কী জানি কী ভেবেছ মনে
কী জানি কী ভেবেছ মনে
খুলে বলো ললনে ।
কী কথা হায় ভেসে যায়
ওই ছলোছলো দুটি নয়নে।
কে তুমি গো খুলিয়াছ স্বর্গের দুয়ার
কে তুমি গো খুলিয়াছ স্বর্গের দুয়ার
ঢালিতেছ এত সুখ, ভেঙে গেল— গেল বুক—
যেন এত সুখ হৃদে ধরে না গো আর ।
তোমার চরণে দিনু প্রেম-উপহার—
না যদি চাও গো দিতে প্রতিদান তার
নাই বা দিলে তা মোরে, থাকো হৃদি আলো করে,
হৃদয়ে থাকুক জেগে সৌন্দর্য তোমার ।।
কেন রে চাস ফিরে ফিরে, চলে আয় রে চলে আয়
কেন রে চাস ফিরে ফিরে, চলে আয় রে চলে আয়।।
এরা প্রাণের কথা বোঝে না যে, হৃদয়কুসুম দলে যায়।।
হেসে হেসে গেয়ে গান দিতে এসেছিলি প্রাণ,
নয়নের জল সাথে নিয়ে চলে আয় রে চলে আয়।।
কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা মনে মনে
কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা মনে মনে!
মেলে দিলেম গানের সুরের এই ডানা মনে মনে।
তেপান্তরের পাথার পেরোই রূপ-কথার,
পথ ভুলে যাই দূর পারে সেই চুপ্-কথার–
পারুলবনের চম্পারে মোর হয় জানা মনে মনে।।
সূর্য যখন অস্তে পড়ে ঢুলি মেঘে মেঘে আকাশ-কুসুম তুলি।
সাত সাগরের ফেনায় ফেনায় মিশে
আমি যাই ভেসে দূর দিশে–
পরীর দেশের বন্ধ দুয়ার দিই হানা মনে মনে।।
ক্ষমা করো মোরে সখী, শুধায়ো না আর
ক্ষমা করো মোরে সখী, শুধায়ো না আর—
মরমে লুকানো থাক মরমের ভার ।।
যে গোপন কথা, সখী, সতত লুকায়ে রাখি
ইষ্টদেবমন্ত্রসম পূজি অনিবার ।
তাহা মানুষের কানে ঢালিতে যে লাগে প্রাণে—
লুকানো থাক তা, সখী, হৃদয়ে আমার ।।
ভালোবাসি, শুধায়ো না কারে ভালোবাসি ।
সে নাম কেমনে, সখী, কহিব প্রকাশি ।
আমি তুচ্ছ হতে তুচ্ছ— সে নাম যে অতি উচ্চ,
সে নাম যে নহে যোগ্য এই রসনার ।।
ক্ষুদ্র এই বনফুল পৃথিবীকাননে
আকাশের তারকারে পূজে মনে মনে—
দিন-দিন পূজা করি শুকায়ে পড়ে সে ঝরি,
আজন্ম-নীরবে রহি যায় প্রাণ তার ।।
খেলা কর্ খেলা কর্ তোরা কামিনীকুসুমগুলি
খেলা কর্ খেলা কর্ তোরা কামিনীকুসুমগুলি ।
দেখ্ সমীরণ লতাকুঞ্জে গিয়া কুসুমগুলির চিবুক ধরিয়া
ফিরায়ে এ ধার, ফিরায়ে ও ধার, দুইটি কপোল চুমে বারবার
মুখানি উঠায়ে তুলি ।
তোরা খেলা কর্ তোরা খেলা কর্ কামিনীকুসুমগুলি ।
কভু পাতা-মাঝে লুকায়ে মুখ, কভু বায়ু-কাছে খুলে দে বুক,
মাথা নাড়ি নাড়ি নাচ্ কভু নাচ্ বায়ু-কোলে দুলি দুলি ।
দু দণ্ড বাঁচিবি, খেলা তবে খেলা— প্রতি নিমিষেই ফুরাইছে বেলা,
বসন্তের কোলে খেলাশ্রান্ত প্রাণ ত্যজিবি ভাবনা ভুলি ।।
চিঁড়েতন হর্তন ইস্কাবন
চিঁড়েতন হর্তন ইস্কাবন
