পথিক মেঘের দল জোটে ওই শ্রাবণগগন-অঙ্গনে
পথিক মেঘের দল জোটে ওই শ্রাবণগগন-অঙ্গনে।
শোন্ শোন্ রে, মন রে আমার, উধাও হয়ে নিরুদ্দেশের সঙ্গ নে॥
দিক্-হারানো দুঃসাহসে সকল বাঁধন পড়ুক খসে,
কিসের বাধা ঘরের কোণের শাসনসীমা-লঙ্ঘনে॥
বেদনা তোর বিজুলশিখা জ্বলুক অন্তরে।
সর্বনাশের করিস সাধন বজ্রমন্তরে।
অজানাতে করবি গাহন, ঝড় সে পথের হবে বাহন–
শেষ করে দিস আপনারে তুই প্রলয় রাতের ক্রন্দনে॥
পাগলা হাওয়ার বাদল-দিনে
পাগলা হাওয়ার বাদল-দিনে
পাগল আমার মন জেগে ওঠে॥
চেনাশোনার কোন্ বাইরে যেখানে পথ নাই নাই রে
সেখানে অকারণে যায় ছুটে॥
ঘরের মুখে আর কি রে কোনো দিন সে যাবে ফিরে।
যাবে না, যাবে না–
দেয়াল যত সব গেল টুটে॥
বৃষ্টি-নেশা-ভরা সন্ধ্যাবেলা কোন্ বলরামের আমি চেলা,
আমার স্বপ্ন ঘিরে নাচে মাতাল জুটে–
যত মাতাল জুটে।
যা না চাইবার তাই আজি চাই গো,
যা না পাইবার তাই কোথা পাই গো।
পাব না, পাব না,
মরি অসম্ভবের পায়ে মাথা কুটে॥
পুব-সাগরের পার হতে কোন্ এল পরবাসী
পুব-সাগরের পার হতে কোন্ এল পরবাসী–
শূন্যে বাজায় ঘন ঘন হাওয়ায় হাওয়ায় সন সন
সাপ খেলাবার বাঁশি॥
সহসা তাই কোথা হতে কুলু কুলু কলস্রোতে
দিকে দিকে জলের ধারা ছুটেছে উল্লাসী॥
আজ দিগন্তে ঘন ঘন গভীর গুরু গুরু ডমরুর হয়েছে ওই শুরু।
তাই শুনে আজ গগনতলে পলে পলে দলে দলে
অগ্নিবরন নাগ নাগিনী ছুটেছে উদাসী॥
পুব-হাওয়াতে দেয় দোলা আজ
পুব-হাওয়াতে দেয় দোলা আজ মরি মরি।
হৃদয়নদীর কূলে কূলে জাগে লহরী॥
পথ চেয়ে তাই একলা ঘাটে বিনা কাজে সময় কাটে,
পাল তুলে ওই আসে তোমার সুরেরই তরী॥
ব্যথা আমার কূল মানে না, বাধা মানে না।
পরান আমার ঘুম জানে না, জাগা জানে না।
মিলবে যে আজ অকুল-পানে তোমার গানে আমার গানে,
ভেসে যাবে রসের বানে আজ বিভাবরী॥
পুরাতনকে বিদায় দিলে না যে
পুরাতনকে বিদায় দিলে না যে ওগো নবীন রাজা।
শুধু বাঁশি তোমার বাজালে তার পরান মাঝে ওগো নবীন রাজা ॥
মন্ত্র যে তার লাগল প্রাণে মোহন গানে হায়,
বিকশিয়া উঠল হিয়া নবীন সাজে ওগো নবীন রাজা ॥
তোমার রঙে দিলে তুমি রাঙিয়া ও তার আঙিয়া ওগো নবীন রাজা।
তোমার মালা দিলে গলে খেলার ছলে হায়–
তোমার সুরে সুরে তাহার বীণা বাজে ওগো নবীন রাজা ॥
পুষ্প ফুটে কোন্ কুঞ্জবনে
পুষ্প ফুটে কোন্ কুঞ্জবনে
কোন্ নিভৃতে ওরে, কোন্ গহনে।
মাতিল আকুল দক্ষিণবায়ু সৌরভচঞ্চল সঞ্চরণে॥
বন্ধুহারা মম অন্ধ ঘরে আছি বসে অবসন্নমনে,
উৎসবরাজ কোথায় বিরাজে কে লয়ে যাবে সে ভবনে॥
পূর্ণচাঁদের মায়ায় আজি ভাবনা আমার পথ ভোলে
পূর্ণচাঁদের মায়ায় আজি ভাবনা আমার পথ ভোলে,
