আজি এই গন্ধবিধুর সমীরণে
আজি এই গন্ধবিধুর সমীরণে
কার সন্ধানে ফিরি বনে বনে॥
আজি ক্ষুব্ধ নীলাম্বরমাঝে একি চঞ্চল ক্রন্দন বাজে।
সুদূর দিগন্তের সকরুণ সঙ্গীত লাগে মোর চিন্তায় কাজে–
আমি খুঁজি কারে অন্তরে মনে গন্ধবিধুর সমীরণে॥
ওগো, জানি না কী নন্দনরাগে
সুখে উৎসুক যৌবন জাগে।
আজি আম্রমুকুলসৌগন্ধে, নব পল্লবমর্মরছন্দে,
চন্দ্রকিরণসুধাসিঞ্চিত অম্বরে অশ্রুসরস মহানন্দে,
আমি পুলকিত কার পরশনে গন্ধবিধুর সমীরণে॥
আজি কমলমুকুলদল খুলিল
আজি কমলমুকুলদল খুলিল, দুলিল রে দুলিল–
মানসসরসে রসপুলকে পলকে পলকে ঢেউ তুলিল॥
গগন মগন হল গন্ধে, সমীরণ মূর্ছে আনন্দে,
গুন্গুন্ গুঞ্জনছন্দে মধুকর ঘিরি ঘিরি বন্দে–
নিখিলভুবনমন ভুলিল।
মন ভুলিল রে মন ভুলিল॥
আজি ঝরো ঝরো মুখর বাদরদিনে
আজি ঝরো ঝরো মুখর বাদরদিনে
জানি নে, জানি নে কিছুতে কেন যে মন লাগে না ॥
এই চঞ্চল সজল পবন-বেগে উদ্ভ্রান্ত মেঘে মন চায়
মন চায় ওই বলাকার পথখানি নিতে চিনে॥
মেঘমল্লার সারা দিনমান।
বাজে ঝরনার গান।
মন হারাবার আজি বেলা, পথ ভুলিবার খেলা– মন চায়
মন চায় হৃদয় জড়াতে কার চিরঋণে॥
আজি তোমায় আবার চাই শুনাবারে
আজি তোমায় আবার চাই শুনাবারে
যে কথা শুনায়েছি বারে বারে॥
আমার পরানে আজি যে বাণী উঠিছে বাজি
অবিরাম বর্ষণধারে॥
কারণ শুধায়ো না, অর্থ নাহি তার,
সুরের সঙ্কেত জাগে পুঞ্জিত বেদনার।
স্বপ্নে যে বাণী মনে মনে ধ্বনিয়া উঠে ক্ষণে ক্ষণে
কানে কানে গুঞ্জরিব তাই
বাদলের অন্ধকারে॥
আজি পল্লিবালিকা অলকগুচ্ছ সাজালো
আজি পল্লিবালিকা অলকগুচ্ছ সাজালো বকুলফুলের দুলে,
যেন মেঘরাগিণীরচিত কী সুর দুলালো কর্ণমূলে॥
ওরা চলেছে কুঞ্জচ্ছায়াবীথিকায় হাস্যকল্লোল-উছল গীতিকায়
বেণুমর্মরমুখর পবনে তরঙ্গ তুলে॥
আজি নীপশাখায়-শাখায় দুলিছে পুষ্পদোলা,
আজি কূলে কূলে তরল প্রলাপে যমুনা কলরোলা।
মেঘপুঞ্জ গরজে গুরু গুরু, বনের বক্ষ কাঁপে দুরু দুরু–
স্বপ্নলোকে পথ হারানু মনের ভুলে॥
আজি বরিষনমুখরিত শ্রাবণরাতি
আজি বরিষনমুখরিত শ্রাবণরাতি,
স্মৃতিবেদনার মালা একেলা গাঁথি॥
আজি কোন্ ভুলে ভুলি আঁধার ঘরেতে রাখি দুয়ার খুলি,
মনে হয় বুঝি আসিছে সে মোর দুখরজনীর সাথি॥
আসিছে সে ধারাজলে সুর লাগায়ে,
নীপবনে পুলক জাগায়ে।
যদিও বা নাহি আসে তবু বৃথা আশ্বাসে
ধুলি-‘পরে রাখিব রে মিলন-আসনখানি পাতি॥
আজি বর্ষারাতের শেষে
আজি বর্ষারাতের শেষে
সজল মেঘের কোমল কালোয় অরুণ আলো মেশে॥
বেণুবনের মাথায় মাথায় রঙ লেগেছে পাতায় পাতায়,
রঙের ধারায় হৃদয় হারায়, কোথা যে যায় ভেসে॥
