মধ্যদিনের বিজন বাতায়নে
মধ্যদিনের বিজন বাতায়নে
ক্লান্তি-ভরা কোন্ বেদনার মায়া স্বপ্নাভাসে ভাসে মনে-মনে॥
কৈশোরে যে সলাজ কানাকানি খুঁজেছিল প্রথম প্রেমের বাণী
আজ কেন তাই তপ্ত হাওয়ায় হাওয়ায় মর্মরিছে গহন বনে বনে॥
যে নৈরাশা গভীর অশ্রুজলে ডুবেছিল বিস্মরণের তলে
আজ কেন সেই বনযূথীর বাসে উচ্ছ্বসিল মধুর নিশ্বাসে,
সারাবেলা চাঁপার ছায়ায় ছায়ায় গুঞ্জরিয়া ওঠে ক্ষণে ক্ষণে॥
মন যে বলে চিনি চিনি
মন যে বলে, চিনি চিনি যে-গন্ধ বয় এই সমীরে।
কে ওরে কয় বিদেশিনী চৈত্ররাতের চামেলিরে॥
রক্তে রেখে গেছে ভাষা,
স্বপ্নে ছিল যাওয়া-আসা–
কোন্ যুগে কোন্ হাওয়ার পথে, কোন্ বনে কোন্ সিন্ধুতীরে।
এই সুদূরে পরবাসে
ওর বাঁশি আজ প্রাণে আসে।
মোর পুরাতন দিনের পাখি
ডাক শুনে তার উঠল ডাকি,
চিত্ততলে জাগিয়ে তোলে অশ্রুজলের ভৈরবীরে॥
মনে হল যেন পেরিয়ে এলেম অন্তবিহীন পথ
মনে হল যেন পেরিয়ে এলেম অন্তবিহীন পথ আসিতে তোমার দ্বারে
মরুতীর হতে সুধাশ্যামলিম পারে॥
পথ হতে আমি গাঁথিয়া এনেছি সিক্ত যূথীর মালা
সকরুণ-নিবেদনের-গন্ধ ঢালা–
লজ্জা দিয়ো না তারে॥
সজল মেঘের ছায়া ঘনাইছে বনে বনে,
পথ-হারানোর বাজিছে বেদনা সমীরণে।
দূরে হতে আমি দেখেছি তোমার ওই বাতায়নতলে নিভৃতে প্রদীপ জ্বলে–
আমার এ আঁখি উৎসুক পাখি ঝড়ের অন্ধকারে॥
মম অন্তর উদাসে
মম অন্তর উদাসে
পল্লবমর্মরে কোন্ চঞ্চল বাতাসে॥
জ্যোৎস্নাজড়িত নিশা ঘুমে-জাগরণে-মিশা
বিহ্বল আকুল কার অঞ্চলসুবাসে॥
থাকিতে না দেয় ঘরে, কোথায় বাহির করে
সুন্দর সুদূরে কোন্ নন্দন-আকাশে।
অতীত দিনের পারে স্মরণসাগর-ধারে
বেদনা লুকানো কোন্ ক্রন্দন-আভাসে॥
মম মন-উপবনে চলে অভিসারে
মম মন-উপবনে চলে অভিসারে আঁধার রাতে বিরহিণী।
রক্তে তারি নূপুর বাজে রিনিরিনি॥
দুরু দুরু করে হিয়া, মেঘ ওঠে গরজিয়া,
ঝিল্লি ঝনকে ঝিনিঝিনি॥
মম মন-উপবনে ঝরে বারিধারা, গগনে নাহি শশীতারা।
বিজুলির চমকনে মিলে আলো ক্ষণে ক্ষণে,
ক্ষণে ক্ষণে পথ ভোলে উদাসিনী॥
মাধবী হঠাৎ কোথা হতে এল
মাধবী হঠাৎ কোথা হতে এল ফাগুন-দিনের স্রোতে।
এসে হেসেই বলে, “যা ই যা ই যাই।’
পাতারা ঘিরে দলে দলে তারে কানে কানে বলে,
“না না না।’
নাচে তা ই তা ই তাই॥
আকাশের তারা বলে তারে, “তুমি এসো গগন-পারে,
তোমায় চা ই চা ই চাই।’
পাতারা ঘিরে দলে দলে তারে কানে কানে বলে,
“না না না।’
নাচে তা ই তা ই তাই॥
বাতাস দখিন হতে আসে, ফেরে তারি পাশে পাশে,
বলে, “আ য় আ য় আয়’॥
বলে, “নীল অতলের কূলে সুদূর অস্তাচলের মূলে
বেলা যা য় যা য় যায়।
বলে, “পূর্ণশশীর রাতি ক্রমে হবে মলিন-ভাতি,
