তুই রে বসন্তসমীরণ
তুই রে বসন্তসমীরণ ।
তোর নহে সুখের জীবন ।।
কিবা দিবা কিবা রাতি পরিমলমদে মাতি
কাননে করিস বিচরণ ।।
নদীরে জাগায়ে দিস লতারে রাগায়ে দিস
চুপিচুপি করিয়া চুম্বন
তোর নহে সুখের জীবন ।।
শোন্ বলি বসন্তের বায়,
হৃদয়ের লতাকুঞ্জে আয় ।
নিভৃত নিকুঞ্জ ছায় হেলিয়া ফুলের গায়
শুনিয়া পাখির মৃদু গান
লতার-হৃদয়ে-হারা সুখে-অচেতন-পারা
ঘুমায়ে কাটায়ে দিবি প্রাণ ।
তাই বলি বসন্তের বায়,
হৃদয়ের লতাকুঞ্জে আয় ।।
তুমি আছ কোন্ পাড়া ? তোমার পাই নে যে সাড়া
তুমি আছ কোন্ পাড়া ? তোমার পাই নে যে সাড়া ।
পথের মধ্যে হাঁ ক’রে যে রইলে হে খাড়া ।।
রোদে প্রাণ যায় দুপুর বেলা, ধরেছে উদরে জ্বালা—
এর কাছে কি হৃদয়জ্বালা ।
তোমার সকল সৃষ্টিছাড়া ।।
রাঙা অধর, নয়ন কালো ভরা পেটেই লাগে ভালো—
এখন পেটের মধ্যে নাড়ীগুলো দিয়েছে তাড়া ।।
তুমি পড়িতেছ হেসে তরঙ্গের মতো এসে
তুমি পড়িতেছ হেসে তরঙ্গের মতো এসে
হৃদয়ে আমার।
যৌবনসমুদ্রমাঝে কোন্ পূর্ণিমায় আজি
এসেছে জোয়ার।
উচ্ছল পাগল নীরে তালে তালে ফিরে ফিরে
এ মোর নির্জন তীরে কী খেলা তোমার !
মোর সর্ব বক্ষ জুড়ে কত নৃত্যে কত সুরে
এস কাছে যাও দূরে শতলক্ষবার।।
কুসুমের মতো শ্বসি পড়িতেছ খসি খসি
মোর বক্ষ-’পরে
গোপন শিহিরছলে বিন্দু বিন্দু অশ্রুজলে
প্রাণ সিক্ত ক’রে ।
নিঃশব্দ সৌরভরাশি পরানে পশিছে আসি
সুখস্বপ্ন পরকাশি নিভৃত অন্তরে।
পরশপুলকে ভোর চোখে আসে ঘুমঘোর,
তোমার চুম্বন মোর সর্বাঙ্গে সঞ্চরে।
তোমার কটি-তটের ধটি কে দিল রাঙিয়া
তোমার কটি-তটের ধটি কে দিল রাঙিয়া —
কোমল গায়ে দিল পরায়ে রঙিন আঙিয়া ।।
বিহানবেলা আঙিনাতলে এসেছ তুমি কী খেলাছলে—
চরণ দুটি চলিতে ছুটি পড়িছে ভাঙিয়া ।
তোমার কটি-তটের ধটি কে দিল রাঙিয়া ।।
কিসের সুখে সহাস মুখে নাচিছ বাছনি—
দুয়ার-পাশে জননী হাসে হেরিয়া নাচনি।
তাথেই-থেই তালির সাথে কাঁকন বাজে মায়ের হাতে—
রাখাল-বেশে ধরেছ হেসে বেণুর পাঁচনি।
কিসের সুখে সহাস মুখে নাচিছ বাছনি।
নিখিল শোনে আকুল-মনে নূপুর-বাজনা,
তপন-শশী হেরিছে বসি তোমার সাজনা।
ঘুমাও যবে মায়ের বুকে আকাশ চেয়ে রহে ও মুখে,
জাগিলে পরে প্রভাত করে নয়ন-মাজনা।
নিখিল শোনে আকুল-মনে নূপুর-বাজনা ।।
রাগ: কাফি
তাল: ঝম্পক
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): ৫ শ্রাবণ, ১৩১০
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): জুলাই, ১৯০৩
রচনাস্থান: আলমোড়া
তোমায় সাজাব যতনে কুসুমে রতনে
তোমায় সাজাব যতনে কুসুমে রতনে
কেয়ূরে কঙ্কণে কুঙ্কুমে চন্দনে।।
