মোরা ভাঙব তাপস
মোরা ভাঙব তাপস, ভাঙব তোমার কঠিন তপের বাঁধন–
এবার এই আমাদের সাধন॥
চল্ কবি, চল্ সঙ্গে জুটে, কাজ ফেলে তুই আ য় আ য় আয় রে ছুটে,
গানে গানে উদাস প্রাণে
জাগা রে উন্মাদন, এবার জাগা রে উন্মাদন॥
বকুলবনের মুগ্ধ হৃদয় উঠুক-না উচ্ছ্বাসি,
নীলাম্বরের মর্ম-মাঝে বাজাও তোমার সোনার বাঁশি বাজাও।
পলাশরেণুর রঙ মাখিয়ে নবীন বসন এনেছি এ,
সবাই মিলে দিই ঘুচিয়ে
পুরানো আচ্ছাদন, তোমার পুরানো আচ্ছাদন॥
যদি তারে নাই চিনি গো
যদি তারে নাই চিনি গো সে কি আমায় নেবে চিনে
এই নব ফাল্গুনের দিনে– জানি নে জানি নে॥
সে কি আমার কুঁড়ির কানে কবে কথা গানে গানে,
পরান তাহার নেবে কিনে এই নব ফাল্গুনের দিনে–
জানি নে, জানি নে॥
সে কি আপন রঙে ফুল রাঙাবে।
সে কি মর্মে এসে ঘুম ভাঙাবে।
ঘোমটা আমার নতুন পাতার হঠাৎ দোলা পাবে কি তার। ,
গোপন কথা নেবে জিনে এই নব ফাল্গুনের দিনে–
জানি নে, জানি নে॥
যায় দিন শ্রাবণদিন যায়
যায় দিন, শ্রাবণদিন যায়।
আঁধারিল মন মোর আশঙ্কায়,
মিলনের বৃথা প্রত্যাশায় মায়াবিনী এই সন্ধ্যা ছলিছে॥
আসন্ন নির্জন রাতি, হায়, মম পথ-চাওয়া বাতি
ব্যাকুলিছে শূন্যেরে কোন্ প্রশ্নে॥
দিকে দিকে কোথাও নাহি সাড়া,
ফিরে খ্যাপা হাওয়া গৃহছাড়া।
নিবিড়-তমিস্র-বিলুপ্ত-আশা ব্যথিতা যামিনী খোঁজে ভাষা–
বৃষ্টিমুখরিত মর্মরছন্দে, সিক্ত মালতীগন্ধে॥
যেতে দাও যেতে দাও গেল যারা
যেতে দাও যেতে দাও গেল যারা।
তুমি যেয়ো না, তুমি যেয়ো না,
আমার বাদলের গান হয় নি সারা ॥
কুটিরে কুটিরে বন্ধ দ্বার, নিভৃত রজনী অন্ধকার,
বনের অঞ্চল কাঁপে চঞ্চল– অধীর সমীর তন্দ্রাহারা ॥
দীপ নিবেছে নিবুক নাকো, আঁধারে তব পরশ রাখো।
বাজুক কাঁকন তোমার হাতে আমার গানের তালের সাথে,
যেমন নদীর ছলোছলো জলে ঝরে ঝরোঝরো শ্রাবণধারা ॥
রত-আলোর কমলবনে
শরত-আলোর কমলবনে
বাহির হয়ে বিহার করে যে ছিল মোর মনে মনে॥
তারি সোনার কাঁকন বাজে আজি প্রভাতকিরণ-মাঝে,
হাওয়ায় কাঁপে আঁচলখানি– ছড়ায় ছায়া ক্ষণে ক্ষণে॥
আকুল কেশের পরিমলে
শিউলিবনের উদাস বায়ু পড়ে থাকে তরুতলে।
হৃদয়মাঝে হৃদয় দুলায়, বাহিরে সে ভুবন ভুলায়–
আজি সে তার চোখের চাওয়া ছড়িয়ে দিল নীল গগনে॥
শরতে আজ কোন্ অতিথি এল প্রাণের দ্বারে
শরতে আজ কোন্ অতিথি এল প্রাণের দ্বারে।
আনন্দগান গা রে হৃদয়, আনন্দগান গা রে॥
নীল আকাশের নীরব কথা শিশির-ভেজা ব্যাকুলতা
বেজে উঠুক আজি তোমার বীণার তারে তারে॥
শষ্যক্ষেতের সোনার গানে যোগ দে রে আজ সমান তানে,
ভাসিয়ে দে সুর ভরা নদীর অমল জলধারে।
যে এসেছে তাহার মুখে দেখ্ রে চেয়ে গভীর সুখে,
দুয়ার খুলে তাহার সাথে বাহির হয়ে যা রে॥
