শুক্নো পাতা কে যে ছড়ায় ওই দূরে
শুক্নো পাতা কে যে ছড়ায় ওই দূরে উদাস-করা কোন্ সুরে॥
ঘরছাড়া ওই কে বৈরাগী জানি না যে কাহার লাগি
ক্ষণে ক্ষণে শূন্য বনে যায় ঘুরে॥
চিনি চিনি হেন ওরে হয় মনে,
ফিরে ফিরে যেন দেখা ওর সনে।
ছদ্মবেশে কেন খেলো, জীর্ণ এ বাস ফেলো ফেলো–
প্রকাশ করো চিরনূতন বন্ধুরে॥
শুষ্কতাপের দৈত্যপুরে দ্বার ভাঙবে ব’লে
শুষ্কতাপের দৈত্যপুরে দ্বার ভাঙবে ব’লে,
রাজপুত্র, কোথা হতে হঠাৎ এলে চলে॥
সাত-সমুদ্র-পারের থেকে বজ্রস্বরে এলে হেঁকে,
দুন্দুভি যে উঠল বেজে বিষম কলরোলে॥
বীরের পদপরশ পেয়ে মূর্ছা হতে জাগে,
বসুন্ধরার তপ্ত প্রাণে বিপুল পুলক লাগে।
মরকতমণির থালা সাজিয়ে গাঁথে বরণমালা,
উতলা তার হিয়া আজি সজল হাওয়ায় দোলে॥
শেষ গানেরই রেশ নিয়ে যাও চলে
শেষ গানেরই রেশ নিয়ে যাও চলে, শেষ কথা যাও ব’লে॥
সময় পাবে না আর, নামিছে অন্ধকার,
গোধুলিতে আলো-আঁধারে
পথিক যে পথ ভোলে॥
পশ্চিমগগনে ওই দেখা যায় শেষ রবিরেখা,
তমাল-অরণ্যে ওই শুনি শেষ কেকা।
কে আমার অভিসারিকা বুঝি বাহিরিল অজানারে খুঁজি,
শেষবার মোর আঙিনার দ্বার খোলে॥
শ্যামল ছায়া নাইবা গেলে
শ্যামল ছায়া, নাইবা গেলে
শেষ বরষার ধারা ঢেলে॥
সময় যদি ফুরিয়ে থাকে– হেসে বিদায় করো তাকে,
এবার নাহয় কাটুক বেলা অসময়ের খেলা খেলে॥
মলিন, তোমার মিলাবে লাজ–
শরৎ এসে পরাবে সাজ।
নবীন রবি উঠবে হাসি, বাজাবে মেঘ সোনার বাঁশি–
কালোয় আলোয় যুগলরূপে শূন্যে দেবে মিলন মেলে॥
শ্যামল শোভন শ্রাবণ তুমি নাই বা গেলে
শ্যামল শোভন শ্রাবণ, তুমি নাই বা গেলে
সজল বিলোল আঁচল মেলে॥
পুব হাওয়া কয়, “ওর যে সময় গেল চলে।’
শরৎ বলে, “ভয় কী সময় গেল ব’লে,
বিনা কাজে আকাশ-মাঝে কাটবে বেলা অসময়ের খেলা খেলে।’
কালো মেঘের আর কি আছে দিন।
ও যে হল সাথিহীন।
পুব-হাওয়া কয়, “কালোর এবার যাওয়াই ভালো।’
শরৎ বলে, “মিলবে যুগল কালোয় আলো,
সাজবে বাদল সোনার সাজে আকাশ মাঝে কালিমা ওর ঘুচিয়ে ফেলে।’
শ্রাবণ তুমি বাতাসে কার আভাস পেলে
শ্রাবণ, তুমি বাতাসে কার আভাস পেলে–
পথে তারি সকল বারি দিলে ঢেলে।
কেয়া কাঁদে, “যা য় যা য় যায়।’
কদম ঝরে, “হা য় হা য় হায়।’
পুব-হাওয়া কয়, “ওর তো সময় নাই বাকি আর।’
শরৎ বলে, “যাক-না সময়, ভয় কিবা তার–
কাটবে বেলা আকাশ-মাঝে বিনা কাজে অসময়ের খেলা খেলে।’
কালো মেঘের আর কি আছে দিন, ও যে হল সাথিহীন।
পুব-হাওয়া কয়, “কালোর এবার যাওয়াই ভালো।’
শরৎ বলে, “মিলিয়ে দেব কালোয় আলো–
সাজবে বাদল আকাশ-মাঝে সোনার সাজে কালিমা ওর মুছে ফেলে।’
শ্রাবণবরিষন পার হয়ে কী বাণী আসে ওই রয়ে রয়ে
শ্রাবণবরিষন পার হয়ে কী বাণী আসে ওই রয়ে রয়ে।
গোপন কেতকীর পরিমলে, সিক্ত বকুলের বনতলে,
