নমো নমো হে বৈরাগী
নমো নমো, হে বৈরাগী।
তপোবহ্নির শিখা জ্বালো জ্বালো,
নির্বাণহীন নির্মল আলো
অন্তরে থাক্ জাগি॥
না যেয়ো না যেয়ো নাকো
না, যেয়ো না, যেয়ো নাকো।
মিলনপিয়াসী মোরা– কথা রাখো, কথা রাখো॥
আজো বকুল আপনহারা হায় রে, ফুল ফোটানো হয় নি সারা,
সাজি ভরে নি–
পথিক ওগো, থাকো থাকো॥
চাঁদের চোখে জাগে নেশা,
তার আলো গানে গন্ধে মেশা।
দেখো চেয়ে কোন্ বেদনায় হায় রে মল্লিকা ওই যায় চলে যায়
অভিমানিনী–
পথিক, তারে ডাকো ডাকো॥
নাই রস নাই দারুণ দাহনবেলা
নাই রস নাই, দারুণ দাহনবেলা। খেলো খেলো তব নীরব ভৈরব খেলা ॥
যদি ঝ’রে পড়ে পড়ুক পাতা, ম্লান হয়ে যাক মালা গাঁথা,
থাক্ জনহীন পথে পথে মরীচিকাজাল ফেলা ॥
শুষ্ক ধুলায় খসে-পড়া ফুলদলে ঘূর্ণী-আঁচল উড়াও আকাশতলে।
প্রাণ যদি কর মরুসম তবে তাই হোক– হে নির্মম,
তুমি একা আর আমি একা, কঠোর মিলনমেলা ॥
নিবিড় অন্তরতর বসন্ত এল প্রাণে
নিবিড় অন্তরতর বসন্ত এল প্রাণে।
জগতজনহৃদয়ধন, চাহি তব পানে॥
হরষরস বরষি যত তৃষিত ফুলপাতে
কুঞ্জকাননপবন পরশ তব আনে।|
মুগ্ধ কোকিল মুখর রাত্রি দিন যাপে,
মর্মরিত পল্লবিত সকল বন কাঁপে।
দশ দিশি সুরম্য সুন্দর মধুর হেরি,
দুঃখ হল দূর সব-দৈন্য-অবসানে॥
নিবিড় অমা-তিমির হতে বাহির হল জোয়ার-স্রোতে
নিবিড় অমা-তিমির হতে বাহির হল জোয়ার-স্রোতে
শুক্লরাতে চাঁদের তরণী।
ভরিল ভরা অরূপ ফুলে, সাজালো ডালা অমরাকূলে
আলোর মালা চামেলি-বরনী॥
তিথির পরে তিথির ঘাটে আসিছে তরী দোলের নাটে,
নীরবে হাসে স্বপনে ধরণী।
উৎসবের পসরা নিয়ে পূর্ণিমার কূলেতে কি এ
ভিড়িল শেষে তন্দ্রাহরণী॥
নিবিড় মেঘের ছায়ায় মন দিয়েছি মেলে
নিবিড় মেঘের ছায়ায় মন দিয়েছি মেলে,
ওগো প্রবাসিনী, স্বপনে তব
তাহার বারতা কি পেলে॥
আজি তরঙ্গকলকল্লোলে দক্ষিণসিন্ধুর ক্রন্দনধ্বনি
আনে বহিয়া কাহার বিরহ॥
লুপ্ত তারার পথে চলে কাহার সুদূর স্মৃতি
নিশীথরাতের রাগিণী বহি।
নিদ্রাবিহীন ব্যথিত হৃদয়
ব্যর্থ শূন্যে তাকায়ে রহে॥
নির্মল কান্ত নমো হে নমো
নির্মল কান্ত, নমো হে নমো, নমো হে, নমো হে।
স্নিগ্ধ সুশান্ত, নমো হে নমো, নমো হে, নমো হে।
বন-অঙ্গন-ময় রবিকররেখা
লেপিল আলিম্পনলিপি-লেখা,
আঁকিব তাহে প্রণতি মম।
নমো হে নমো, নমো হে নমো, নমো হে নমো ॥
নিশীথরাতের প্রাণ
নিশীথরাতের প্রাণ
কোন্ সুধা যে চাঁদের আলোয় আজ করেছে পান॥
মনের সুখে তাই আজ গোপন কিছু নাই,
আঁধার ঢাকা ভেঙে ফেলে সব করেছে দান॥
দখিন-হাওয়ায় তার সব খুলেছে দ্বার।
তারি নিমন্ত্রণে আজি ফিরি বনে বনে,
