সারা নিশি ছিলেম শুয়ে বিজন ভুঁয়ে
সারা নিশি ছিলেম শুয়ে বিজন ভুঁয়ে
আমার মেঠো ফুলের পাশাপাশি,
তখন শুনেছিলেম তারার বাঁশি॥
যখন সকালবেলা খুঁজে দেখি স্বপ্নে-শোনা সে সুর একি
আমার মেঠো ফুলের চোখের জলে সুর উঠে ভাসি॥
এ সুর আমি খুঁজেছিলেম রাজার ঘরে,
শেষে ধরা দিল ধরার ধূলির ‘পরে।
এ যে ঘাসের কোলে আলোর ভাষা আকাশ-হতে-ভেসে-আসা–
এ যে মাটির কোলে মানিক-খসা হাসিরাশি॥
সে কি ভাবে গোপন রবে লুকিয়ে হৃদয় কাড়া
সে কি ভাবে গোপন রবে লুকিয়ে হৃদয় কাড়া।
তাহার আসা হাওয়ায় ঢাকা, সে যে সৃষ্টিছাড়া॥
হিয়ায় হিয়ায় জাগল বাণী, পাতায় পাতায় কানাকানি–
‘ওই এল যে’, ‘ওই এল যে’ পরান দিল সাড়া॥
এই তো আমার আপ্নারই এই ফুল ফোটানোর মাঝে
তারে দেখি নয়ন ভ’রে নানা রঙের সাজে।
এই-যে পাখির গানে গানে চরণধ্বনি বয়ে আনে,
বিশ্ববীণার তারে তারে এই তো দিল নাড়া॥
সে দিন আমায় বলেছিলে আমার সময় হয় নাই
সে দিন আমায় বলেছিলে আমার সময় হয় নাই–
ফিরে ফিরে চলে গেলে তাই॥
তখনো খেলার বেলা– বনে মল্লিকার মেলা,
পল্লবে পল্লবে বায়ু উতলা সদাই॥
আজি এল হেমন্তের দিন
কুহেলীবিলীন, ভূষণবিহীন।
বেলা আর নাই বাকি, সময় হয়েছে নাকি–
দিনশেষে দ্বারে বসে পথপানে চাই।
সেই তো তোমার পথের বঁধু সেই তো
সেই তো তোমার পথের বঁধু সেই তো।
দূর কুসুমের গন্ধ এনে খোঁজায় মধু সেই তো ॥
সেই তো তোমার পথের বঁধু সেই তো।
এই আলো তার এই তো আঁধার, এই আছে এই নেই তো ॥
সেই তো বসন্ত ফিরে এল
সেই তো বসন্ত ফিরে এল, হৃদয়ের বসন্ত ফুরায় হায় রে।
সব মরুময়, মলয়-অনিল এসে কেঁদে শেষে ফিরে চলে যায় হায় রে॥
কত শত ফুল ছিল হৃদয়ে, ঝরে গেল, আশালতা শুকালো–
পাখিগুলি দিকে দিকে চলে যায়।
শুকানো পাতায় ঢাকা বসন্তের মৃতকায়,
প্রাণ করে হায়-হায় হায় রে॥
ফুরাইল সকলই।
প্রভাতের মৃদু হাসি, ফুলের রূপরাশি, ফিরিবে কি আর।
কিবা জোছনা ফুটিত রে কিবা যামিনী–
সকলই হারালো, সকলই গেল রে চলিয়া, প্রাণ করে হায় হায় হায় রে॥
স্বপ্নে আমার মনে হল
স্বপ্নে আমার মনে হল কখন ঘা দিলে আমার দ্বারে, হায়।
আমি জাগি নাই জাগি নাই গো,
তুমি মিলালে অন্ধকার, হায়॥
অচেতন মনো-মাঝে তখন রিমিঝিমি ধ্বনি বাজে,
কাঁপিল বনের ছায়া ঝিল্লিরঝঙ্কারে।
আমি জাগি নাই জাগি নাই গো, নদী বহিল বনের পারে॥
পথিক এল দুই প্রহরে পথের আহ্বান আনি ঘরে।
শিয়রে নীরব বীণা বেজেছিল কি জানি না–
জাগি নাই জাগি নাই গো,
ঘিরেছিল বনগন্ধ ঘুমের চারি ধারে॥
হায় হেমন্তলক্ষ্মী তোমার নয়ন কেন ঢাকা
হায় হেমন্তলক্ষ্মী, তোমার নয়ন কেন ঢাকা–
