বসন্তে কি শুধু কেবল ফোটা ফুলের মেলা রে
বসন্তে কি শুধু কেবল ফোটা ফুলের মেলা রে।
দেখিস নে কি শুকনো পাতা ঝরা ফুলের খেলা রে।
যে ঢেউ ওঠে তারি সুরে বাজে কি গান সাগর জুড়ে।
যে ঢেউ পড়ে তাহারো সুর জাগছে সারা বেলা রে।
বসন্তে আজ দেখ্ রে তোরা ঝরা ফুলের খেলা রে॥
আমার প্রভুর পায়ের তলে শুধুই কি রে মানিক জ্বলে।
চরণে তাঁর লুটিয়ে কাঁদে লক্ষ মাটির ঢেলা রে॥
আমার গুরুর আসন-কাছে সুবোধ ছেলে ক’জন আছে।
অবোধ জনে কোল দিয়েছেন, তাই আমি তাঁর চেলা রে।
উৎসবরাজ দেখেন চেয়ে ঝরা ফুলের খেলা রে॥
বসন্তে-বসন্তে তোমার কবিরে দাও ডাক
বসন্তে-বসন্তে তোমার কবিরে দাও ডাক–
যায় যদি সে যাক॥
রইল তাহার বাণী রইল ভরা সুরে, রইবে না সে দূরে–
হৃদয় তাহার কুঞ্জে তোমার রইবে না নির্বাক্॥
ছন্দ তাহার রইবে বেঁচে
কিশলয়ের নবীন নাচে নেচে নেচে॥
তারে তোমার বীণা যায় না যেন ভুলে,
তোমার ফুলে ফুলে
মধুকরের গুঞ্জরনে বেদনা তার থাক্॥
বহু যুগের ও পার হতে
বহু যুগের ও পার হতে আষাঢ় এল আমার মনে,
কোন্ সে কবির ছন্দ বাজে ঝরো ঝরো বরিষনে॥
যে মিলনের মালাগুলি ধুলায় মিশে হল ধূলি
গন্ধ তারি ভেসে আসে আজি সজল সমীরণে॥
সে দিন এমনি মেঘের ঘটা রেবানদীর তীরে,
এমনি বারি ঝরেছিল শ্যামলশৈলশিরে।
মালবিকা অনিমিখে চেয়ে ছিল পথের দিকে,
সেই চাহনি এল ভেসে কালো মেঘের ছায়ার সনে॥
বাকি আমি রাখব না কিছুই
বাকি আমি রাখব না কিছুই–
তোমার চলার পথে পথে ছেয়ে দেব ভূঁই॥
ওগো মোহন, তোমার উত্তরীয় গন্ধে আমার ভরে নিয়ো,
উজাড় করে দেব পায়ে বকুল বেলা জুঁই॥
দখিনসাগর পার হয়ে-যে এলে পথিক তুমি।
আমার সকল দেব অতিথিরে আমি বনভূমি।
আমার কুলায়-ভরা রয়েছে গান, সব তোমারেই করেছি দান–
দেবার কাঙাল করে আমায় চরণ যখন ছুঁই॥
বাদল-ধারা হল সারা
বাদল-ধারা হল সারা, বাজে বিদায়-সুর।
গানের পালা শেষ ক’রে দে রে, যাবি অনেক দূর॥
ছাড়ল খেয়া ও পার হতে ভাদ্রদিনের ভরা স্রোতে রে,
দুলছে তরী নদীর পথে তরঙ্গবন্ধুর॥
কদমকেশর ঢেকেছে আজ বনতলের ধূলি,
মৌমাছিরা কেয়াবনের পথ গিয়েছে ভুলি।
অরণ্যে আজ স্তব্ধ হাওয়া, আকাশ আজি শিশির-ছাওয়া রে
আলোতে আজ স্মৃতির আভাস বৃষ্টির বিন্দুর॥
বাদল-বাউল বাজায় রে একতারা
বাদল-বাউল বাজায় রে একতারা–
সারা বেলা ধ’রে ঝরোঝরো ঝরো ধারা ॥
জামের বনে ধানের ক্ষেতে আপন তানে আপনি মেতে
নেচে নেচে হল সারা ॥
ঘন জটার ঘটা ঘনায় আঁধার আকাশ-মাঝে,
পাতায় পাতায় টুপুর টুপুর নূপুর মধুর বাজে।
ঘর-ছাড়ানো আকুল সুরে উদাস হয়ে বেড়ায় ঘুরে
পুবে হাওয়া গৃহহারা ॥
বাদল-মেঘে মাদল বাজে গুরুগুরু গগন-মাঝে
বাদল-মেঘে মাদল বাজে গুরুগুরু গগন-মাঝে॥
তারি গভীর রোলে আমার হৃদয় দোলে,
আপন সুরে আপনি ভোলে॥
কোথায় ছিল গহন প্রাণেগোপন ব্যথা গোপন গানে–
আজি সজল বায়ে শ্যামল বনের ছায়ে
ছড়িয়ে গেল সকলখানে গানে গানে॥
