বৃষ্টিশেষের হাওয়া কিসের খোঁজে
বৃষ্টিশেষের হাওয়া কিসের খোঁজে বইছে ধীরে ধীরে।
গুঞ্জরিয়া কেন বেড়ায় ও যে বুকের শিরে শিরে॥
অলখ তারে বাঁধা অচিন বীণা ধরার বক্ষে রহে নিত্য লীনা– এই হাওয়া
কত যুগের কত মনের কথা বাজায় ফিরে ফিরে॥
ঋতুর পরে ঋতু ফিরে আসে বসুন্ধরার কূলে
চিহ্ন পড়ে বনের ঘাসে ঘাসে ফুলের পরে ফুলে।
গানের পরে গানে তারি সাথে কত সুরের কত যে হার গাঁথে– এই হাওয়া
ধরার কণ্ঠ বাণীর বরণমালায় সাজায় ঘিরে ঘিরে॥
বেদনা কী ভাষায় রে
বেদনা কী ভাষায় রে
মর্মে মর্মরি গুঞ্জরি বাজে॥
সে বেদনা সমীরে সমীরে সঞ্চারে,
চঞ্চল বেগে বিশ্বে দিল দোলা ॥
দিবানিশা আছি নিদ্রাহারা বিরহে
তব নন্দনবন-অঙ্গনদ্বারে,
মনোমোহন বন্ধু–
আকুল প্রাণে
পারিজাতমালা সুগন্ধ হানে॥
বৈশাখ হে মৌনী তাপস কোন্ অতলের বাণী
বৈশাখ হে, মৌনী তাপস, কোন্ অতলের বাণী
এমন কোথায় খুঁজে পেলে।
তপ্ত ভালের দীপ্তি ঢাকি মন্থর মেঘখানি
এল গভীর ছায়া ফেলে॥
রুদ্রতপের সিদ্ধি এ কি ওই-যে তোমার বক্ষে দেখি,
ওরই লাগি আসন পাতো হোমহুতাশন জ্বেলে॥
নিঠুর, তুমি তাকিয়েছিলে মৃত্যুক্ষুধার মতো
তোমার রক্তনয়ন মেলে।
ভীষণ, তোমার প্রলয়সাধন প্রাণের বাঁধন যত
যেন হানবে অবহেলে।
হঠাৎ তোমার কণ্ঠে এ যে আশার ভাষা উঠল বেজে,
দিলে তরুণ শ্যামল রূপে করুণ সুধা ঢেলে॥
বৈশাখের এই ভোরের হাওয়া আসে মৃদুমন্দ
বৈশাখের এই ভোরের হাওয়া আসে মৃদুমন্দ।
আনে আমার মনের কোণে সেই চরণের ছন্দ॥
স্বপ্নশেষের বাতায়নে হঠাৎ-আসা ক্ষণে ক্ষণে
আধো-ঘুমের-প্রান্ত-ছোঁওয়া বকুলমালার গন্ধ॥
বৈশাখের এই ভোরের হাওয়া বহে কিসের হর্ষ,
যেন রে সেই উড়ে-পড়া এলো কেশের স্পর্শ।
চাঁপাবনের কাঁপন-ছলে লাগে আমার বুকের তলে
আরেক দিনের প্রভাত হতে হৃদয়দোলার স্পন্দ॥
ব্যাকুল বকুলের ফুলে ভ্রমর মরে পথ ভুলে
ব্যাকুল বকুলের ফুলে ভ্রমর মরে পথ ভুলে॥
আকাশে কী গোপন বাণী বাতাসে করে কানাকানি,
বনের অঞ্চলখানি পুলকে উঠে দুলে দুলে॥
বেদনা সুমধুর হয়ে ভুবনে আজি গেল বয়ে।
বাঁশিতে মায়া-তান পুরি কে আজি মন করে চুরি,
নিখিল তাই মরে ঘুরি বিরহসাগরের কূলে॥
ভেবেছিলেম আসবে ফিরে
ভেবেছিলেম আসবে ফিরে,
তাই ফাগুনশেষে দিলেম বিদায়।
তুমি গেলে ভাসি নয়ননীরে
এখন শ্রাবণদিনে মরি দ্বিধায়॥
এখন বাদল-সাঁঝের অন্ধকারে আপনি কাঁদাই আপনারে,
একা ঝরো ঝরো বারিধারে ভাবি কী ডাকে ফিরাব তোমায়॥
যখন থাক আঁখির কাছে
তখন দেখি ভিতর বাহির সব ভরে আছে।
সেই ভরা দিনের ভরসাতে চাই বিরহের ভয় ঘোচাতে,