অতি সনাতন ছন্দে কর্তেছে নর্তন।
কেউ বা ওঠে কেউ পড়ে,
কেউ বা একটু নাহি নড়ে,
কেউ শুয়ে শুয়ে ভুঁয়ে করে কালকর্তন।।
নাহি কহে কথা কিছু–
একটু না হাসে, সামনে যে আসে
চলে তারি পিছু পিছু।
বাঁধা তার পুরাতন চালটা,
নাই কোনো উল্টা-পাল্টা– নাই পরিবর্তন।।
রাগ: ইমন
তাল: কাহারবা
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): 1340
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): 1933
স্বরলিপিকার: শান্তিদেব ঘোষ
এই গানটি “তাসের দেশ” গ্রন্থে আছে
চির-পুরানো চাঁদ
চির-পুরানো চাঁদ,
চিরদিবস এমনি থেকো আমার এই সাধ।।
পুরানো হাসি পুরানো সুধা মিটায় মম পুরানো ক্ষুধা—
নূতন কোনো চকোর যেন পায় না পরসাদ।।
জ্বল্ জ্বল্ চিতা, দ্বিগুণ দ্বিগুণ
জ্বল্ জ্বল্ চিতা, দ্বিগুণ দ্বিগুণ—
পরান সঁপিবে বিধবা বালা ।
জ্বলুক জ্বলুক চিতার আগুন,
জুড়াবে এখনি প্রাণের জ্বালা ।।
শোন্ রে যবন, শোন্ রে তোরা,
যে জ্বালা হৃদয়ে জ্বালালি সবে
সাক্ষী র’লেন দেবতা তার—
এর প্রতিফল ভুগিতে হবে ।।
দেখ্ রে জগৎ, মেলিয়ে নয়ন,
দেখ্ রে চন্দ্রমা, দেখ্ রে গগন,
স্বর্গ হতে সব দেখো দেবগণ—
জ্বলদ্-অক্ষরে রাখো গো লিখে ।
স্পর্ধিত যবন, তোরাও দেখ্ রে,
সতীত্ব-রতন করিতে রক্ষণ
রাজপুত-সতী আজিকে কেমন
সঁপিছে পরান অনলশিখে ।।
জয় জয় জয় হে জয় জ্যোতির্ময়
জয় জয় জয় হে জয় জ্যোতির্ময়–
মোহকলুষঘন কর’ ক্ষয়, কর’ ক্ষয়।।
অগ্নিপরশ তব কর’ কর’ দান,
কর’ নির্মল মম তনুমন প্রাণ–
বন্ধনশৃঙ্খল নাহি সয়, নাহি সয় ।।
গূঢ় বিঘ্ন যত কর’ উৎপাটিত ।
অমৃতদ্বার তব কর’ উদ্ঘাটিত ।
যাচি যাত্রিদল, হে কর্ণধার,
সুপ্তিসাগর কর’ কর’ পার–
স্বপ্নের সঞ্চয় হোক লয়, হোক লয়।।
ঝর ঝর রক্ত ঝরে কাটা মুণ্ড বেয়ে
ঝর ঝর রক্ত ঝরে কাটা মুণ্ড বেয়ে।
ধরণী রাঙা হল রক্তে নেয়ে ।।
ডাকিনী নৃত্য করে প্রসাদ -রক্ত-তরে—
তৃষিত ভক্ত তোমার আছে চেয়ে ।।
তরুতলে ছিন্নবৃন্ত মালতীর ফুল
তরুতলে ছিন্নবৃন্ত মালতীর ফুল—
মুদিয়া আসিছে আঁখি তার, চাহিয়া দেখিল চারি ধার ।।
শুষ্ক তৃণরাশি-মাঝে একেলা পড়িয়া,
চারি দিকে কেহ নাই আর— নিরদয় অসীম সংসার ।।
কে আছে গো দিবে তার তৃষিত অধরে
একবিন্দু শিশিরের কণা— কেহ না, কেহ না ।।
মধুকর কাছে এসে বলে, ‘মধু কই। মধু চাই, চাই ।’
ধীরে ধীরে নিশ্বাস ফেলিয়া ফুল বলে, ‘কিছু নাই, নাই।’
‘ফুলবালা, পরিমল দাও’ বায়ু আসি কহিতেছে কাছে ।
মলিন বদন ফিরাইয়া ফুল বলে, ‘আর কী বা আছে।’
মধ্যাহ্নকিরণ চারি দিকে খরদৃষ্টে চেয়ে অনিমিখে—
ফুলটির মৃদু প্রাণ হায়,
ধীরে ধীরে শুকাইয়া যায় ।।