থামাও রিমিকি-ঝিমিকি বরিষন
থামাও রিমিকি-ঝিমিকি বরিষন, ঝিল্লিঝনক-ঝন-নন, হে শ্রাবণ।
ঘুচাও ঘুচাও স্বপ্নমোহ-অবগুণ্ঠন ঘুচাও॥
এসো হে, এসো হে, দুর্দম বীর এসো হে।
ঝড়ের রথে অগম পথে জড়ের বাধা যত করো উন্মূলন॥
জ্বালো জ্বালো বিদ্যুতশিখা জ্বালো,
দেখাও তিমিরভেদী দীপ্তি তোমার দেখাও।
দিগ্বিজয়ী তব বাণী দেহো আনি, গগনে গগনে সুপ্তিভেদী তব গর্জন জাগাও॥
দখিন-হাওয়া জাগো জাগো
দখিন-হাওয়া, জাগো জাগো, জাগাও আমার সুপ্ত এ প্রাণ।
আমি বেণু, আমার শাখায় নীরব-যে হায় কত-না গান। জাগো জাগো॥
পথের ধারে আমার কারা ওগো পথিক বাঁধনহারা,
নৃত্য তোমার চিত্তে আমার মুক্তিদোলা করে যে দান। জাগো জাগো॥
গানের পাখা যখন খুলি বাধা-বেদন তখন ভুলি।
যখন আমার বুকের মাঝে তোমার পথের বাঁশি বাজে
বন্ধভাঙার ছন্দে আমার মৌন-কাঁদন হয় অবসান। জাগো জাগো॥
দারুণ অগ্নিবাণে রে হৃদয় তৃষায় হানে রে
দারুণ অগ্নিবাণে রে হৃদয় তৃষায় হানে রে॥
রজনী নিদ্রাহীন, দীর্ঘ দগ্ধ দিন
আরাম নাহি যে জানে রে॥
শুষ্ক কাননশাখে ক্লান্ত কপোত ডাকে
করুণ কাতর গানে রে॥
ভয় নাহি, ভয় নাহি। গগনে রয়েছি চাহি।
জানি ঝঞ্ঝার বেশে দিবে দেখা তুমি এসে
একদা তাপিত প্রাণে রে॥
দিনশেষে বসন্ত যা প্রাণে গেল ব’লে
দিনশেষে বসন্ত যা প্রাণে গেল ব’লে
তাই নিয়ে বসে আছি, বীণাখানি কোলে॥
তারি সুর নেব ধরে
আমারি গানেতে ভরে,
ঝরা মাধবীর সাথে যায় সে যে চলে॥
থামো থামো দখিনপবন,
কী বারতা এনেছ তা কোরো না গোপন।
যে দিনেরে নাই মনে তুমি তারি উপবনে
কী ফুল পেয়েছ খুঁজে– গন্ধে প্রাণ ভোলে॥
দেখো দেখো দেখো শুকতারা আঁখি মেলি চায়
দেখো দেখো, দেখো, শুকতারা আঁখি মেলি চায়
প্রভাতের কিনারায়।
ডাক দিয়েছে রে শিউলি ফুলেরে–
আ য় আ য় আ য়॥
ও যে কার লাগি জ্বালে দীপ,
কার ললাটে পরায় টিপ,
ও যে কার আগমনী গায়– আ য় আ য় আয়।
জাগো জাগো সখী,
কাহার আশায় আকাশ উঠিল পুলকি।
মালতীর বনে বনে ওই শোনো ক্ষণে ক্ষণে
কহিছে শিশিরবায়– আ য় আ য় আয়॥
দোলে দোলে দোলে প্রেমের দোলন-চাঁপা হৃদয়-আকাশে
দোলে দোলে দোলে প্রেমের দোলন-চাঁপা হৃদয়-আকাশে,
দোল-ফাগুনের চাঁদের আলোর সুধায় মাখা সে॥
কৃষ্ণরাতের অন্ধকারে বচনহারা ধ্যানের পারে
কোন্ স্বপনের পর্ণপুটে ছিল ঢাকা সে॥
দখিন-হাওয়ায় ছড়িয়ে গেল গোপন-রেণুকা।
গন্ধে তারি ছন্দে মাতে কবির বেণুকা।
কোমল প্রাণের পাতে পাতে লাগল যে রঙ পূর্ণিমাতে
আমার গানের সুরে সুরে রইল আঁকা সে॥
ধরণী দূরে চেয়ে কেন আজ আছিস জেগে
ধরণী, দূরে চেয়ে কেন আজ আছিস জেগে
