আজ বরষার রূপ হেরি মানবের মাঝে
আজ বরষার রূপ হেরি মানবের মাঝে–
চলেছে গরজি, চলেছে নিবিড় সাজে॥
হৃদয়ে তাহার নাচিয়া উঠিছে ভীমা,
ধাইতে ধাইতে লোপ ক’রে চলে সীমা,
কোন্ তাড়নায় মেঘের সহিত মেঘে
বক্ষে বক্ষে মিলিয়া বজ্র বাজে॥
পুঞ্জে পুঞ্জে দূরে সুদূরের পানে
দলে দলে চলে, কেন চলে নাহি জানে।
জানে না কিছুই কোন্ মহাদ্রিতলে
গভীর শ্রাবণে গলিয়া পড়িবে জলে,
নাহি জানে তার ঘনঘোর সমারোহে
কোন্ সে ভীষণ জীবন মরণ রাজে॥
আজ নবীন মেঘের সুর লেগেছে আমার মনে
আজ নবীন মেঘের সুর লেগেছে আমার মনে।
আমার ভাবনা যত উতল হল অকারণে॥
কেমন ক’রে যায় যে ডেকে, বাহির করে ঘরের থেকে,
ছায়াতে চোখ ফেলে ছেয়ে ক্ষণে ক্ষণে॥
বাঁধনহারা জলধারার কলরোলে
আমারে কোন্ পথের বাণী যায় যে ব’লে।
সে পথ গেছে নিরুদ্দেশে মানসলোকে গানের শেষে
চিরদিনের বিরহিণীর কুঞ্জবনে॥
আজ প্রথম ফুলের পাব প্রসাদখানি
আজ প্রথম ফুলের পাব প্রসাদখানি, তাই ভোরে উঠেছি।
আজ শুনতে পাব প্রথম আলোর বাণী, তাই বাইরে ছুটেছি॥
এই হল মোদের পাওয়া, তাই ধরেছি গান-গাওয়া,
আজ লুটিয়ে হিরণ-কিরণ-পদ্মদলে সোনার রেণু লুটেছি॥
আজ পারুলদিদির বনে মোরা চলব নিমন্ত্রণে,
চাঁপা-ভায়ের শাখা-ছায়ের তলে মোরা সবাই জুটেছি।
আজ মনের মধ্যে ছেয়ে সুনীল আকাশ ওঠে গেয়ে,
আজ সকালবেলায় ছেলেখেলার ছলে সকল শিকল টুটেছি॥
আজ বারি ঝরে ঝরঝর ভরা বাদরে
আজ বারি ঝরে ঝরঝর ভরা বাদরে,
আকাশ-ভাঙা আকুল ধারা কোথাও না ধরে॥
শালের বনে থেকে থেকে ঝড় দোলা দেয় হেঁকে হেঁকে,
জল ছুটে যায় এঁকে বেঁকে মাঠের ‘পরে।
আজ মেঘের জটা উড়িয়ে দিয়ে নৃত্য কে করে॥
ওরে বৃষ্টিতে মোর ছুটেছে মন, লুটেছে এই ঝড়ে–
বুক ছাপিয়ে তরঙ্গ মোর কাহার পায়ে পড়ে।
অন্তরে আজ কী কলরোল, দ্বারে দ্বারে ভাঙল আগল–
হৃদয়-মাঝে জাগল পাগল আজি ভাদরে।
আজ এমন ক’রে কে মেতেছে বাহিরে ঘরে॥
আজ আকাশের মনের কথা ঝরো ঝরো বাজে
আজ আকাশের মনের কথা ঝরো ঝরো বাজে
সারা প্রহর আমার বুকের মাঝে॥
দিঘির কালো জলের ‘পরে মেঘের ছায়া ঘনিয়ে ধরে,
বাতাস বহে যুগান্তরের প্রাচীন বেদনা যে
সারা প্রহর আমার বুকের মাঝে॥
আঁধার বাতায়নে
একলা আমার কানাকানি ওই আকাশের সনে।
ম্লানস্মৃতির বাণী যত পল্লবমর্মরের মতো
সজল সুরে ওঠে জেগে ঝিল্লিমুখর সাঁঝে
সারা প্রহর আমার বুকের মাঝে॥
আজ কি তাহার বারতা পেল রে কিশলয়
আজ কি তাহার বারতা পেল রে কিশলয়।
ওরা কার কথা কয় রে বনময়॥
আকাশে আকাশে দূরে দূরে সুরে সুরে
কোন্ পথিকের গাহে জয়॥
যেথা চাঁপা-কোরকের শিখা জ্বলে
ঝিল্লিমুখর ঘন বনতলে,
এসো কবি, এসো, মালা পরো, বাঁশি ধরো–
