নাচ্ শ্যামা, তালে তালে
নাচ্ শ্যামা, তালে তালে ।।
রুনু রুনু ঝুনু বাজিছে নূপুর, মৃদু মৃদু মধু উঠে গীতসুর,
বলয়ে বলয়ে বাজে ঝিনি ঝিনি, তালে তালে উঠে করতালিধ্বনি—
নাচ্ শ্যামা, নাচ্ তবে ।।
নিরালয় তোর বনের মাঝে সেথা কি এমন নূপুর বাজে !
এমন মধুর গান ? এমন মধুর তান ?
কমলকরের করতালি হেন দেখিতে পেতিস কবে ?—
নাচ্ শ্যামা, নাচ্ তবে ।।
নীরব রজনী দেখো মগ্ন জোছনায়
নীরব রজনী দেখো মগ্ন জোছনায় ।
ধীরে ধীরে, অতি ধীরে, অতি ধীরে গাও গো ।।
ঘুমঘোরময় গান বিভাবরী গায়—
রজনীর কণ্ঠ-সাথে সুকণ্ঠ মিলাও গো ।।
নিশার কুহকবলে নীরবতাসিন্ধুতলে
মগ্ন হয়ে ঘুমাইছে বিশ্বচরাচর—
প্রশান্ত সাগরে হেন তরঙ্গ না তুলে যেন
অধীর উচ্ছ্বাসময় সঙ্গীতের স্বর ।
তটিনী কী শান্ত আছে— ঘুমাইয়া পড়িয়াছে
বাতাসের মৃদুহস্ত-পরশে এমনি
ভুলে যদি ঘুমে ঘুমে তটের চরণ চুমে
সে চুম্বনধ্বনি শুনে চমকে আপনি ।
তাই বলি, অতি ধীরে, অতি ধীরে গাও গো—
রজনীর কণ্ঠ-সাথে সুকণ্ঠ মিলাও গো ।।
পথে যেতে তোমার সাথে মিলন হল দিনের শেষে
পথে যেতে তোমার সাথে মিলন হল দিনের শেষে ।
দেখতে গিয়ে, সাঁঝের আলো মিলিয়ে গেল এক নিমেষে ।
দেখা তোমায় হোক বা না-হোক
তাহার লাগি করব না শোক–
ক্ষণেক তুমি দাঁড়াও, তোমার চরণ ঢাকি এলো কেশে ।।
রাগ: অজ্ঞাত
তাল: অজ্ঞাত
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): পৌষ, ১৩২১
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): জানুয়ারি, ১৯১৫
এই গানটি “চতুরঙ্গ” গ্রন্থে আছে
পোড়া মনে শুধু পোড়া মুখখানি জাগে রে
পোড়া মনে শুধু পোড়া মুখখানি জাগে রে ।
এত আছে লোক, তবু পোড়া চোখে
আর কেহ নাহি লাগে রে ।।
প্রিয়ে, তোমার ঢেঁকি হলে যেতেম বেঁচে
প্রিয়ে, তোমার ঢেঁকি হলে যেতেম বেঁচে
রাঙা চরণতলে নেচে নেচে ।।
ঢিপ্ঢিপিয়ে যেতেম মারা, মাথা খুঁড়ে হতেম সারা—
কানের কাছে কচ্কচিয়ে মানটি তোমার নিতেম যেচে ।।
————
রাগ: রামপ্রসাদী
তাল: দাদরা
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): 1290
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): 1884
বলেছিল ‘ধরা দেব না’, শুনেছিল সেই বড়াই
বলেছিল ‘ধরা দেব না’, শুনেছিল সেই বড়াই।
বীরপুরুষের সয় নি গুমোর, বাধিয়ে দিয়েছে লড়াই।
তার পরে শেষে কী যে হল কার,
কোন্ দশা হল জয়পতাকার।–
কেউ বলে জিৎ, কেউ বলে হার, আমরা গুজব ছড়াই ।।
রাগ: অজ্ঞাত
তাল: অজ্ঞাত
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): কার্তিক, ১৩৪০
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): 1933
বসন্তপ্রভাতে এক মালতীর ফুল
বসন্তপ্রভাতে এক মালতীর ফুল
প্রথম মেলিল আঁখি তার, চাহিয়া দেখিল চারি ধার ।।
উষারানী দাঁড়াইয়া শিয়রে তাহার
দেখিছে ফুলের ঘুম-ভাঙা । হরষে কপোল তার রাঙা ।।
মধুকর গান গেয়ে বলে, ‘মধু কই । মধু দাও দাও ।’
