, নাই আমাদের ঘর হা হা॥
নিয়ে পক্ক পাতার পুঁজি পালাবে শীত, ভাবছ বুঝি গো?
ও-সব কেড়ে নেব, উড়িয়ে দেব দখিন হাওয়ার ‘পর হা হা॥
তোমায় বাঁধব নূতন ফুলের মালায়
বসন্তের এই বন্দীশালায়।
জীর্ণ জরার ছদ্মরূপে এড়িয়ে যাবে চুপে চুপে?
তোমার সকল ভূষণ ঢাকা আছে, নাই যে অগোচর গো॥
আমরা বেঁধেছি কাশের গুচ্ছ
আমরা বেঁধেছি কাশের গুচ্ছ, আমরা গেঁথেছি শেফালিমালা–
নবীন ধানের মঞ্জরী দিয়ে সাজিয়ে এনেছি ডালা ॥
এসো গো শারদলক্ষ্ণী, তোমার শুভ্র মেঘের রথে,
এসো নির্মল নীলপথে,
এসো ধৌত শ্যামল আলো-ঝলমল-বনগিরিপর্বতে–
এসো মুকুটে পরিয়া শ্বেতশতদল শীতল-শিশির-ঢালা ॥
ঝরা মালতীর ফুলে
আসন বিছানো নিভৃত কুঞ্জে ভরা গঙ্গার কূলে
ফিরিছে মরাল ডানা পাতিবারে তোমার চরণমূলে।
গুঞ্জরতান তুলিয়ো তোমার সোনার বীণার তারে
মৃদুমধু ঝঙ্কারে,
হাসি-ঢালা সুর গলিয়া পড়িবে ক্ষণিক অশ্রুধারে।
রহিয়া রহিয়া যে পরশমণি ঝলকে অলককোণে
পলকের তরে সকরুণ করে বুলায়ো বুলায়ো মনে–
সোনা হয়ে যাবে সকল ভাবনা, আঁধার হইবে আলা ॥
আমার প্রিয়ার ছায়া
আমার প্রিয়ার ছায়া
আকাশে আজ ভাসে, হায় হায়!
বৃষ্টিসজল বিষণ্ন নিশ্বাসে, হায়॥
আমার প্রিয়া মেঘের ফাঁকে ফাঁকে
সন্ধ্যাতারায় লুকিয়ে দেখে কাকে,
সন্ধ্যাদীপের লুপ্ত আলো স্মরণে তার আসে, হায়॥
বারি-ঝরা বনের গন্ধ নিয়া
পরশ-হারা বরণমালা গাঁথে আমার প্রিয়া।
আমার প্রিয়া ঘন শ্রাবণধারায়
আকাশ ছেয়ে মনের কথা হারায়।
আমার প্রিয়ার আঁচল দোলে
নিবিড় বনের শ্যামল উচ্ছ্বাসে, হায়॥
আমার বনে বনে ধরল মুকুল
আমার বনে বনে ধরল মুকুল,
বহে মনে মনে দক্ষিণহাওয়া।
মৌমাছিদের ডানায় ডানায়
যেন উড়ে মোর উৎসুক চাওয়া ॥
গোপন স্বপনকুসুমে কে এমন সুগভীর রঙ দিল এঁকে–
নব কিশলয়শিহরনে ভাবনা আমার হল ছাওয়া ॥
ফাল্গুনপূর্ণিমাতে
এই দিশাহারা রাতে
নিদ্রাবিহীন গানে কোন্ নিরুদ্দেশের পানে
উদ্বেল গন্ধের জোয়ারতরঙ্গে হবে মোর তরণী বাওয়া ॥
আমার মল্লিকাবনে যখন প্রথম ধরেছে কলি
আমার মল্লিকাবনে যখন প্রথম ধরেছে কলি
তোমার লাগিয়া তখনি, বন্ধু, বেঁধেছিনু অঞ্জলি॥
তখনো কুহেলীজালে,
সখা, তরুণী উষার ভালে
শিশিরে শিশিরে অরুণমালিকা উঠিতেছে ছলোছলি॥
এখনো বনের গান, বন্ধু হয় নি তো অবসান–
তবু এখনি যাবে কি চলি।
ও মোর করুণ বল্লিকা,
ও তোর শ্রান্ত মল্লিকা
ঝরো-ঝরো হল, এই বেলা তোর শেষ কথা দিস বলি॥
আমার যে দিন ভেসে গেছে চোখের জলে
আমার যে দিন ভেসে গেছে চোখের জলে
তারি ছায়া পড়েছে শ্রাবণগগনতলে॥
সে দিন যে রাগিণী গেছে থেমে, অতল বিরহে নেমে গেছে থেমে,
আজি পুবের হাওয়ায় হাওয়ায় হায় হায় হায় রে
কাঁপন ভেসে চলে॥
নিবিড় সুখে মধুর দুখে জড়িত ছিল সেই দিন–
দুই তারে জীবনের বাঁধা ছিল বীন।
তার ছিঁড়ে গেছে কবে একদিন কোন্ হাহারবে,
সুর হারায়ে গেল পলে পলে॥
আমার দিন ফুরালো ব্যাকুল বাদলসাঁঝে
আমার দিন ফুরালো ব্যাকুল বাদলসাঁঝে
গহন মেঘের নিবিড় ধারার মাঝে॥
বনের ছায়ায় জলছলছল সুরে
হৃদয় আমার কানায় কানায় পূরে।
খনে খনে ওই গুরুগুরু তালে তালে
গগনে গগনে গভীর মৃদঙ বাজে॥
কোন্ দূরের মানুষ যেন এল আজ কাছে,
তিমির-আড়ালে নীরবে দাঁড়ায়ে আছে।
বুকে দোলে তার বিরহব্যথার মালা
গোপন-মিলন-অমৃতগন্ধ-ঢালা।
মনে হয় তার চরণের ধ্বনি জানি–
হার মানি তার অজানা জনের সাজে॥