বাসন্তী হে ভুবনমোহিনী
বাসন্তী, হে ভুবনমোহিনী,
দিকপ্রান্তে, বনবনান্তে,
শ্যাম প্রান্তরে, আম্রছায়ে,
সরোবরতীরে, নদীনীরে
নীল আকাশে, ময়লবাতাসে
ব্যাপিল অনন্ত তব মাধুরী॥
নগরে গ্রামে কাননে, দিনে নিশীথে,
পিকসঙ্গীতে, নৃত্যগীতকলনে বিশ্ব আনন্দিত।
ভবনে ভবনে বীণাতান রণ-রণ ঝঙ্কৃত।
মধুমদমোদিত হৃদয়ে হৃদয়ে রে
নবপ্রাণ উচ্ছ্বসিল আজি,
বিচলিত চিত উচ্ছলি উন্মাদনা
ঝন-ঝন ঝনিল মঞ্জীরে মঞ্জীরে॥
বিদায় নিয়ে গিয়েছিলেম বারে বারে
বিদায় নিয়ে গিয়েছিলেম বারে বারে।
ভেবেছিলেম ফিরব না রে॥
এই তো আবার নবীন বেশে
এলেম তোমার হৃদয়-দ্বারে॥
কে গো তুমি।– “আমি বকুল।’
কে গো তুমি।– “আমি পারুল।’
তোমরা কে বা।– “আমরা আমের মুকুল গো
এলেম আবার আলোর পারে।’
‘এবার যখন ঝরব মোরা ধরার বুকে
ঝরব তখন হাসিমুখে–
অফুরানের আঁচল ভ’রে
মরব মোরা প্রাণের সুখে।’
তুমি কে গো।– “আমি শিমুল।’
তুমি কে গো।– “কামিনী ফুল।’
তোমরা কে বা।– “আমার নবীন পাতা গো
শালের বনে ভারে ভারে।’
বিদায় যখন চাইবে তুমি দক্ষিণসমীরে
বিদায় যখন চাইবে তুমি দক্ষিণসমীরে
তোমায় ডাকব না তো ফিরে।
করব তোমায় কী সম্ভাষণ, কোথায় তোমার পাতব আসন
পাতা-ঝরা কুসুম-ঝরা নিকুঞ্জকুটিরে॥
তুমি আপনি যখন আসো তখন আপ্নি কর ঠাঁই–
আপনি কুসুম ফোটাও, মোরা তাই দিয়ে সাজাই।
তুমি যখন যাও চলে যাও সব আয়োজন হয়-যে উধাও–
গান ঘুচে যায়, রঙ মুছে যায়, তাকাই অশ্রুনীরে॥
বিশ্ববীণারবে বিশ্বজন মোহিছে
বিশ্ববীণারবে বিশ্বজন মোহিছে।
স্থলে জলে নভতলে বনে উপবনে
নদীনদে গিরিগুহা-পারাবারে
নিত্য জাগে সরস সঙ্গীতমধুরিমা,
নিত্য নৃত্যরসভঙ্গিমা।–
নব বসন্তে নব আনন্দ, উৎসব নব।
অতি মঞ্জুল, অতি মঞ্জুল, শুনি মঞ্জুল গুঞ্জন কুঞ্জে–
শুনি রে শুনি মর্মর পল্লবপুঞ্জে,
পিককূজন পুষ্পবনে বিজনে,
মৃদু বায়ুহিলোলবিলোল বিভোল বিশাল সরোবর-মাঝে
কলগীত সুললিত বাজে।
শ্যামল কান্তার-‘পরে অনিল সঞ্চারে ধীরে রে,
নদীতীরে শরবনে উঠে ধ্বনি সরসর মরমর।
কত দিকে কত বাণী, নব নব কত ভাষা, ঝরঝর রসধারা ॥
আষাঢ়ে নব আনন্দ, উৎসব নব।
অতি গম্ভীর, অতি গম্ভীর নীল অম্বরে ডম্বরু বাজে,
যেন রে প্রলয়ঙ্করী শঙ্করী নাচে।
করে গর্জন নির্ঝরিণী সঘনে,
হেরো ক্ষুব্ধ ভয়াল বিশাল নিরাল পিয়ালতমালবিতানে
উঠে রব ভৈরবতানে।
পবন মল্লারগীত গাহিছে আঁধার রাতে,
উন্মাদিনী সৌদামিনী রঙ্গভরে নৃত্য করে অম্বরতলে।
দিকে দিকে কত বাণী, নব নব কত ভাষা, ঝরঝর রসধারা ॥
আশ্বিনে নব আনন্দ, উৎসব নব।
অতি নির্মল, অতি নির্মল, অতি নির্মল উজ্জ্বল সাজে
ভুবনে নব শারদলক্ষ্ণী বিরাজে।
নব ইন্দুলেখা অলকে ঝলকে
অতি নির্মল হাসবিভাসবিকাশ আকাশনীলাম্বুজ-মাঝে
শ্বেত ভুজে শ্বেত বীণা বাজে–
উঠিছে আলাপ মৃদু মধুর বেহাগতানে,
চন্দ্রকরে উল্লসিত ফুল্লবনে ঝিল্লিরবে তন্দ্রা আনে রে।
দিকে দিকে কত বাণী, নব নব কত ভাষা, ঝরঝর রসধারা ॥