হরষে হৃদয় ফেটে গিয়ে ফুল বলে, ‘এই লও লও ।’
বায়ু আসি কহে কানে কানে, ‘ফুলবালা, পরিমল দাও ।’
আনন্দে কাঁদিয়া কহে ফুল, ‘যাহা আছে সব লয়ে যাও ।’
হরষ ধরে না তার চিতে, আপনারে চাহে বিলাইতে,
বালিকা আনন্দে কুটি-কুটি পাতায় পাতায় পড়ে লুটি ।।
বাঁধন কেন ভূষণ-বেশে
বাঁধন কেন ভূষণ-বেশে
তোরে ভোলায়, হায় অভাগী।
মরণ কেন মোহন হেসে
তোরে দোলায়, হায় অভাগী।।
বাজে রে বাজে ডমরু বাজে হৃদয়মাঝে, হৃদয়মাঝে
বাজে রে বাজে ডমরু বাজে হৃদয়মাঝে, হৃদয়মাঝে।
নাচে রে নাচে চরণ নাচে প্রাণের কাছে, প্রাণের কাছে ।
প্রহর জাগে, প্রহরী জাগে– তারায় তারায় কাঁপন লাগে ।
মরমে মরমে বেদনা ফুটে– বাঁধন টুটে, বাঁধন টুটে ।।
রাগ: ইমনকল্যাণ
তাল: তেওরা
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): 1318
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): 1911
স্বরলিপিকার: অনাদিকুমার দস্তিদার
এই গানটি “মুক্তধারা” গ্রন্থে আছে
বাজে রে বাজে রে
বাজে রে বাজে রে
ওই রুদ্রতালে বজ্রভেরী–
দলে দলে চলে প্রলয়রঙ্গে বীরসাজে রে !
দ্বিধা ত্রাস আলস নিদ্রা ভাঙে লাজে রে !
উড়ে দীপ্ত বিজয়কেতু শূন্য মাঝে রে !
আছে কে পড়িয়া পিছে মিছে কাজে রে ।।
বাহির হলেম আমি আপন ভিতর হতে
বাহির হলেম আমি আপন ভিতর হতে,
নীল আকাশে পাড়ি দেব খ্যাপা হাওয়ার স্রোতে।।
আমের মুকুল ফুটে ফুটে যখন পড়ে ঝ’রে ঝ’রে
মাটির আঁচল ভ’রে ভ’রে–
ঝরাই আমার মনের কথা ভরা ফাগুন-চোতে।।
কোথা তুই প্রাণের দোসর বেড়াস ঘুরি ঘুরি–
বনবীথির আলোছায়ায় করিস লুকোচুরি।
আমার একলা বাঁশি পাগলামি তার পাঠায় দিগন্তরে
তোমার গানের তরে–
কবে বসন্তেরে জাগিয়ে দেব আমাতে আর তোতে।।
বিপাশার তীরে ভ্রমিবারে যাই
বিপাশার তীরে ভ্রমিবারে যাই, প্রতিদিন প্রাতে দেখিবারে পাই
লতা-পাতা-ঘেরা জানালা-মাঝারে একটি মধুর মুখ ।।
চারি দিকে তার ফুটে আছে ফুল— কেহ বা হেলিয়া পরশিছে চুল,
দুয়েকটি শাখা কপাল ছুঁইয়া, দুয়েকটি আছে কপোলে নুইয়া,
কেহ বা এলায়ে চেতনা হারায়ে চুমিয়া আছে চিবুক ।
বসন্তপ্রভাতে লতার মাঝারে মুখানি মধুর অতি—
অধর-দুটির শাসন টুটিয়া রাশি রাশি হাসি পড়িছে ফুটিয়া,
দুটি আঁখি-’পরে মেলিছে মিশিছে তরল চপল জ্যোতি ।।
বুঝেছি বুঝেছি সখা, ভেঙেছে প্রণয়
বুঝেছি বুঝেছি সখা, ভেঙেছে প্রণয় !
ও মিছে আদর তবে না করিলে নয় ?।
ও শুধু বাড়ায় ব্যথা— সে-সব পুরানো কথা
মনে ক’রে দেয় শুধু, ভাঙে এ হৃদয় ।।
প্রতি হাসি প্রতি কথা প্রতি ব্যবহার
আমি যত বুঝি তত কে বুঝিবে আর ।
প্রেম যদি ভুলে থাক সত্য ক’রে বলো-নাকো—
করিব না মুহূর্তের তরে তিরস্কার ।।
আমি তো ব’লেই ছিনু, ক্ষুদ্র আমি নারী
তোমার ও প্রণয়ের নহি অধিকারী ।
আর-কারে ভালোবেসে সুখী যদি হও শেষে
তাই ভালোবেসো নাথ, না করি বারণ ।
মনে ক’রে মোর কথা মিছে পেয়ো নাকো ব্যথা,
পুরানো প্রেমের কথা কোরো না স্মরণ ।।