ঝরা পাতা গো আমি তোমারি দলে
ঝরা পাতা গো, আমি তোমারি দলে।
অনেক হাসি অনেক অশ্রুজলে
ফাগুন দিল বিদায়মন্ত্র আমার হিয়াতলে॥
ঝরা পাতা গো, বসন্তী রঙ দিয়ে
শেষের বেশে সেজেছ তুমি কি এ।
খেলিলে হোলি ধূলায় ঘাসে ঘাসে
বসন্তের এই চরম ইতিহাসে।
তোমারি মতো আমারো উত্তরী
আগুন-রঙে দিয়ো রঙিন করি–
অস্তরবি লাগাক পরশমণি
প্রাণের মম শেষের সম্বলে॥
ঝরে ঝরো ঝরো ভাদরবাদর
ঝরে ঝরো ঝরো ভাদরবাদর, বিরহকাতর শর্বরী।
ফিরিছে এ কোন্ অসীম রোদন কানন কানন মর্মরি॥
আমার প্রাণের রাগিণী আজি এ গগনে গগনে উঠিছে বাজিয়ে।
মোর হৃদয় একি রে ব্যাপিল তিমিরে সমীরে সমীরে সঞ্চরি॥
ঝরো-ঝরো ঝরো-ঝরো ঝরে রঙের ঝর্না
ঝরো-ঝরো ঝরো-ঝরো ঝরে রঙের ঝর্না।
আ য় আ য় আ য় আয় সে রসের সুধায় হৃদয় ভর্-না ॥
সেই মুক্ত বন্যাধারায় ধারায় চিত্ত মৃত্যু-আবেশ হারায়,
ও সেই রসের পরশ পেয়ে ধরা নিত্যনবীনবর্ণা ॥
তার কলধ্বনি দখিন-হাওয়ায় ছড়ায় গগনময়,
মর্মরিয়া আসে ছুটে নবীন কিশলয়।
বনের বীণায় বীণায় ছন্দ জাগে বসন্তপঞ্চমের রাগে–
ও সেই সুরে সুরে সুর মিলিয়ে আনন্দগান ধর্-না ॥
তপের তাপের বাঁধন কাটুক রসের বর্ষণে
তপের তাপের বাঁধন কাটুক রসের বর্ষণে।
হৃদয় আমার, শ্যামল-বঁধুর করুণ স্পর্শ নে॥
অঝোর-ঝরন শ্রাবণজলে তিমিরমেদুর বনাঞ্চলে
ফুটুক সোনার কদম্বফুল নিবিড় হর্ষণে॥
ভরুক গগন, ভরুক কানন, ভরুক নিখিল ধরা,
পরান-ভরানো ঘনছায়াজাল বাহির-আকাশ করুক আড়াল–
নয়ন ভুলুক, বিজুলি ঝলুক পরম দর্শনে॥
তিমির-অবগুণ্ঠনে বদন তব ঢাকি
তিমির-অবগুণ্ঠনে বদন তব ঢাকি
কে তুমি মম অঙ্গনে দাঁড়ালে একাকী॥
আজি সঘন শর্বরী, মেঘমগন তারা,
নদীর জলে ঝর্ঝরি ঝরিছে জলধারা,
তমালবন মর্মরি পবন চলে হাঁকি॥
যে কথা মম অন্তরে আনিছ তুমি টানি
জানি না কোন্ মন্তরে তাহারে দিব বাণী।
রয়েছি বাঁধা বন্ধনে, ছিঁড়িব, যাব বাটে–
যেন এ বৃথা ক্রন্দনে এ নিশি নাহি কাটে।
কঠিন বাধা-লঙ্ঘনে দিব না আমি ফাঁকি॥
তুমি কোন্ পথে যে এলে পথিক
তুমি কোন্ পথে যে এলে পথিক আমি দেখি নাই তোমারে।
হঠাৎ স্বপন-সম দেখা দিলে বনেরই কিনারে॥
ফাগুনে যে বাণ ডেকেছে মাটির পাথারে।
তোমার সবুজ পালে লাগল হাওয়া, এলে জোয়ারে।
ভেসে এলে জোয়ারে– যৌবনের জোয়ারে॥
কোন্ দেশে যে বাসা তোমার কে জানে ঠিকানা।
কোন্ গানের সুরের পারে তার পথের নাই নিশানা।
তোমার সেই দেশেরই তরে আমার মন যে কেমন করে–
তোমার মালার গন্ধে তারি আভাস আমার প্রাণে বিহারে॥
তুমি কিছু দিয়ে যাও
তুমি কিছু দিয়ে যাও মোর প্রাণে গোপনে গো–
ফুলের গন্ধে বাঁশির গানে, মর্মরমুখরিত পবনে॥
তুমি কিছু নিয়ে যাও বেদনা হতে বেদনে–
