ওলো শেফালি ওলো শেফালি
ওলো শেফালি, ওলো শেফালি,
আমার সবুজ ছায়ার প্রদোষে তুই জ্বালিস দীপালি॥
তারার বাণী আকাশ থেকে তোমার রূপ দিল এঁকে
শ্যামল পাতায় থরে থরে আখর রুপালি॥
তোমারবুকের খসা গন্ধ-আঁচল রইল পাতা সে
আমার গোপন কাননবীথির বিবশ বাতাশে।
সারাটা দিন বাটে বাটে নানা কাজে দিবস কাটে,
আমার সাঁঝে বাজে তোমার করুণ ভূপালি॥
কখন বাদল-ছোঁওয়া লেগে
কখন বাদল-ছোঁওয়া লেগে
মাঠে মাঠে ঢাকে মাটি সবুজ মেঘে মেঘে॥
ওই ঘাসের ঘনঘোরে
ধরণীতল হল শীতল চিকন আভায় ভ’রে–
ওরা হঠাৎ-গাওয়া গানের মতো এল প্রাণের বেগে॥
ওরা যে এই প্রাণের রণে মরুজয়ের সেনা,
ওদের সাথে আমার প্রাণের প্রথম যুগের চেনা–
তাই এমন গভীর স্বরে
আমার আঁখি নিল ডাকি ওদের খেলাঘরে–
ওদের দোল দেখে আজ প্রাণে আমার দোলা ওঠে জেগে॥
কত যে তুমি মনোহর মনই তাহা জানে
কত যে তুমি মনোহর মনই তাহা জানে,
হৃদয় মম থরোথরো কাঁপে তোমার গানে॥
আজিকে এই প্রভাতবেলা মেঘের সাথে রোদের খেলা,
জলে নয়ন ভরোভরো চাহি তোমার পানে॥
আলোর অধীর ঝিলিমিলি নদীর ঢেউয়ে ওঠে,
বনের হাসি খিলিখিলি পাতায় পাতায় ছোটে।
আকাশে ওই দেখি কী যে– তোমার চোখের চাহনি যে।
সুনীল সুধা ঝরোঝরো ঝরে আমার প্রাণে॥
কদম্বেরই কানন ঘেরি আষাঢ়মেঘের ছায়া খেলে
কদম্বেরই কানন ঘেরি আষাঢ়মেঘের ছায়া খেলে,
পিয়ালগুলি নাটের ঠাটে হাওয়ায় হেলে॥
বরষনের পরশনে শিহর লাগে বনে বনে,
বিরহী এই মন যে আমার সুদূর-পানে পাখা মেলে॥
আকাশপথে বলাকা ধায় কোন্ সে অকারণের বেগে,
পুব হাওয়াতে ঢেউ খেলে যায় ডানার গানের তুফান লেগে।
ঝিল্লিমুখর বাদল-সাঁঝে কে দেখা দেয় হৃদয়-মাঝে,
স্বপনরূপে চুপে চুপে ব্যথায় আমার চরণ ফেলে॥
কাঁপিছে দেহলতা থরথর
কাঁপিছে দেহলতা থরথর,
চোখের জলে আঁখি ভরভর॥
দোদুল তমালেরই বনছায়া তোমারি নীল বাসে নিল কায়া,
বাদল-নিশীথেরই ঝরঝর
তোমারি আঁখি-‘পরে ভরভর॥
যে কথা ছিল তব মনে মনে
চমকে অধরের কোণে কোণে।
নীরব হিয়া তব দিল ভরি কী মায়া স্বপনে যে, মরি মরি,
আঁধার কাননের মরমর
বাদল-নিশীথের ঝরঝর॥
কার বাঁশি নিশিভোরে বাজিল মোর প্রাণে
(মরি লো) কার বাঁশি নিশিভোরে বাজিল মোর প্রাণে
ফুটে দিগন্তে অরুণকিরণকলিকা ॥
শরতের আলোতে সুন্দর আসে,
ধরণীর আঁখি যে শিশিরে ভাসে,
হৃদয়কুঞ্জবনে মুঞ্জরিল মধুর শেফালিকা ॥
কার যেন এই মনের বেদন চৈত্রমাসের উতল হাওয়ায়
কার যেন এই মনের বেদন চৈত্রমাসের উতল হাওয়ায়,
ঝুমকোলতার চিকন পাতা কাঁপে রে কার চম্কে-চাওয়ায়॥
হারিয়ে-যাওয়া কার সে বাণী কার সোহাগের স্মরণখানি
আমের বোলের গন্ধে মিশে
কাননকে আজ কান্না পাওয়ায়॥
কাঁকন-দুটির রিনিঝিনি কার বা এখন মনে আছে।
