এতদিন পরে মোরে
এতদিন পরে মোরে
আপন হাতে বেঁধে দিলে মুক্তিডোরে।
সাবধানীদের পিছে পিছে
দিন কেটেছে কেবল মিছে,
ওদের বাঁধা পথের বাঁধন হতে টেনে নিলে আপন ক’রে ।।
এবার চলিনু তবে
এবার চলিনু তবে ।।
সময় হয়েছে নিকট, এখন বাঁধন ছিঁড়িতে হবে।
উচ্ছল জল করে ছলছল,
জাগিয়া উঠেছে কলকোলাহল,
তরণীপতাকা চলচঞ্চল কাঁপিছে অধীর রবে।
সময় হয়েছে নিকট, এখন বাঁধন ছিঁড়িতে হবে ।।
আমি নিষ্ঠুর কঠিন কঠোর, নির্মম আমি আজি।
আর নাই দেরি, ভৈরবভেরী বাহিরে উঠেছে বাজি।
তুমি ঘুমাইছ নিমীলনয়নে,
কাঁপিয়া উঠিছ বিরহস্বপনে,
প্রভাতে জাগিয়া শূন্য শয়নে কাঁদিয়া চাহিয়া রবে।
সময় হয়েছে নিকট, এখন বাঁধন ছিঁড়িতে হবে ।।
অরুণ তোমার তরুণ অধর করুণ তোমার আঁখি—
অমিয়রচন সোহাগবচন অনেক রয়েছে বাকি।
পাখি উড়ে যাবে সাগরের পার,
সুখময় নীড় পড়ে রবে তার,
মহাকাশ হতে ওই বারে-বার আমারে ডাকিছে সবে।
সময় হয়েছে নিকট, এখন বাঁধন ছিঁড়িতে হবে।।
বিশ্বজগৎ আমারে মাগিলে কে মোর আত্মপর।
আমার বিধাতা আমাতে জাগিলে কোথায় আমার ঘর ।
কিসেরই বা সুখ, ক’ দিনের প্রাণ।
ওই উঠিয়াছে সংগ্রামগান,
অমর মরণ রক্তচরণ নাচিছে সগৌরবে।
সময় হয়েছে নিকট, এখন বাঁধন ছিঁড়িতে হবে ।।
ও কী কথা বল সখী, ছি ছি, ও কথা মনে এনো না
ও কী কথা বল সখী, ছি ছি, ও কথা মনে এনো না।।
আজি সুখের দিনে জগত হাসিছে,
হেরো লো দশ দিশি হরষে ভাসিছে—
আজি ও ম্লান মুখ প্রাণে যে সহে না।
সুখের দিনে, সখী, কেন ও ভাবনা ।।
ওই জানালার কাছে বসে আছে করতলে রাখি মাথা
ওই জানালার কাছে বসে আছে করতলে রাখি মাথা—
তার কোলে ফুল পড়ে রয়েছে, সে যে ভুলে গেছে মালা গাঁথা ।।
শুধু ঝুরু ঝুরু বায়ু বহে যায় তার কানে কানে কী যে কহে যায়—
তাই আধো শুয়ে আধো বসিয়ে ভাবিতেছে কত কথা ।।
চোখের উপরে মেঘ ভেসে যায়, উড়ে উড়ে যায় পাখি—
সারা দিন ধ’রে বকুলের ফুল ঝ’রে পড়ে থাকি থাকি ।
মধুর আলস, মধুর আবেশ, মধুর মুখের হাসিটি—
মধুর স্বপনে প্রাণের মাঝারে বাজিছে মধুর বাঁশিটি ।।
ওগো দয়াময়ী চোর, এত দয়া মনে তোর
ওগো দয়াময়ী চোর, এত দয়া মনে তোর !
বড়ো দয়া ক’রে কণ্ঠে আমার জড়াও মায়ার ডোর ।
বড়ো দয়া ক’রে চুরি ক’রে লও শূন্য হৃদয় মোর ।।
রাগ: ভৈরবী
তাল: অজ্ঞাত
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): 1307
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): 1900
ওর মানের এ বাঁধ টুটবে না কি টুটবে না
ওর মানের এ বাঁধ টুটবে না কি টুটবে না।
ওর মনের বেদন থাকবে মনে, প্রাণের কথা ফুটবে না ?।
কঠিন পাষাণ বুকে লয়ে নাই রহিল অটল হয়ে
প্রেমেতে ওই পাথর ক্ষ’য়ে চোখের জল কি ছুটবে না ?।
কত দিন একসাথে ছিনু ঘুমঘোরে
কত দিন একসাথে ছিনু ঘুমঘোরে,
তবু জানিতাম নাকো ভালোবাসি তোরে ।
মনে আছে ছেলেবেলা কত যে খেলেছি খেলা,
কুসুম তুলেছি কত দুইটি আঁচল ভ’রে ।
ছিনু সুখে যতদিন দুজনে বিরহহীন
তখন কি জানিতাম ভালোবাসি তোরে !