হিমের ঘন ঘোমটাখানি ধুমল রঙে আঁকা ॥
সন্ধ্যাপ্রদীপ তোমার হাতে মলিন হেরি কুয়াশাতে,
কণ্ঠে তোমার বাণী যেন করুণ বাষ্পে মাখা ॥
ধরার আঁচল ভরে দিলে প্রচুর সোনার ধানে।
দিগঙ্গনার অঙ্গন আজ পূর্ণ তোমার দানে।
আপন দানের আড়ালেতে রইলে কেন আসন পেতে,
আপনাকে এই কেমন তোমার গোপন ক’রে রাখা ॥
হিমের রাতে ওই গগনের দীপগুলিরে
হিমের রাতে ওই গগনের দীপগুলিরে
হেমন্তিকা করল গোপন আঁচল ঘিরে॥
ঘরে ঘরে ডাক পাঠালো– “দীপালিকায় জ্বালাও আলো,
জ্বালাও আলো, আপন আলো, সাজাও আলোয় ধরিত্রীরে।’
শূন্য এখন ফুলের বাগান, দোয়েল কোকিল গাহে না গান,
কাশ ঝরে যায় নদীর তীরে।
যাক অবসাদ বিষাদ কালো, দীপালিকায় জ্বালাও আলো–
জ্বালাও আলো, আপন আলো, শুনাও আলোর জয়বাণীরে॥
দেবতারা আজ আছে চেয়ে– জাগো ধরার ছেলে মেয়ে,
আলোয় জাগাও যামিনীরে।
এল আঁধার দিন ফুরালো, দীপালিকায় জ্বালাও আলো,
জ্বালাও আলো, আপন আলো, জয় করো এই তামসীরে॥
হৃদয় আমার ওই বুঝি তোর বৈশাখী ঝড় আসে
হৃদয় আমার, ওই বুঝি তোর বৈশাখী ঝড় আসে।
বেড়া-ভাঙার মাতন নামে উদ্দাম উল্লাসে॥
তোমার মোহন এল ভীষণ বেশে, আকাশ ঢাকা জটিল কেশে–
বুঝি এল তোমার সাধনধন চরম সর্বনাশে॥
বাতাসে তোর সুর ছিল না, ছিল তাপে ভরা।
পিপাসাতে বুক-ফাটা তোর শুষ্ক কঠিন ধরা।
এবার জাগ্রে হতাশ, আয় রে ছুটে অবসাদের বাঁধন টুটে–
বুঝি এল তোমার পথের সাথি বিপুল অট্টহাসে॥
হৃদয় আমার নাচে রে আজিকে ময়ূরের মতো নাচে রে
হৃদয় আমার নাচে রে আজিকে ময়ূরের মতো নাচে রে।
শত বরনের ভাব-উচ্ছ্বাস কলাপের মতো করেছে বিকাশ,
আকুল পরান আকাশে চাহিয়া উল্লাসে কারে যাচে রে॥
ওগো, নির্জনে বকুলশাখায় দোলায় কে আজি দুলিছে, দোদুল দুলিছে॥
ঝরকে ঝরকে ঝরিছে বকুল, আঁচল আকাশে হতেছে আকুল,
উড়িয়া অলক ঢাকিছে পলক– কবরী খসিয়া খুলিছে।
ঝরে ঘনধারা নবপল্লবে, কাঁপিছে কানন ঝিল্লির রবে–
তীর ছাপি নদী কলকল্লোলে এল পল্লির কাছে রে॥
হৃদয়ে ছিলে জেগে
হৃদয়ে ছিলে জেগে,
দেখি আজ শরতমেঘে॥
কেমনে আজকে ভোরে গেল গো গেল সরে
তোমার ওই আঁচলখানি শিশিরের ছোঁওয়া লেগে॥
কী-যে গান গাহিতে চাই,
বাণী মোর খুঁজে না পাই।
সে যে ওই শিউলিদলে ছড়ালো কাননতলে,
সে যে ওই ক্ষণিক ধারায় উড়ে যায় বায়ুবেগে॥
হৃদয়ে মন্দ্রিল ডমরু গুরু গুরু
হৃদয়ে মন্দ্রিল ডমরু গুরু গুরু,
ঘন মেঘের ভুরু কুটিল কুঞ্চিত,
হল রোমাঞ্চিত বন বনান্তর–
দুলিল চঞ্চল বক্ষোহিন্দোলে মিলনস্বপ্নে সে কোন্ অতিথি রে।
সঘনবর্ষণশব্দমুখরিত বজ্রসচকিত ত্রস্ত শর্বরী,
মালতীবল্লরী কাঁপায় পল্লব করুণ কল্লোলে–
কানন শঙ্কিত ঝিল্লিঝঙ্কৃত॥