যেন সিন্ধুপারের পাখি তারা, যা য় যা য় যায় চলে॥
আলোছায়ার সুরে অনেক কালের সে কোন্ দূরে
ডাকে আ য় আ য় আয় ব’লে॥
যেথায় চলে গেছে আমার হারা ফাগুনরাতি
সেথায় তারা ফিরে ফিরে খোঁজে আপন সাথি।
আলোছায়ায় যেথা অনেক দিনের সে কোন্ ব্যথা
কাঁদে হা য় হা য় হায় ব’লে॥
পূর্বাচলের পানে তাকাই অস্তাচলের ধারে আসি
পূর্বাচলের পানে তাকাই অস্তাচলের ধারে আসি।
ডাক দিয়ে যার সাড়া না পাই তার লাগি আজ বাজাই বাঁশি॥
যখন এ কূল যাব ছাড়ি পারের খেয়ায় দেব পাড়ি,
মোর ফাগুনের গানের বোঝা বাঁশির সাথে যাবে ভাসি॥
সেই-যে আমার বনের গলি রঙিন ফুলে ছিল আঁকা
সেই ফুলেরই ছিন্ন দলে চিহ্ন যে তার পড়ল ঢাকা।
মাঝে মাঝে কোন্ বাতাসে চেনা দিনের গন্ধ আসে,
হঠাৎ বুকে চমক লাগায় আধ-ভোলা সেই কান্নাহাসি॥
পোহালো পোহালো বিভাবরী
পোহালো পোহালো বিভাবরী,
পূর্বতোরণে শুনি বাঁশরি॥
নাচে তরঙ্গ, তরী অতি চঞ্চল, কম্পিত অংশুককেতন-অঞ্চল,
পল্লবে পল্লবে পাগল জাগল আলসলালস পাসরি॥
উদয়-অচলতল সাজিল নন্দন, গগনে গগনে বনে জাগিল বন্দন,
কনককিরণঘন শোভন স্যন্দন– নামিছে শারদসুন্দরী।
দশদিক-অঙ্গনে দিগঙ্গনাদল ধ্বনির শূন্য ভরি শঙ্খ সুমঙ্গল–
চলো রে চলো চলো তরুণযাত্রীদল তুলি নব মালতীমঞ্জরী॥
পৌষ তোদের ডাক দিয়েছে
পৌষ তোদের ডাক দিয়েছে, আয় রে চলে, আ য় আ য় আয়।
ডালা যে তার ভরেছে আজ পাকা ফসলে, মরি হায় হায় হায়॥
হাওয়ার নেশায় উঠল মেতে দিগ্বধূরা ধানের ক্ষেতে–
রোদের সোনা ছড়িয়ে পড়ে মাটির আঁচলে, মরি হা য় হা য় হায়॥
মাঠের বাঁশি শুনে শুনে আকাশ খুশি হল।
ঘরেতে আজ কে রবে গো, খোলো খোলো দুয়ার খোলো।
আলোর হাসি উঠল জেগে ধানের শিষে শিশির লেগে–
ধরার খুশি ধরে না গো, ওই-যে উথলে, মরি হা য় হা য় হায়॥
প্রখর তপনতাপে আকাশ তৃষায় কাঁপে
প্রখর তপনতাপে আকাশ তৃষায় কাঁপে,
বায়ু করে হাহাকার।
দীর্ঘপথের শেষে ডাকি মন্দিরে এসে,
“খোলো খোলো খোলো দ্বার॥
বাহির হয়েছি কবে কার আহ্বানরবে,
এখনি মলিন হবে প্রভাতের ফুলহার॥
বুকে বাজে আশাহীনা ক্ষীণমর্মর বীণা,
জানি না কে আছে কিনা, সাড়া তো না পাই তার।
আজি সারা দিন ধ’রে প্রাণে সুর ওঠে ভরে,
একেলা কেমন ক’রে বহিব গানের ভার॥
ফল ফলাবার আশা আমি মনে রাখি নি রে
ফল ফলাবার আশা আমি মনে রাখি নি রে।
আজ আমি তাই মুকুল ঝরাই দক্ষিণসমীরে॥
বসন্তগান পাখিরা গায়, বাতাসে তার সুর ঝরে যায়–
মুকুল-ঝরার ব্যাকুল খেলা আমারি সেই রাগিণীরে॥
জানি নে ভাই, ভাবি নে তাই কী হবে মোর দশা
যখন আমার সারা হবে সকল ঝরা খসা।
এই কথা মোর শূন্য ডালে বাজবে সে দিন তালে তালে–
“চরম দেওয়ায় সব দিয়েছি মধুর মধুযামিনীরে’॥