তবু তোমা-হারা বিজন রাতে
কেবল হারাই-হারাই বাজে হিয়ায়॥
ভোর থেকে আজ বাদল ছুটেছে
ভোর থেকে আজ বাদল ছুটেছে– আয় গো আয়।
কাঁচা রোদখানি পড়েছে বনের ভিজে পাতায়॥
ঝিকি ঝিকি করি কাঁপিতেছে বট–
ওগো ঘাটে আয়, নিয়ে আয় ঘট–
পথের দু ধারে শাখে শাখে আজি পাখিরা গায়॥
তপন-আতপে আতপ্ত হয়ে উঠেছে বেলা,
কলস পাকড়ি আঁকড়িয়া বুকে
ভরা জলে তোরা ভেসে যাবি সুখে
তিমিরনিবিড় ঘনঘোরে ঘুমে স্বপনপ্রায়– আয় গো আয়॥
মেঘ ছুটে গেল, নাই গো বাদল– আয় গো আয়।
আজিকে সকালে শিথিল কোমল বহিছে বায়– আয় গো আয়।
এ ঘাট হইতে ও ঘাটে তাহার
কথা বলাবলি নাহি চলে আর,
একাকার হল তীরে আর নীরে তাল-তলায়– আয় গো আয়॥
ভোর হল যেই শ্রাবণশর্বরী
ভোর হল যেই শ্রাবণশর্বরী
তোমার বেড়ায় উঠল ফুটে হেনার মঞ্জরী॥
গন্ধ তারি রহি রহি বাদল-বাতাস আনে বহি,
আমার মনের কোণে কোণে বেড়ায় সঞ্চরি॥
বেড়া দিলে কবে তুমি তোমার ফুলবাগানে–
আড়াল ক’রে রেখেছিলে আমার বনের পানে।
কখন গোপন অন্ধকারে বর্ষারাতের অশ্রুধারে
তোমার আড়াল মধুর হয়ে ডাকে মর্মরি॥
মধু-গন্ধে ভরা মৃদু-স্নিগ্ধছায়া নীপ-কুঞ্জতলে
মধু -গন্ধে ভরা মৃদু -স্নিগ্ধছায়া নীপ -কুঞ্জতলে
শ্যাম -কান্তিময়ী কোন্ স্বপ্নমায়া ফিরে বৃষ্টিজলে॥
ফিরে রক্ত-অলক্তক-ধৌত পায়ে ধারা -সিক্ত বায়ে,
মেঘ -মুক্ত সহাস্য শশাঙ্ককলা সিঁথি -প্রান্তে জ্বলে॥
পিয়ে উচ্ছল তরল প্রলয়মদিরা উন্ -মুখর তরঙ্গিণী ধায় অধীরা,
কার নির্ভীক মূর্তি তরঙ্গদোলে কল -মন্দ্ররোলে।
এই তারাহারা নিঃসীম অন্ধকারে কার তরণী চলে॥
মধুর বসন্ত এসেছে মধুর মিলন ঘটাতে
মধুর বসন্ত এসেছে মধুর মিলন ঘটাতে।
মধুর মলয়-সমীরে মধুর মিলন রটাতে॥
কুহক লেখনী ছুটায়ে কুসুম তুলিছে ফুটায়ে,
লিখিছে প্রণয়-কাহিনী বিবিধ বরন-ছটাতে।
হেরো পুরানো প্রাচীন ধরণী হয়েছে শ্যামলবরনী,
যেন যৌবন-প্রবাহ ছুটিছে কালের শাসন টুটাতে;
পুরানো বিরহ হানিছে, নবীন মিলন আনিছে,
নবীন বসন্ত আইল নবীন জীবন ফুটাতে॥
মধ্যদিনে যবে গান বন্ধ করে পাখি
মধ্যদিনে যবে গান বন্ধ করে পাখি,
হে রাখাল, বেণু তব বাজাও একাকী॥
প্রান্তরপ্রান্তের কোণে রুদ্র বসি তাই শোনে,
মধুরের-স্বপ্নাবেশে-ধ্যানমগন-আঁখি–
হে রাখাল, বেণু যবে বাজাও একাকী॥
সহসা উচ্ছ্বসি উঠে ভরিয়া আকাশ
তৃষাতপ্ত বিরহের নিরুদ্ধ নিশ্বাস।
অম্বরপ্রান্তে যে দূরে ডম্বরু গম্ভীর সুরে
জাগায় বিদ্যুতছন্দে আসন্ন বৈশাখী–
হে রাখাল, বেণু যবে বাজাও একাকী॥