শরৎ তোমার অরুণ আলোর অঞ্জলি
শরৎ, তোমার অরুণ আলোর অঞ্জলি।
ছড়িয়ে গেল ছাপিয়ে মোহন অঙ্গুলি॥
শরৎ, তোমার শিশির-ধোওয়া কুন্তলে
বনের-পথে-লুটিয়ে-পড়া অঞ্চলে
আজ প্রভাতের হৃদয় ওঠে চঞ্চলি॥
মানিক-গাঁথা ওই-যে তোমার কঙ্কণে
ঝিলিক লাগায় তোমার শ্যামল অঙ্গনে।
কুঞ্জছায়া গুঞ্জরণের সঙ্গীতে
ওড়না ওড়ায় একি নাচের ভঙ্গীতে,
শিউলিবনের বুক যে ওঠে আন্দোলি॥
শাঙনগগনে ঘোর ঘনঘটা
শাঙনগগনে ঘোর ঘনঘটা, নিশীথযামিনী রে।
কুঞ্জপথে, সখি, কৈসে যাওব অবলা কামিনী রে।
উন্মদ পবনে যমুনা তর্জিত, ঘন ঘন গর্জিত মেহ।
দমকত বিদ্যুত, পথতরু লুন্ঠিত, থরহর কম্পিত দেহ
ঘন ঘন রিম্ ঝিম্ রিম্ ঝিম্ রিম্ ঝিম্ বরখত নীরদপুঞ্জ।
শাল-পিয়ালে তাল-তমালে নিবিড়তিমিরময় কুঞ্জ।
কহ রে সজনী, এ দুরুযোগে কুঞ্জে নিরদয় কান
দারুণ বাঁশী কাহ বজায়ত সকরুণ রাধা নাম।
মোতিম হারে বেশ বনা দে, সীঁথি লগা দে ভালে।
উরহি বিলুন্ঠিত লোল চিকুর মম বাঁধহ চম্পকমালে।
গহন রয়নমে ন যাও, বালা, নওলকিশোরক পাশ।
গরজে ঘন ঘন, বহু ডর পাওব, কহে ভানু তব দাস।
শিউলি ফুল শিউলি ফুল কেমন ভুল এমন ভুল
শিউলি ফুল, শিউলি ফুল, কেমন ভুল, এমন ভুল॥
রাতের বায় কোন্ মায়ায় আনিল হায় বনছায়ায়,
ভোরবেলায় বারে বারেই ফিরিবারে হলি ব্যাকুল॥
কেন রে তুই উন্মনা! নয়নে তোর হিমকণা।
কোন্ ভাষায় চাস বিদায়, গন্ধ তোর কী জানায়–
সঙ্গে হায় পলে পলেই দলে দলে যায় বকুল॥
শিউলি-ফোটা ফুরোল যেই ফুরোল
শিউলি-ফোটা ফুরোল যেই ফুরোল শীতের বনে
এলে যে–
আমার শীতের বনে এলে যে সেই শূন্যক্ষণে॥
তাই গোপনে সাজিয়ে ডালা দুখের সুরে বরণমালা
গাঁথি মনে মনে শূন্যক্ষণে॥
দিনের কোলাহলে
ঢাকা সে যে রইবে হৃদয়তলে–
আমার বরণমালা রইবে হৃদয়তলে॥
রাতের তারা উঠবে যবে সুরের মালা বদল হবে
তখন তোমার সনে মনে মনে॥
শীতের বনে কোন্ সে কঠিন আসবে ব’লে
শীতের বনে কোন্ সে কঠিন আসবে ব’লে
শিউলিগুলি ভয়ে মলিন বনের কোলে॥
আম্লকি-ডাল সাজল কাঙাল, খসিয়ে দিল পল্লবজাল,
কাশের হাসি হাওয়ায় ভাসি যায় সে চলে॥
সইবে না সে পাতায় ঘাসে চঞ্চলতা
তাই তো আপন রঙ ঘুচালো ঝুম্কোলতা।
উত্তরবায় জানায় শাসন, পাতল তপের শুষ্ক আসন,
সাজ-খসাবার হায় এই লীলা কার অট্টরোলে॥
শীতের হাওয়ার লাগল নাচন
শীতের হাওয়ার লাগল নাচন আম্লকির এই ডালে ডালে।
পাতাগুলি শির্শিরিয়ে ঝরিয়ে দিল তালে তালে॥
উড়িয়ে দেবার মাতন এসে কাঙাল তারে করল শেষে,
তখন তাহার ফলের বাহার রইল না আর অন্তরালে॥
শূন্য করে ভরে দেওয়া যাহার খেলা
তারি লাগি রইনু বসে সকল বেলা।
শীতের পরশ থেকে থেকে যায় বুঝি ওই ডেকে ডেকে,
সব খোওয়াবার সময় আমার হবে কখন কোন্ সকালে॥