যেন কার উত্তরীয়ের পরশের হরষ লেগে॥
আজি কার মিলনগীতি ধ্বনিছে কাননবীথি,
মুখে চায় কোন্ অতিথি আকাশের নবীন মেঘে॥
ঘিরেছিস মাথার বসন কদমের কুসুমডোরে,
সেজেছিস নয়নপাতে নীলিমার কাজল প’রে।
তোমার ওই বক্ষতলে নবশ্যাম দুর্বাদলে
আলোকের ঝলক ঝলে পরানের পুলকবেগে॥
ধরণীর গগনের মিলনের ছন্দে
ধরণীর গগনের মিলনের ছন্দে
বাদলবাতাস মাতে মালতীর গন্ধে॥
উৎসবসভা-মাঝে শ্রাবণের বীণা বাজে,
শিহরে শ্যামল মাটি প্রাণের আনন্দে॥
দুই কূল আকুলিয়া অধীর বিভঙ্গে
নাচন উঠিল জেগে নদীর তরঙ্গে।
কাঁপিছে বনের হিয়া বরষনে মুখরিয়া,
বিজলি ঝলিয়া ওঠে নবঘনমন্দ্রে॥
ধীরে ধীরে ধীরে বও ওগো উতল হাওয়া
ধীরে ধীরে ধীরে বও ওগো উতল হাওয়া।
নিশীথরাতের বাঁশি বাজে– শান্ত হও গো, শান্ত হও।
আমি প্রদীপশিখা তোমার লাগি ভয়ে ভয়ে একা জাগি,
মনের কথা কানে-কানে মৃদু মৃদু কও॥
তোমার দূরের গাথা তোমার বনের বাণী
ঘরের কোণে দেহো আনি।
আমার কিছু কথা আছে ভোরের বেলায় তারার কাছে,
সেই কথাটি তোমার কানে চুপি চুপি লও॥
নব কুন্দধবলদলসুশীতলা
নব কুন্দধবলদলসুশীতলা,
অতি সুনির্মলা, সুখসমুজ্জ্বলা,
শুভ সুবর্ণ-আসনে অচঞ্চলা ॥
স্মিত-উদয়ারুণ-কিরণ-বিলাসিনী,
পূর্ণসিতাংশুবিভাসবিকাশিনী,
নন্দনলক্ষ্ণীসুমঙ্গলা ॥
নব নব পল্লবরাজি
নব নব পল্লবরাজি
সব বন উপবনে উঠে বিকশিয়া,
দখিনপবনে সঙ্গীত উঠে বাজি॥
মধুর সুগন্ধে আকুল ভুবন, হাহা করিছে মম জীবন।
এসো এসো সাধনধন, মম মন করো পূর্ণ আজি॥
নব বসন্তের দানের ডালি
নব বসন্তের দানের ডালি
এনেছি তোদেরই দ্বারে,
আয় আয় আয়,
পরিবি গলার হারে॥
লতার বাঁধন হারায়ে মাধবী মরিছে কেঁদে–
বেণীর বাঁধনে রাখিবি বেঁধে,
অলকদোলায় দুলাবি তারে,
আয় আয় আয়।
বনমাধুরী করিবি চুরি আপন নবীন মাধুরীতে–
সোহিনী রাগিণী জাগাবে সে তোদের
দেহের বীণার তারে তারে,
আয় আয় আয়॥
নমো নমো
নমো, নমো। নমো, নমো। নমো, নমো।
নির্দয় অতি করুণা তোমার– বন্ধু, তুমি হে নির্মম॥
যা-কিছু জীর্ণ করিবে দীর্ণ
দণ্ড তোমার দুর্দম॥
নমো নমো নমো
নমো, নমো, নমো।
নমো, নমো, নমো।
তুমি ক্ষুধার্তজনশরণ্য,
অমৃত-অন্ন-ভোগধন্য করো অন্তর মম॥
নমো নমো নমো করুণাঘন নমো হে
নমো, নমো, নমো করুণাঘন, নমো হে।
নয়ন স্নিগ্ধ অমৃতাঞ্জনপরশে,
জীবন পূর্ণ সুধারসবরষে,
তব দর্শনধনসার্থক মন হে, অকৃপণবর্ষণ করুণাঘন হে॥
নমো নমো নমো নমো
নমো নমো, নমো নমো, নমো নমো, তুমি সুন্দরতম।
নমো নমো নমো।
দূর হইল দৈন্যদ্বন্দ্ব, ছিন্ন হইল দুঃখবন্ধ–
উৎসবপতি মহানন্দ তুমি সুন্দরতম॥