সময় না ই না ই নাই।’
পাতারা ঘিরে দলে দলে তারে কানে কানে বলে,
“না না না।’
নাচে তা ই তা ই তাই॥
মেঘের কোলে কোলে যায় রে চলে বকের পাঁতি
মেঘের কোলে কোলে যায় রে চলে বকের পাঁতি।
ওরা ঘর-ছাড়া মোর মনের কথা যায় বুঝি ওই গাঁথি গাঁথি॥
সুদূরের বীণার স্বরে কে ওদের হৃদয় হরে
দুরাশার দুঃসাহসে উদাস করে–
সে কোন্ উধাও হাওয়ার পাগলামিতে পাখা ওদের ওঠে মাতি॥
ওদের ঘুম ছুটেছে, ভয় টুটেছে একেবারে,
অলক্ষ্যেতে লক্ষ ওদের– পিছন-পানে তাকায় না রে।
যে বাসা ছিল জানা সে ওদের দিল হানা,
না-জানার পথে ওদের নাই রে মানা–
ওরা দিনের শেষে দেখেছে কোন্ মনোহরণ আঁধার রাতি॥
মেঘের ‘পরে মেঘ জমেছে আঁধার করে আসে
মেঘের ‘পরে মেঘ জমেছে, আঁধার করে আসে।
আমায় কেন বসিয়ে রাখ একা দ্বারের পাশে।
কাজের দিনে নানা কাজে থাকি নানা লোকের মাঝে,
আজ আমি যে বসে আছি তোমারি আশ্বাসে॥
তুমি যদি না দেখা দাও, কর আমায় হেলা,
কেমন করে কাটে আমার এমন বাদল-বেলা।
দূরের পানে মেলে আঁখি কেবল আমি চেয়ে থাকি,
পরান আমার কেঁদে বেড়ায় দুরন্ত বাতাসে॥
মেঘের কোলে রোদ হেসেছে বাদল গেছে টুটি
মেঘের কোলে রোদ হেসেছে, বাদল গেছে টুটি। আহা, হাহা, হা।
আজ আমাদের ছুটি ও ভাই, আজ আমাদের ছুটি। আহা, হাহা, হা ॥
কী করি আজ ভেবে না পাই, পথ হারিয়ে কোন্ বনে যাই,
কোন্ মাঠে যে ছুটে বেড়াই সকল ছেলে জুটি। আহা, হাহা, হা ॥
কেয়া-পাতার নৌকো গড়ে সাজিয়ে দেব ফুলে–
তালদিঘিতে ভাসিয়ে দেব, চলবে দুলে দুলে।
রাখাল ছেলের সঙ্গে ধেনু চরাব আজ বাজিয়ে বেণু,
মাখব গায়ে ফুলের রেণু চাঁপার বনে লুটি। আহা, হাহা, হা ॥
মোর বীণা ওঠে কোন্ সুরে বাজি
মোর বীণা ওঠে কোন্ সুরে বাজি কোন্ নব চঞ্চল ছন্দে।
মম অন্তর কম্পিত আজি নিখিলের হৃদয়স্পন্দে॥
আসে কোন্ তরুণ অশান্ত, উড়ে বসনাঞ্চলপ্রান্ত,
আলোকের নৃত্যে বনান্ত মুখরিত অধীর আনন্দে।
অম্বরপ্রাঙ্গনমাঝে নিঃস্বর মঞ্জীর গুঞ্জে।
অশ্রুত সেই তালে বাজে করতালি পল্লবপুঞ্জে।
কার পদপরশন-আশা তৃণে তৃণে অর্পিল ভাষা,
সমীরণ বন্ধনহারা উন্মন কোন্ বনগন্ধে॥
মোর ভাবনারে কী হাওয়ায় মাতালো
মোর ভাবনারে কী হাওয়ায় মাতালো,
দোলে মন দোলে অকারণ হরষে।
হৃদয়গগনে সজল ঘন নবীন মেঘে
রসের ধারা বরষে॥
তাহারে দেখি না যে দেখি না,
শুধু মনে মনে ক্ষণে ক্ষণে ওই শোনা যায়
বাজে অলখিত তারি চরণে
রুনুরুনু রুনুরুনু নূপুরধ্বনি॥
গোপন স্বপনে ছাইল
অপরশ আঁচলের নব নীলিমা।
উড়ে যায় বাদলের এই বাতাসে
তার ছায়াময় এলো কেশ আকাশে।
সে যে মন মোর দিল আকুলি
জল-ভেজা কেতকীর দূর সুবাসে॥