কোন্ পুরাতন প্রাণের টানে
কোন্ পুরাতন প্রাণের টানে
ছুটেছে মন মাটির পানে॥
চোখ ডুবে যায় নবীন ঘাসে, ভাবনা ভাসে পুব-বাতাসে–
মল্লারগান প্লাবন জাগায় মনের মধ্যে শ্রাবণ-গানে॥
লাগল যে দোল বনের মাঝে
অঙ্গে সে মোর দেয় দোলা যে।
যে বাণী ওই ধানের ক্ষেতে আকুল হল অঙ্কুরেতে
আজ এই মেঘের শ্যামল মায়ায়
সেই বাণী মোর সুরে আনে॥
ক্লান্ত যখন আম্রকলির কাল
ক্লান্ত যখন আম্রকলির কাল, মাধবী ঝরিল ভূমিতলে অবসন্ন,
সৌরভধনে তখন তুমি হে শালমঞ্জরী বসন্তে কর ধন্য॥
সান্ত্বনা মাগি দাঁড়ায় কুঞ্জভূমি রিক্ত বেলায় অঞ্চল যবে শূন্য–
বনসভাতলে সবার ঊর্ধ্বে তুমি, সব-অবসানে তোমার দানের পুণ্য॥
গগনে গগনে আপনার মনে কী খেলা তব
গগনে গগনে আপনার মনে কী খেলা তব।
তুমি কত বেশে নিমেষে নিমেষে নিতুই নব॥
জটার গভীরে লুকালে রবিরে, ছায়াপটে আঁকো এ কোন্ ছবি রে।
মেঘমল্লারে কী বল আমারে কেমন কব॥
বৈশাখী ঝড়ে সে দিনের সেই অট্টহাসি
গুরুগুরু সুরে কোন্ দূরে দূরে যায় সে ভাসি।
সে সোনার আলো শ্যামলে মিশালো– শ্বেত উত্তরী আজ কেন কালো।
লুকালে ছায়ায় মেঘের মায়ায় কী বৈভব॥
গহন ঘন ছাইল গগন ঘনাইয়া
গহন ঘন ছাইল গগন ঘনাইয়া।
স্তিমিত দশ দিশি, স্তম্ভিত কানন,
সব চরাচর আকুল– কী হবে কে জানে
ঘোরা রজনী, দিকললনা ভয়বিভলা ॥
চমকে চমকে সহসা দিক উজলি
চকিতে চকিতে মাতি ছুটিল বিজলি
থরথর চরাচর পলকে ঝলকিয়া
ঘোর তিমিরে ছায় গগন মেদিনী
গুরুগুরু নীরদগরজনে স্তব্ধ আঁধার ঘুমাইছে,
সহসা উঠিল জেগে প্রচণ্ড সমীরণ– কড়কড় বাজ॥
গহন রাতে শ্রাবণধারা পড়িছে ঝরে
গহন রাতে শ্রাবণধারা পড়িছে ঝরে,
কেন গো মিছে জাগাবে ওরে॥
এখনো দুটি আঁখির কোণে যায় যে দেখা
জলের রেখা,
না-বলা বাণী রয়েছে যেন অধর ভরে॥
নাহয় যেয়ো গুঞ্জরিয়া বীণার তারে
মনের কথা শয়নদ্বারে।
নাহয় রেখো মালতীকলি শিথিল কেশে
নীরবে এসে,
নাহয় রাখী পরায়ে যেয়ো ফুলের ডোরে।
কেন গো মিছে জাগাবে ওরে॥
চক্ষে আমার তৃষ্ণা ওগো তৃষ্ণা আমার বক্ষ জুড়ে
চক্ষে আমার তৃষ্ণা, ওগো তৃষ্ণা আমার বক্ষ জুড়ে।
আমি বৃষ্টিবিহীন বৈশাখী দিন, সন্তাপে প্রাণ যায় যে পুড়ে॥
ঝড় উঠেছে তপ্ত হাওয়ায়, মনকে সুদূর শূন্যে ধাওয়ায়–
অবগুণ্ঠন যায় যে উড়ে॥
যে-ফুল কানন করত আলো
কালো হয়ে সে শুকাল।
ঝরনারে কে দিল বাধা– নিষ্ঠুর পাষাণে বাঁধা
দুঃখের শিখরচূড়ে॥
চরণরেখা তব যে পথে দিলে লেখি
চরণরেখা তব যে পথে দিলে লেখি
চিহ্ন আজি তারি আপনি ঘুচালে কি॥
অশোকরেণুগুলি রাঙালো যার ধূলি
তারে যে তৃণতলে আজিকে লীন দেখি॥
ফুরায় ফুল-ফোটা, পাখিও গান ভোলে,
দখিনবায়ু সেও উদাসী যায় চলে।