সঙ্গে করে এনেছি এই
রাত-জাগা মোর গান॥
নীল দিগন্তে ওই ফুলের আগুন লাগল
নীল দিগন্তে ওই ফুলের আগুন লাগল,
বসন্তে সৌরভের শিখা জাগল॥
আকাশের লাগে ধাঁদা রবির আলো ওই কি বাঁধা ॥
বুঝি ধরার কাছে আপনাকে সে মাগল,
সর্ষেক্ষেতে ফুল হয়ে তাই জাগল॥
নীল দিগন্তে মোর বেদনখানি লাগল,
অনেক কালের মনের কথা জাগল।
এল আমার হারিয়ে-যাওয়া কোন্ ফাগুনের পাগল হাওয়া।
বুঝি এই ফাগুনে আপনাকে সে মাগল,
সর্ষেক্ষেতে ঢেউ হয়ে তাই জাগল॥
নীল আকাশের কোণে কোণে
নীল আকাশের কোণে কোণে ওই বুঝি আজ শিহর লাগে আহা।
শাল-পিয়ালের বনে বনে কেমন যেন কাঁপন জাগে আহা ॥
সুদূরে কার পায়ের ধ্বনি গণি গণি দিন-রজনী
ধরণী তার চরণ মাগে আহা ॥
দখিন-হাওয়া ক্ষণে ক্ষণে কেন ডাকিস “জাগো জাগো’।
ফিরিস মেতে শিরীষবনে, শোনাস কানে কোন্ কথা গো।
শূন্যে তোমার ওগো প্রিয় উত্তরীয় উড়ল কি ও
রবির আলো রঙিন রাগে আহা ॥
নীল নবঘনে আষাঢ়গগনে তিল ঠাঁই আর নাহি রে
নীল নবঘনে আষাঢ়গগনে তিল ঠাঁই আর নাহি রে।
ওগো, আজ তোরা যাস নে ঘরের বাহিরে॥
বাদলের ধারা ঝরে ঝরো-ঝরো, আউষের ক্ষেত জলে ভরো-ভরো,
কালিমাখা মেঘে ও পারে আঁধার ঘনিয়েছে দেখ্ চাহি রে॥
ওই শোনো শোনো পারে যাবে ব’লে কে ডাকিছে বুঝি মাঝিরে।
খেয়া-পারাপার বন্ধ হয়েছে আজি রে।
পুবে হাওয়া বয়, কূলে নেই কেউ, দু কূল বাহিয়া উঠে পড়ে ঢেউ–
দরো-দরো বেগে জলে পড়ি জল ছলো-ছল উঠে বাজি রে।
খেয়া-পারাপার বন্ধ হয়েছে আজি রে॥
ওই ডাকে শোনো ধেনু ঘন ঘন, ধবলীরে আনো গোহালে
এখনি আঁধার হবে বেলাটুকু পোহালে।
দুয়ারে দাঁড়ায়ে ওগো দেখ্ দেখি, মাঠে গেছে যারা তারা ফিরিছে কি,
রাখালবালক কী জানি কোথায় সারা দিন আজি খোয়ালে।
এখনি আঁধার হবে বেলাটুকু পোহালে॥
ওগো, আজ তোরা যাস নে গো তোরা যাস নে ঘরের বাহিরে।
আকাশ আঁধার, বেলা বেশি আর নাহি রে।
ঝরো-ঝরো ধারে ভিজিবে নিচোল, ঘাটে যেতে পথ হয়েছে পিছল–
ওই বেণুবন দোলে ঘন ঘন পথপাশে দেখ্ চাহি রে॥
নীল- অঞ্জনঘন পুঞ্জছায়ায় সম্বৃত অম্বর হে গম্ভীর
নীল- অঞ্জনঘন পুঞ্জছায়ায় সম্বৃত অম্বর হে গম্ভীর!
বনলক্ষ্মীর কম্পিত কায়, চঞ্চল অন্তর–
ঝঙ্কৃত তার ঝিল্লির মঞ্জীর হে গম্ভীর॥
বর্ষণগীত হল মুখরিত মেঘমন্দ্রিত ছন্দে,
কদম্ববন গভীর মগন আনন্দঘন গন্ধে–
নন্দিত তব উৎসবমন্দির হে গম্ভীর॥
দহনশয়নে তপ্ত ধরণী পড়েছিল পিপাসার্তা,
পাঠালে তাহারে ইন্দ্রলোকের অমৃতবারির বার্তা।
মাটির কঠিন বাধা হল ক্ষীণ, দিকে দিকে হল দীর্ণ–
নব অঙ্কুর-জয়পতাকায় ধরাতল সমাকীর্ণ–
ছিন্ন হয়েছে বন্ধন বন্দীর হে গম্ভীর॥