ওগো দখিন হাওয়া
ওগো দখিন হাওয়া, ও পথিক হাওয়া, দোদুল দোলায় দাও দুলিয়ে।
নূতন-পাতার-পুলক-ছাওয়া পরশখানি দাও বুলিয়ে॥
আমি পথের ধারের ব্যাকুল বেণু হঠাৎ তোমার সাড়া পেনু গো–
আহা, এস আমার শাখায় শাখায় প্রাণের গানের ঢেউ তুলিয়ে॥
ওগো দখিন হাওয়া, ও পথিক হাওয়া, পথের ধারে আমার বাসা।
জানি তোমার আসা-যাওয়া, শুনি তোমার পায়ের ভাষা।
আমায় তোমার ছোঁওয়া লাগলে পরে একটুকুতেই কাঁপন ধরে গো–
আহা, কানে-কানে একটি কথায় সকল কথা নেয় ভুলিয়ে॥
ওগো আমার শ্রাবণমেঘের খেয়াতরীর মাঝি
ওগো আমার শ্রাবণমেঘের খেয়াতরীর মাঝি,
অশ্রুভরা পূরব হাওয়ায় পাল তুলে দাও আজি॥
উদাস হৃদয় তাকায়ে রয়, বোঝা তাহার নয় ভারী নয়,
পুলক-লাগা এই কদম্বের একটি কেবল সাজি॥
ভোরবেলা যে খেলার সাথি ছিল আমার কাছে,
মনে ভাবি, তার ঠিকানা তোমার জানা আছে।
তাই তোমারি সারিগানে সেই আঁখি তার মনে আনে,
আকাশ-ভরা বেদনাতে রোদন উঠে বাজি॥
ওগো তুমি পঞ্চদশী
ওগো তুমি পঞ্চদশী,
তুমি পৌঁছিলে পূর্ণিমাতে।
মৃদুস্মিত স্বপ্নের আভাস তব বিহ্বল রাতে॥
ক্বচিৎ জাগরিত বিহঙ্গকাকলী
তব নবযৌবনে উঠিছে আকুলি ক্ষণে ক্ষণে।
প্রথম আষাঢ়ের কেতকীসৌরভ তব নিদ্রাতে॥
যেন অরণ্যমর্মর
গুঞ্জরি উঠে তব বক্ষ থরথর।
অকারণ বেদনার ছায়া ঘনায় মনের দিগন্তে,
ছলোছলো জল এনে দেয় তব নয়নপাতে॥
ওগো বধূ সুন্দরী তুমি মধুমঞ্জরী
ওগো বধূ সুন্দরী, তুমি মধুমঞ্জরী,
পুলকিত চম্পার লহো অভিনন্দন–
পর্ণের পাত্রে ফাল্গুনরাত্রে মুকুলিত মল্লিকা-মাল্যের বন্ধন।
এনেছি বসন্তের অঞ্জলি গন্ধের,
পলাশের কুঙ্কুম চাঁদিনির চন্দন–
পারুলের হিল্লোল, শিরীষের হিন্দোল, মঞ্জুল বল্লীর বঙ্কিম কঙ্কণ–
উল্লাস-উতরোল বেণুবনকল্লোল,
কম্পিত কিশলয়ে মলয়ের চুম্বন।
তব আঁখিপল্লবে দিয়ো আঁকি বল্লভে
গগনের নবনীল স্বপনের অঞ্জন॥
ওগো সাঁওতালি ছেলে
ওগো সাঁওতালি ছেলে,
শ্যামল সঘন নববরষার কিশোর দূত কি এলে॥
ধানের ক্ষেতের পারে শালের ছায়ার ধারে
বাঁশির সুরেতে সুদূর দূরেতে চলেছ হৃদয় মেলে॥
পুবদিগন্ত দিল তব দেহে নীলিমলেখা,
পীত ধড়াটিতে অরুণরেখা,
কেয়াফুলখানি কবে তুলে আনি
দ্বারে মোর রেখে গেলে॥
আমার গানের হংসবলাকাপাঁতি
বাদল-দিনের তোমার মনের সাথি।
ঝড়ে চঞ্চল তমালবনের প্রাণে
তোমাতে আমাতে মিলিয়াছি একখানে,
মেঘের ছায়ায় চলিয়াছি ছায়া ফেলে॥
ওরা অকারণে চঞ্চল
ওরা অকারণে চঞ্চল।
ডালে ডালে দোলে বায়ুহিল্লোলে নব পল্লবদল॥
ছড়ায়ে ছড়ায়ে ঝিকিমিকি আলো
দিকে দিকে ওরা কী খেলা খেলালো,
মর্মরতানে প্রাণে ওরা আনে কৈশোরকোলাহাল॥
ওরা কান পেতে শোনে গগনে গগনে
নীরবের কানাকানি,
নীলিমার কোন্ বাণী।
ওরা প্রাণঝরনার উচ্ছল ধার, ঝরিয়া ঝরিয়া বহে অনিবার,