দূরের আঁখিজল বয়ে বয়ে কী বাণী আসে ওই রয়ে রয়ে॥
কবির হিয়াতলে ঘুরে ঘুরে আঁচল ভরে লয় সুরে সুরে।
বিজনে বিরহীর কানে কানে সজল মল্লার-গানে-গানে
কাহার নামখানি কয়ে কয়ে
কী বাণী আসে ওই রয়ে রয়ে॥
শ্রাবণমেঘের আধেক দুয়ার ওই খোলা
শ্রাবণমেঘের আধেক দুয়ার ওই খোলা,
আড়াল থেকে দেয় দেখা কোন্ পথ-ভোলা ॥
ওই-যে পুরব-গগন জুড়ে উত্তরী তার যায় রে উড়ে,
সজল হাওয়ার হিন্দোলাতে দেয় দোলা ॥
লুকাবে কি প্রকাশ পাবে কেই জানে–
আকাশে কি ধরায় বাসা কোন্খানে।
নানা বেশে ক্ষণে ক্ষণে ওই তো আমার লাগায় মনে
পরশখানি নানা-সুরের-ঢেউ-তোলা ॥
শ্রাবণের গগনের গায় বিদ্যুৎ চমকিয়া যায়
শ্রাবণের গগনের গায় বিদ্যুৎ চমকিয়া যায়।
ক্ষণে ক্ষণে শর্বরী শিহরিয়া উঠে, হায়॥
তেমনি তোমার বাণী মর্মতলে যায় হানি সঙ্গোপনে,
ধৈরজ যায় যে টুটে, হায়॥
যেমন বরষাধারায় অরণ্য আপনা হারায় বারে বারে
ঘন রস-আবরণে
তেমনি তোমার স্মৃতি ঢেকে ফেলে মোর গীতি
নিবিড় ধারে আনন্দ-বরিষণে, হায়॥
সঘন গহন রাত্রি ঝরিছে শ্রাবণধারা
সঘন গহন রাত্রি, ঝরিছে শ্রাবণধারা–
অন্ধ বিভাবরী সঙ্গপরশহারা ॥
চেয়ে থাকি যে শূন্যে অন্যমনে
সেথায় বিরহিণীর অশ্রু হরণ করেছে ওই তারা ॥
অশত্থপল্লবে বৃষ্টি ঝরিয়া মর্মরশব্দে
নিশীথের অনিদ্রা দেয় যে ভরিয়া।
মায়ালোক হতে ছায়াতরণী
ভাসায় স্বপ্নপারাবারে–
নাহি তার কিনারা ॥
সব দিবি কে সব দিবি পায়
সব দিবি কে সব দিবি পায়, আয় আয় আয়।
ডাক পড়েছে ওই শোনা যায়, আয় আয় আয়॥
আসবে যে সে স্বর্ণরথে– জাগবি কারা রিক্ত পথে
পৌষ-রজনী তাহার আশায়, আয় আয় আয়॥
ক্ষণেক কেবল তাহার খেলা, হায় হায় হায়।
তার পরে তার যাবার বেলা, হায় হায় হায়।
চলে গেলে জাগবি যবে ধনরতন বোঝা হবে,
বহন করা হবে-যে দায়, আয় আয় আয়॥
সহসা ডালপালা তোর উতলা-যে
সহসা ডালপালা তোর উতলা-যে ও চাঁপা, ও করবী!
কারে তুই দেখতে পেলি আকাশে-মাঝে জানি না যে॥
কোন্ সুরের মাতন হাওয়ায় এসে বেড়ায় ভেসে ও চাঁপা, ও করবী!
কার নাচনের নূপুর বাজে জানি না যে॥
তোরে ক্ষণে ক্ষণে চমক লাগে।
কোন্ অজানার ধেয়ান তোমার মনে জাগে।
কোন্ রঙের মাতন উঠল দুলে ফুলে ফুলে ও চাঁপা, ও করবী!
কে সাজালে রঙিন সাজে জানি না যে॥
সারা নিশি ছিলেম শুয়ে বিজন ভুঁয়ে
সারা নিশি ছিলেম শুয়ে বিজন ভুঁয়ে
আমার মেঠো ফুলের পাশাপাশি,
তখন শুনেছিলেম তারার বাঁশি॥
যখন সকালবেলা খুঁজে দেখি স্বপ্নে-শোনা সে সুর একি
আমার মেঠো ফুলের চোখের জলে সুর উঠে ভাসি॥
এ সুর আমি খুঁজেছিলেম রাজার ঘরে,
শেষে ধরা দিল ধরার ধূলির ‘পরে।
এ যে ঘাসের কোলে আলোর ভাষা আকাশ-হতে-ভেসে-আসা–
এ যে মাটির কোলে মানিক-খসা হাসিরাশি॥