এই ঘাসের ঝিলিমিলি,
তার সাথে মোর প্রাণের কাঁপন এক তালে যায় মিলি।
মাটির প্রেমে আলোর রাগে রক্তে আমার পুলক লাগে–
বনের সাথে মন যে মাতে, ওঠে আকুল হেসে॥
আজি বসন্ত জাগ্রত দ্বারে
আজি বসন্ত জাগ্রত দ্বারে।
তব অবগুণ্ঠিত কুণ্ঠিত জীবনে
কোরো না বিড়ম্বিত তারে॥
আজি খুলিয়ো হৃদয়দল খুলিয়ো,
আজি ভুলিয়ো আপন-পর ভুলিয়ো,
এই সংগীতমুখরিত গগনে
তব গন্ধ তরঙ্গিয়া তুলিয়ো।
এই বাহির ভুবনে দিশা হারায়ে
দিয়ো ছড়ায়ে মাধুরী ভারে ভারে।
অতি নিবিড় বেদনা বনমাঝে রে
আজি পল্লবে পল্লবে বাজে রে।
দূরে গগনে কাহার পথ চাহিয়া
আজি ব্যাকুল বসুন্ধরা সাজে রে।
মোর পরানে দখিনবায়ু লাগিছে–
কারে দ্বারে দ্বারে কর হানি মাগিছে।
এই সৌরভবিহ্বলা রজনী
কার চরণে ধরণীতলে জাগিছে।
ওগো সুন্দর, বল্লভ, কান্ত,
তব গম্ভীর আহ্বান কারে॥
আজি মেঘ কেটে গেছে সকালবেলায়
আজি মেঘ কেটে গেছে সকালবেলায়,
এসো এসো এসো তোমার হাসিমুখে–
এসো আমার অলস দিনের খেলায়॥
স্বপ্ন যত জমেছিল আশা-নিরাশায়
তরুণ প্রাণের বিফল ভালোবাসায়
দিব অকূল-পানে ভাসায়ে ভাঁটার গাঙের ভেলায়।
দুঃখসুখের বাঁধন তারি গ্রন্থি দিব খুলে,
আজি ক্ষণেক-তরে মোরা রব আপন ভুলে।
যে গান হয় নি গাওয়া যে দান হয় নি পাওয়া–
আজি পূরব-হাওয়ায় তারি পরিতাপ
উড়াব অবহেলায়॥
আজি শ্রাবণঘনগহন মোহে গোপন তব চরণ ফেলে
আজি শ্রাবণঘনগহন মোহে গোপন তব চরণ ফেলে
নিশার মতো, নীরব ওহে, সবার দিঠি এড়ায়ে এলে।
প্রভাত আজি মুদেছে আঁখি, বাতাস বৃথা যেতেছে ডাকি,
নিলাজ নীল আকাশ ঢাকি নিবিড় মেঘ কে দিল মেলে॥
কূজনহীন কাননভূমি, দুয়ার দেওয়া সকল ঘরে–
একেলা কোন্ পথিক তুমি পথিকহীন পথের ‘পরে।
হে একা সখা, হে প্রিয়তম, রয়েছে খোলা এ ঘর মম,
সমুখ দিয়ে স্বপনসম যেয়ো না মোরে হেলায় ঠেলে॥
আজি হৃদয় আমার যায় যে ভেসে
আজি হৃদয় আমার যায় যে ভেসে
যার পায় নি দেখা তার উদ্দেশে॥
বাঁধন ভোলে, হাওয়ায় দোলে, যায় সে বাদল-মেঘের কোলে রে
কোন্-সে অসম্ভবের দেশে॥
সেথায় বিজন সাগরকূলে
শ্রাবণ ঘনায় শৈলমূলে।
রাজার পুরে তমালগাছে নূপুর শুনে ময়ূর নাচে রে
সুদূর তেপান্তরের শেষে॥
আজি ওই আকাশ-‘পরে সুধায় ভরে আষাঢ়-মেঘের ফাঁক
আজি ওই আকাশ-‘পরে সুধায় ভরে আষাঢ়-মেঘের ফাঁক।
হৃদয়-মাঝে মধুর বাজে কী উৎসবের শাঁখ॥
একি হাসির বাঁশির তান, একি চোখের জলের গান–
পাই নে দিশে কে জানি সে দিল আমায় ডাক॥
আমায় নিরুদ্দেশের পানে কেমন করে টানে এমন করুণ গানে।
ওই পথের পারের আলো আমার লাগল চোখে ভালো,
গগনপারে দেখি তারে সুদূর নির্বাক্॥