যে মোর অশ্রু হাসিতে লীন, যে বাণী নীরব নয়নে॥
তৃষ্ণার শান্তি সুন্দরকান্তি
তৃষ্ণার শান্তি, সুন্দরকান্তি,
তুমি এলে নিখিলের সন্তাপভঞ্জন॥
আঁকো ধরাবক্ষে দিক্বধূচক্ষে
সুশীতল সুকোমল শ্যামরসরঞ্জন।
এলে বীরছন্দে তব কটিবন্ধে
বিদ্যুৎ-অসিলতা বেজে ওঠে ঝঞ্ঝন॥
তব উত্তরীয়ে ছায়া দিলে ভরিয়ে–
তমালবনশিখরে নবনীল-অঞ্জন।
ঝিল্লির মন্দ্রে মালতীর গন্ধে
মিলাইলে চঞ্চল মধুকরগুঞ্জন।
নৃত্যের ভঙ্গে এলে নবরঙ্গে,
সচকিত পল্লবে নাচে যেন খঞ্জন॥
তোমরা যা বলো তাই বলো
তোমরা যা বলো তাই বলো, আমার লাগে না মনে।
আমার যায় বেলা, বয়ে যায় বেলা কেমন বিনা কারণে॥
এই পাগল হাওয়া কী গান-গাওয়া
ছড়িয়ে দিয়ে গেল আজি সুনীল গগনে॥
সে গান আমার লাগল যে গো লাগল মনে,
আমি কিসের মধু খুঁজে বেড়াই ভ্রমরগুঞ্জনে।
ওই আকাশ-ছাওয়া কাহার চাওয়া
এমন ক’রে লাগে আজি আমার নয়নে॥
তোমার বাস কোথা-যে পথিক
তোমার বাস কোথা-যে পথিক ওগো, দেশে কি বিদেশে।
তুমি হৃদয়-পূর্ণ-করা ওগো, তুমিই সর্বনেশে॥
‘আমার বাস কোথা-যে জান নাকি,
শুধাতে হয় সে কথা কি,
ও মাধবী, ও মালতী!’
হয়তো জানি, হয়তো জানি, হয়তো জানি নে,
মোদের বলে দেবে কে সে।
মনে করি, আমার তুমি, বুঝি নও আমার।
বলো বলো, বলো পথিক, বলো তুমি কার।
‘আমি তারি যে আমারে যেমনি দেখে চিনতে পারে,
ও মাধবী, ও মালতী!’
হয়তো চিনি, হয়তো চিনি, হয়তো চিনি নে,
মোদের বলে দেবে কে সে॥
তোমার নাম জানি নে
তোমার নাম জানি নে, সুর জানি।
তুমি শরৎ-প্রাতের আলোর বাণী॥
সারা বেলা শিউলিবনে আছি মগন আপন মনে,
কিসের ভুল রেখে গেলে আমার বুকে ব্যথার বাঁশিখানি॥
আমি যা বলিতে চাই হল বলা
ওই শিশিরে শিশিরে অশ্রু-গলা।
আমি যা দেখিতে চাই প্রাণের মাঝে
সেই মুরতি এই বিরাজে–
ছায়াতে-আলোতে-আঁচল-গাঁথা
আমার অকারণে বেদনার বীণাপাণি॥
তোমার মোহন রূপে কে রয় ভুলে
তোমার মোহন রূপে কে রয় ভুলে।
জানি না কি মরণ নাচে, নাচে গো ওই চরণমূলে॥
শরৎ-আলোর আঁচল টুটে কিসের ঝলক নেচে উঠে,
ঝড় এনেছ এলোচুলে॥
কাঁপন ধরে বাতাসেতে–
পাকা ধানের তরাস লাগে, শিউরে ওঠে ভরা ক্ষেতে।
জানি গো আজ হাহারবে তোমার পূজা সারা হবে
নিখিল অশ্রু-সাগর কূলে॥
তোমার আসন পাতব কোথায় হে অতিথি
তোমার আসন পাতব কোথায় হে অতিথি।
ছেয়ে গেছে শুকনো পাতায় কাননবীথি॥
ছিল ফুটে মালতীফুল কুন্দকলি,
উত্তরবায় লুঠ ক’রে তায় গেল চলি–
হিমে বিবশ বনস্থলী বিরলগীতি
হে অতিথি॥
সুর-ভোলা ওই ধরার বাঁশি লুটায় ভুঁয়ে,
মর্মে তাহার তোমার হাসি দাও না ছুঁয়ে।
মাতবে আকাশ নবীন রঙের তানে তানে,
পলাশ বকুল ব্যাকুল হবে আত্মদানে–
জাগবে বনের মুগ্ধ মনে মধুর স্মৃতি
হে অতিথি॥