কুন্তলে বেষ্টিব স্বর্ণজালিকা, কণ্ঠে দোলাইব মুক্তামালিকা,
সীমন্তে সিন্দুর অরুণ বিন্দুর– চরণ রঞ্জিব অলক্ত-অঙ্কনে।।
সখীরে সাজাব সখার প্রেমে অলক্ষ্য প্রাণের অমূল্য হেমে।
সাজাব সকরুণ বিরহবেদনায়, সাজাব অক্ষয় মিলনসাধনায়–
মধুর লজ্জা রচিব সজ্জা যুগল প্রাণের বাণীর বন্ধনে।।
রাগ: কালাংড়া
তাল: কাহারবা
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): অগ্রহায়ণ, ১৩৪০
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): নভেম্বর, ১৯৩৩
স্বরলিপিকার: শৈলজারঞ্জন মজুমদার
এই গানটি “শাপমোচন” গ্রন্থে আছে
তোলন-নামন পিছন-সামন
তোলন-নামন পিছন-সামন।
বাঁয়ে ডাইনে চাই নে, চাই নে ।
বোসন-ওঠন ছড়ান-গুটন ।
উল্টা-পাল্টা ঘূর্ণি চালটা– বাস্ ! বাস্! বাস্ !
রাগ: ইমন
তাল: কাহারবা
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): মাঘ, ১৩৪৫
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): 1939
স্বরলিপিকার: শান্তিদেব ঘোষ
এই গানটি “তাসের দেশ” গ্রন্থে আছে
থাকতে আর তো পারলি নে মা, পারলি কই
থাকতে আর তো পারলি নে মা, পারলি কই ।
কোলের সন্তানেরে ছাড়লি কই।।
দোষী আছি অনেক দোষে, ছিলি বসে ক্ষণিক রোষে—
মুখ তো ফিরালি শেষে। অভয় চরণ কাড়লি কই।।
দেখব কে তোর কাছে আসে
দেখব কে তোর কাছে আসে—
তুই রবি একেশ্বরী,
একলা আমি রইব পাশে ।।
নহ মাতা, নহ কন্যা, নহ বধূ, সুন্দরী রূপসী হে নন্দনবাসিনী উর্বশী
নহ মাতা, নহ কন্যা, নহ বধূ, সুন্দরী রূপসী হে নন্দনবাসিনী উর্বশী।
গোষ্ঠে যবে নামে সন্ধ্যা শ্রান্ত দেহে স্বর্ণাঞ্চল টানি
তুমি কোনো গৃহপ্রান্তে নাহি জ্বালো সন্ধ্যাদীপখানি।
দ্বিধায় জড়িত পদে কম্প্রবক্ষে নম্রনেত্রপাতে
স্মিতহাস্যে নাহি চল লজ্জিত বাসরশয্যাতে অর্ধরাতে।
উষার উদয়-সম অনবগুণ্ঠিতা তুমি অকুণ্ঠিতা।।
সুরসভাতলে যবে নৃত্য করো পুলকে উল্লসি
হে বিলোল হিল্লোল উর্বশী,
ছন্দে নাচি উঠে সিন্ধুমাঝে তরঙ্গের দল,
শস্যশীর্ষে শিহরিয়া কাঁপি উঠে ধরার অঞ্চল,
তোমার মদির গন্ধ অন্ধ বায়ু বহে চারি ভিতে,
মধুমত্ত ভৃঙ্গ-সম মুগ্ধ কবি ফিরে লুব্ধ চিতে উদ্দাম গীতে।
নূপুর গুঞ্জরি চলো আকুল-অঞ্চলা বিদ্যুতচঞ্চলা।।
না সখা, মনের ব্যথা কোরো না গোপন
না সখা, মনের ব্যথা কোরো না গোপন ।
যবে অশ্রুজল হায় উচ্ছ্বসি উঠিতে চায়
রুধিয়া রেখো না তাহা আমারি কারণ ।
চিনি, সখা, চিনি তব ও দারুণ হাসি—
ওর চেয়ে কত ভালো অশ্রুজলরাশি ।
মাথা খাও— অভাগীরে কোরো না বঞ্চনা,
ছদ্মবেশে আবরিয়া রেখো না যন্ত্রণা ।
মমতার অশ্রুজলে নিভাইব সে অনলে,
ভালো যদি বাস তবে রাখো এ প্রার্থনা ।।