অবশেষে এ কপাল ভাঙিল যখন,
ছেলেবেলাকার যত ফুরালো স্বপন,
লইয়া দলিত মন হইনু প্রবাসী—
তখন জানিনু, সখী, কত ভালোবাসি ।।
কথা কোস্ নে লো রাই, শ্যামের বড়াই বড়ো বেড়েছে
কথা কোস্ নে লো রাই, শ্যামের বড়াই বড়ো বেড়েছে ।
কে জানে ও কেমন ক’রে মন কেড়েছে ।।
শুধু ধীরে বাজায় বাঁশি, শুধু হাসে মধুর হাসি—
গোপিনীদের হৃদয় নিয়ে তবে ছেড়েছে ।।
কবরীতে ফুল শুকালো
কবরীতে ফুল শুকালো
কাননের ফুল ফুটল বনে ।।
দিনের আলো প্রকাশিল,
মনের সাধ রহিল মনে ।।
কাছে তার যাই যদি কত যেন পায় নিধি
কাছে তার যাই যদি কত যেন পায় নিধি,
তবু হরষের হাসি ফুটে-ফুটে ফুটে না ।
কখনো বা মৃদু হেসে আদর করিতে এসে
সহসা শরমে বাধে, মন উঠে উঠে না ।
রোষের ছলনা করি দূরে যাই, চাই ফিরি—
চরণ-বারণ-তরে উঠে-উঠে উঠে না ।
কাতর নিশ্বাস ফেলি আকুল নয়ন মেলি
চাহি থাকে, লাজবাঁধ তবু টুটে টুটে না ।
যখন ঘুমায়ে থাকি মুখপানে মেলি আঁখি
চাহি থাকে, দেখি দেখি সাধ যন মিটে না ।
সহসা উঠিলে জাগি তখন কিসের লাগি
শরমেতে ম’রে গিয়ে কথা যেন ফুটে না ।
লাজময়ী, তোর চেয়ে দেখি নি লাজুক মেয়ে,
প্রেমবরিষার স্রোতে লাজ তবু টুটে না ।।
কাজ ভোলাবার কে গো তোরা
কাজ ভোলাবার কে গো তোরা !
রঙিন সাজে কে যে পাঠায়
কোন্ সে ভুবন-মনো-চোরা !
কঠিন পাথর সারে সারে
দেয় পাহারা গুহার দ্বারে,
হাসির ধারায় ডুবিয়ে তারে
ঝরাও রসের সুধা-ঝোরা !
স্বপন-তরীর তোরা নেয়ে
লাগল প্রাণে নেশার হাওয়া,
পাগ্লা পরান চলে গেয়ে।
কোন্ উদাসীর উপবনে
বাজল বাঁশি ক্ষণে ক্ষণে,
ভুলিয়ে দিল ঈশান কোণে
ঝঞ্ঝা ঘনায় ঘনঘোরা ।
কার হাতে যে ধরা দেব, প্রাণ
কার হাতে যে ধরা দেব, প্রাণ,
তাই ভাবতে বেলা অবসান ।।
ডান দিকেতে তাকাই যখন বাঁয়ের লাগি কাঁদে রে মন—
বাঁয়ের লাগি ফিরলে তখন দক্ষিণেতে পড়ে টান ।।
কিছুই তো হল না
কিছুই তো হল না ।
সেই সব— সেই সব— সেই হাহাকাররব,
সেই অশ্রুবারিধারা, হৃদয়বেদনা ।।
কিছুতে মনের মাঝে শান্তি নাহি পাই,
কিছুই না পাইলাম যাহা কিছু চাই ।
ভালো তো গো বাসিলাম, ভালোবাসা পাইলাম,
এখনো তো ভালোবাসি— তবুও কী নাই ।।
কী করিব বলো, সখা, তোমার লাগিয়া
কী করিব বলো, সখা, তোমার লাগিয়া ।
কী করিলে জুড়াইতে পারিব ও হিয়া ।।
এই পেতে দিনু বুক, রাখো, সখা, রাখো মুখ—
ঘুমাও তুমি গো, আমি রহিনু জাগিয়া ।
খুলে বলো, বলো সখা, কী দুঃখ তোমার—
অশ্রুজলে মিলাইব অশ্রুজলধার !
একদিন বলেছিলে মোর ভালোবাসা
পাইলে পুরিবে তব হৃদয়ের আশা ।
কই সখা, প্রাণ মন করেছি তো সমর্পণ—
দিয়েছি তো যাহা-কিছু আছিল আমার ।
তবু কেন শুকালো না অশ্রুজলধার ।।