চির তাপসিনী ধরণীর ওরা শ্যামশিখা হোমানল॥
ওরে আয় রে তবে মাত্ রে সবে আনন্দে
ওরে আয় রে তবে, মাত্ রে সবে আনন্দে
আজ নবীন প্রাণের বসন্তে॥
পিছন-পানের বাঁধন হতে চল্ ছুটে আজ বন্যাস্রোতে,
আপনাকে আজ দখিন হাওয়ায় ছড়িয়ে দে রে দিগন্তে॥
বাঁধন যত ছিন্ন করো আনন্দে
আজ নবীন প্রাণের বসন্তে।
অকূল প্রাণের সাগর-তীরে ভয় কী রে তোর ক্ষয়-ক্ষতিরে।
যা আছে রে সব নিয়ে তোর ঝাঁপ দিয়ে পড়্ অনন্তে॥
ওরে ঝড় নেমে আয়
ওরে ঝড় নেমে আয়, আয় রে আমার শুকনো পাতার ডালে,
এই বরষায় নবশ্যামের আগমনের কালে॥
যা উদাসীন, যা প্রাণহীন, যা আনন্দহারা,
চরম রাতের অশ্রুধারায় আজ হয়ে যাক সারা–
যাবার যাহা যাক সে চলে রুদ্র নাচের তালে॥
আসন আমার পাততে হবে রিক্ত প্রাণের ঘরে,
নবীন বসন পরতে হবে সিক্ত বুকের ‘পরে।
নদীর জলে বান ডেকেছে কূল গেল তার ভেসে,
যূথীবনের গন্ধবাণী ছুটল নিরুদ্দেশে–
পরান আমার জাগল বুঝি মরণ-অন্তরালে॥
ওরে গৃহবাসী খোল্ দ্বার খোল্
ওরে গৃহবাসী খোল্, দ্বার খোল্, লাগল যে দোল।
স্থলে জলে বনতলে লাগল যে দোল।
দ্বার খোল্, দ্বার খোল্॥
রাঙা হাসি রাশি রাশি অশোক পলাশে,
রাঙা নেশা মেঘে মেশা প্রভাত-আকাশে,
নবীন পাতায় লাগে রাঙা হিল্লোল।
দ্বার খোল্, দ্বার খোল্॥
বেণুবন মর্মরে দখিন বাতাসে,
প্রজাপতি দোলে ঘাসে ঘাসে।
মউমাছি ফিরে যাচি ফুলের দখিনা,
পাখায় বাজায় তার ভিখারির বীণা,
মাধবীবিতানে বায়ু গন্ধে বিভোল।
দ্বার খোল্, দ্বার খোল্॥
ওরে বকুল পারুল ওরে শাল-পিয়ালের বন
ওরে বকুল, পারুল, ওরে শাল-পিয়ালের বন,
কোন্খানে আজ পাই
এমন মনের মতো ঠাঁই
যেথায় ফাগুন ভরে দেব দিয়ে সকল মন,
দিয়ে আমার সকল মন॥
সারা গগনতলে তুমুল রঙের কোলাহলে
মাতামাতির নেই যে বিরাম কোথাও অনুক্ষণ
যেথায় ফাগুন ভরে দেব দিয়ে সকল মন,
দিয়ে আমার সকল মন॥
ওরে বকুল, পারুল, ওরে শাল-পিয়ালের বন,
আকাশ নিবিড় ক’রে
তোরা দাঁড়াস নে ভিড় ক’রে–
আমি চাই নে, চাই নে, চাই নে এমন
গন্ধরঙের বিপুল আয়োজন।
অকুল অবকাশে যেথায় স্বপ্নকমল ভাসে
দে আমারে একটি এমন গগন-জোড়া কোণ–
যেথায় ফাগুন ভরে দেব দিয়ে সকল মন,
দিয়ে আমার সকল মন॥
ওরে ভাই ফাগুন লেগেছে বনে বনে
ওরে ভাই, ফাগুন লেগেছে বনে বনে–
ডালে ডালে ফুলে ফুলে পাতায় পাতায় রে,
আড়ালে আড়ালে কোণে কোণে॥
রঙে রঙে রঙিল আকাশ, গানে গানে নিখিল উদাস–
যেন চল-চঞ্চল নব পল্লবদল মর্মরে মোর মনে মনে। ।
হেরো হেরো অবনীর রঙ্গ,
গগনের করে তপোভঙ্গ।
হাসির আঘাতে তার মৌন রহে না আর,
কেঁপে কেঁপে ওঠে খনে খনে।
বাতাস ছুটিছে বনময় রে, ফুলের না জানে পরিচয় রে।
তাই বুঝি বারে বারে কুঞ্জের দ্বারে দ্বারে
শুধায়ে ফিরিছে জনে জনে॥