তবু কি ভরি তারে অমৃত ছিল না রে–
স্মরণ তারো কি গো মরণে যাবে ঠেকি॥
চলে ছলোছলো নদীধারা নিবিড় ছায়ায় কিনারায় কিনারায়
চলে ছলোছলো নদীধারা নিবিড় ছায়ায় কিনারায় কিনারায়।
ওকে মেঘের ডাকে ডাকল সুদূরে, “আ য় আ য় আয়।’
কূলে প্রফুল্ল বকুলবন ওরে করিছে আবাহন–
কোথা দূরে বেণুবন গায়, “আ য় আ য় আয়।’।
তীরে তীরে, সখী, ওই-যে উঠে নবীন ধান্য পুলকি।
কাশের বনে বনে দুলিছে ক্ষণে ক্ষণে–
গাহিছে সজল বায়, “আ য় আ য় আয়।’
চলে যায় মরি হায় বসন্তের দিন
চলে যায় মরি হায় বসন্তের দিন।
দূর শাখে পিক ডাকে বিরামবিহীন॥
অধীর সমীর-ভরে উচ্ছ্বসি বকুল ঝরে,
গন্ধ-সনে হল মন সুদূরে বিলীন॥
পুলকিত আম্রবীথি ফাল্গুনেরই তাপে,
মধুকরগুঞ্জরনে ছায়াতল কাঁপে।
কেন আজি অকারণে সারা বেলা আনমনে
পরানে বাজায় বীণা কে গো উদাসীন।
চেনা ফুলের গন্ধস্রোতে ফাগুন-রাতের অন্ধকারে
চেনা ফুলের গন্ধস্রোতে ফাগুন-রাতের অন্ধকারে
চিত্তে আমার ভাসিয়ে আনে নিত্যকালের অচেনারে॥
একদা কোন্ কিশোর-বেলায় চেনা চোখের মিলন-মেলায়
সেই তো খেলা করেছিল কান্নাহাসির ধারে ধারে॥
তারি ভাষার বাণী নিয়ে প্রিয়া আমার গেছে ডেকে,
তারি বাঁশির ধ্বনি সে যে বিরহে মোর গেছে রেখে।
পরিচিত নামের ডাকে তার পরিচয় গোপন থাকে,
পেয়ে যারে পাই নে তারি পরশ পাই যে বারে বারে॥
ছাড়্ গো তোরা ছাড়্ গো
ছাড়্ গো তোরা ছাড়্ গো,
আমি চলব সাগর-পার গো॥
বিদায়-বেলায় একি হাসি, ধরলি আগমনীর বাঁশি–
যাবার সুরে আসার সুরে করলি একাকার গো।
সবাই আপন-পানে আমায় আবার কেন টানে।
পুরানো শীত পাতা-ঝরা, তারে এমন নূতন-করা?
মাঘ মরিল ফাগুন হয়ে খেয়ে ফুলের মার গো॥
রঙের খেলার ভাই রে, আমার সময় হাতে নাই রে।
তোমাদের ওই সবুজ ফাগে চক্ষে আমার ধাঁদা লাগে–
আমায় তোদের প্রাণের দাগে দাগিস নে, ভাই, আর গো॥
ছায়া ঘনাইছে বনে বনে
ছায়া ঘনাইছে বনে বনে, গগনে গগনে ডাকে দেয়া।
কবে নবঘন-বরিষনে গোপনে গোপনে এলি কেয়া ॥
পুরবে নীরব ইশারাতে একদা নিদ্রাহীন রাতে
হাওয়াতে কী পথে দিলি খেয়া–
আষাঢ়ের খেয়ালের কোন্ খেয়া ॥
যে মধু হৃদয়ে ছিল মাখা কাঁটাতে কী ভয়ে দিলি ঢাকা।
বুঝি এলি যার অভিসারে মনে মনে দেখা হল তারে,
আড়ালে আড়ালে দেয়া-নেয়া–
আপনায় লুকায়ে দেয়া-নেয়া ॥
ঝরঝর বরিষে বারিধারা
ঝরঝর বরিষে বারিধারা।
হায় পথবাসী, হায় গতিহীন, হায় গৃহহারা ॥
ফিরে বায়ু হাহাস্বরে, ডাকে কারে জনহীন অসীম প্রান্তরে–
রজনী আঁধারে॥
অধীরা যমুনা তরঙ্গ-আকুলা অকূলা রে, তিমিরদুকূলা রে।
নিবিড় নীরদ গগনে গরগর গরজে সঘনে,
চঞ্চলচপলা চমকে– নাহি শশীতারা ॥