সেই কাঁকনের ঝিকিমিকি পিয়ালবনের শাখায় নাচে।
যার চোখের ওই আভাস দোলে নদী-ঢেউয়ের কোলে কোলে
তার সাথে মোর দেখা ছিল
সেই সেকালের তরী-বাওয়ায়॥
কিছু বলব ব’লে এসেছিলেম
কিছু বলব ব’লে এসেছিলেম,
রইনু চেয়ে না ব’লে॥
দেখিলাম খোলা বাতায়নে মালা গাঁথো আপন-মনে,
গাও গুন্-গুন্ গুঞ্জরিয়া যূথীকুঁড়ি নিয়ে কোলে॥
সারা আকাশ তোমার দিকে
চেয়ে ছিল অনিমিখে।
মেঘ-ছেঁড়া আলো এসে পড়েছিল কালো কেশে,
বাদল-মেঘে মৃদুল হাওয়ায় অলক দোলে॥
কুসুমে কুসুমে চরণচিহ্ন দিয়ে যাও
কুসুমে কুসুমে চরণচিহ্ন দিয়ে যাও, শেষে দাও মুছে।
ওহে চঞ্চল, বেলা না যেতে খেলা কেন তব যায় ঘুচে॥
চকিত চোখের অশ্রুসজল বেদনায় তুমি ছুঁয়ে ছুঁয়ে চল–
কোথা সে পথের শেষ কোন্ সুদূরের দেশ
সবাই তোমায় তাই পুছে॥
বাঁশরির ডাকে কুঁড়ি ধরে শাখে, ফুল যবে ফোটে নাই দেখা।
তোমার লগন যায় সে কখন, মালা গেঁথে আমি রই একা।
“এসো এসো এসো’ আঁখি কয় কেঁদে। তৃষিত বক্ষ বলে “রাখি বেঁধে’
যেতে যেতে, ওগো প্রিয়, কিছু ফেলে রেখে দিয়ো
ধরা দিতে যদি নাই রুচে॥
কে রঙ লাগালে বনে বনে
কে রঙ লাগালে বনে বনে।
ঢেউ জাগালে সমীরণে॥
আজ ভুবনের দুয়ার খোলা দোল দিয়েছে বনের দোলা–
দে দোল! দে দোল! দে দোল!
কোন্ ভোলা সে ভাবে-ভোলা খেলায় প্রাঙ্গণে॥
আন্ বাঁশি– আন্ রে তোর আন্ রে বাঁশি,
উঠল সুর উচ্ছ্বাসি ফাগুন-বাতাসে।
আজ দে ছড়িয়ে শেষ বেলাকার কান্না হাসি–
সন্ধ্যাকাশের বুক-ফাটা সুর বিদায়-রাতি করবে মধুর,
মাতল আজি অস্তসাগর সুরের প্লাবনে॥
কেন পান্থ এ চঞ্চলতা
কেন পান্থ, এ চঞ্চলতা।
কোন্ শূন্য হতে এল কার বারতা ॥
নয়ন কিসের প্রতীক্ষা-রত বিদায়বিষাদে উদাসমত–
ঘনকুন্তলভার ললাটে নত, ক্লান্ত তড়িতবধু তন্দ্রাগতা ॥
কেশরকীর্ণ কদম্ববনে মর্মরমুখরিত মৃদুপবনে
বর্ষণহর্ষ-ভরা ধরণীর বিরহবিশঙ্কিত করুণ কথা।
ধৈর্য মানো ওগো, ধৈর্য মানো! বরমাল্য গলে তব হয় নি ম্লান’
আজও হয় নি ম্লান’–
ফুলগন্ধনিবেদনবেদনসুন্দর মালতী তব চরণে প্রণতা ॥
কোথা যে উধাও হল মোর প্রাণ উদাসী
কোথা যে উধাও হল মোর প্রাণ উদাসী
আজি ভরা বাদরে॥
ঘন ঘন গুরু গুরু গরজিছে,
ঝরো ঝরো নামে দিকে দিগন্তে জলধারা–
মন ছুটে শূন্যে শূন্যে অনন্তে অশান্ত বাতাসে॥
কোন্ খেপা শ্রাবণ ছুটে এল আশ্বিনেরই আঙিনায়
কোন্ খেপা শ্রাবণ ছুটে এল আশ্বিনেরই আঙিনায়।
দুলিয়ে জটা ঘনঘটা পাগল হাওয়ার গান সে গায়॥
মাঠে মাঠে পুলক লাগে ছায়ানটের নৃত্যরাগে,
শরৎ-রবির সোনার আলো উদাস হয়ে মিলিয়ে যায়॥
কী কথা সে বলতে এল ভরা ক্ষেতের কানে কানে
লুটিয়ে-পড়া কিসের কাঁদন উঠেছে আজ নবীন ধানে।
মেঘে অধীর আকাশ কেন ডানা-মেলা গরুড় যেন–
পথ-ভোলা এক পথিক এসে পথের বেদন আনল ধরায়॥