হোক গানে গানে বিনিময়॥
আজ কিছুতেই যায় না মনের ভার
আজ কিছুতেই যায় না মনের ভার,
দিনের আকাশ মেঘে অন্ধকার– হায় রে॥
মনে ছিল আসবে বুঝি, আমায় সে কি পায় নি খুঁজি–
না-বলা তার কথাখানি জাগায় হাহাকার॥
সজল হাওয়ায় বারে বারে
সারা আকাশ ডাকে তারে।
বাদল-দিনের দীর্ঘশ্বাসে জানায় আমায় ফিরবে না সে–
বুক ভরে সে নিয়ে গেল বিফল অভিসার॥
আজ তালের বনের করতালি কিসের তালে
আজ তালের বনের করতালি কিসের তালে
পূর্ণিমাচাঁদ মাঠের পারে ওঠার কালে॥
না-দেখা কোন্ বীণা বাজে আকাশ-মাঝে,
না-শোনা কোন্ রাগ রাগিণী শূন্যে ঢালে॥
ওর খুশির সাথে কোন্ খুশির আজ মেলামেশা,
কোন্ বিশ্বমাতন গানের নেশায় লাগল নেশা।
তারায় কাঁপে রিনিঝিনি যে কিঙ্কিণী
তারি কাঁপন লাগল কি ওর মুগ্ধ ভালে॥
আজ ধানের ক্ষেতে রৌদ্রছায়ায় লুকোচুরি খেলা
আজ ধানের ক্ষেতে রৌদ্রছায়ায় লুকোচুরি খেলা রে ভাই, লুকোচুরি খেলা।
নীল আকাশে কে ভাসালে সাদা মেঘের ভেলা রে ভাই– লুকোচুরি খেলা॥
আজ ভ্রমর ভোলে মধু খেতে– উড়ে বেড়ায় আলোয় মেতে;
আজ কিসের তরে নদীর চরে চখা-চখীর মেলা॥
ওরে যাব না আজ ঘরে রে ভাই, যাব না আজ ঘরে।
ওরে, আকাশ ভেঙে বাহিরকে আজ নেব রে লুট ক’রে॥
যেন জোয়ার-জলে ফেনার রাশি বাতাসে আজ ছুটছে হাসি,
আজ বিনা কাজে বাজিয়ে বাঁশি কাটবে সকল বেলা॥
আজ শ্রাবণের আমন্ত্রণে
আজ শ্রাবণের আমন্ত্রণে
দুয়ার কাঁপে ক্ষণে ক্ষণে,
ঘরের বাঁধন যায় বুঝি আজ টুটে॥
ধরিত্রী তাঁর অঙ্গনেতে নাচের তালে ওঠেন মেতে,
চঞ্চল তাঁর অঞ্চল যায় লুটে
প্রথম যুগের বচন শুনি মনে
নবশ্যামল প্রাণের নিকেতনে।
পুব-হাওয়া ধায় আকাশতলে, তার সাথে মোর ভাবনা চলে
কালহারা কোন্ কালের পানে ছুটে॥
আজ শ্রাবণের পূর্ণিমাতে কী এনেছিস বল্
আজ শ্রাবণের পূর্ণিমাতে কী এনেছিস বল্–
হাসির কানায় কানায় ভরা নয়নের জল॥
বাদল-হাওয়ায় দীর্ঘশ্বাসে যূথীবনের বেদন আসে–
ফুল-ফোটানোর খেলায় কেন ফুল-ঝরানোর ছল।
ও তুই কী এনেছিস বল্॥
ওগো, কী আবেশ হেরি চাঁদের চোখে,
ফেরে সে কোন্ স্বপন-লোকে।
মন বসে রয় পথের ধারে, জানে না সে পাবে কারে–
আসা-যাওয়ার আভাস ভাসে বাতাসে চঞ্চল।
ও তুই কী এনেছিস বল্॥
আজি ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার
আজি ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার
পরানসখা বন্ধু হে আমার॥
আকাশ কাঁদে হতাশ-সম, নাই যে ঘুম নয়নে মম–
দুয়ার খুলি হে প্রিয়তম, চাই যে বারে বার॥
বাহিরে কিছু দেখিতে নাহি পাই,
তোমার পথ কোথায় ভাবি তাই।
সুদূর কোন্ নদীর পারে, গহন কোন্ বনের ধারে
গভীর কোন্ অন্ধকারে হতেছ তুমি পার॥