আমরা যাদের গিলি, তারা আবার তাদের চেয়ে নরম চোয়ালের
কৈ, মাগুর, ভেটকি, খৈলশা কাউকেই ছেড়ে কথা বলে না।
এ হলো নদীগুলোর আদি গিলে খাওয়ার নিয়ম।
পদ্মা, যমুনা, মেঘনার শিরা-উপশিরার পানি
যতই মিষ্টি হোক গিলে খাওয়ার নিয়ম চলছেই।
আমরা ঐ আদি বাঙালীর মহারাজাধিরাজ
গোপালের আগের একশ’ বছরের কাহিনী থেকে এসব পেয়েছি।
গোপাল থেকে মহীপাল পর্যন্ত মানুষের রাজত্ব।
তারপরে আবার বোয়াল।
আমাদের রাষ্ট্রবিজ্ঞান আছে। আমরা একে বলি বোয়ালসংহিতা।
অপেক্ষাকৃত ছোটদের নির্দ্বিধায় খেয়ে বাঁচো।
আমাদের সংহিতা বলে, শকুন্তলার আংটিচোর
বাইচ্যান্স ধরা পড়ে গেলে তার নির্ঘাত দণ্ড হলো ছয় মাস।
ঘানি টানতে হবে–তার নাম হবে তস্কর।
আর যদি কোন রাঘব বোয়াল এসে পুরো বাংলাদেশটাকেই
আংটির মত গিলে ফেলে তবে তাকে বলতে হবে—
মহারাজাধিরাজ। সেলাম কর তাকে—এরই নাম বোয়ালসংহিতা।
তবে রাঘব বোয়ালরা নানা রাজনীতির ঘোরপ্যাঁচে পড়ে
ভাটির দিকে আসতে পারে না।
তারা গঙ্গা ভাগিরথিতে হা করে ঘুরে বেড়ায়।
তারা আমাদের মিষ্টি জলে সৃষ্টি ছাড়া দৌড় করার জন্য
লালা ঝরিয়ে গঙ্গা ভাগিরথিকে পর্যন্ত বিষাক্ত করে ফেলেছে।
শক্ত চোয়ালওয়ালা রাঘবরা চায়
পদ্মা-যমুনার ভিতর দিয়ে হিমালয় পর্যন্ত একটা নিশ্চিত ট্রানজিট।
কিন্তু আমরা কালা-ধলা, সাদা ও সোনালীদের
হজম না করে তা কি করে সম্ভব?
আমরা যদিও গোপালের আগের একশ’ বছরকে
নিজেদের নদী-নালায়, হাওড়ে-বিলে ফিরিয়ে আনার
চেষ্টায় রাতে ঘুমাই না।
কিন্তু রাঘব বোয়ালদের শক্ত চোয়াল ছিদ্র করার মতো কাঁটাওয়ালা মাছের ঝাঁক
আমরা যে আগেই খেয়ে বসে আছি।
১২-১২-২০০২
শূন্য থেকে সাম্যে
সবাই মাটি, পাথর, বরফ অতিক্রম করে শূন্যতায় গিয়ে পৌঁছে।
কিন্তু আমি শূন্যতা অতিক্রম করে এখানে এসে পৌঁছেছি।
এই তো আমার পায়ের নীচে মাটি। হাত বাড়ালেই তোমার
রক্ত মাংসের ধুকপুকানি, নিঃশ্বাসের গরম বাতাস
অনুভব করি। আমি স্নেহ, মায়া মমতার ওপর আমার
হাত বিছিয়ে দিতে পারি। আমি শূন্যতা থেকে এসেছি
বলে আমার একটা পাওয়ার ইচ্ছা হাতল ধরার
স্বপ্নের মত আমার সামনে দিয়ে হুইসেল বাজিয়ে
চলে যায়। আমি প্রতিটি পালক পড়ার শব্দের
মধ্যে ডানাওয়ালা হাসের দ্রুতগতি অনুভব করি।
আমি শূন্যতা থেকে এসেছি বলে আমার মধ্যে
এক ধরনের আছে, আছে সংগীত গুঞ্জরিত হয়।
এস্রাজটি কোথায় বাজছে তা অবশ্য আমি
বলতে পারব না। তবে সেই রেওয়াজ শোনার
টিকেট আমি জন্ম থেকেই নিজের পোশাক
হাতড়ে পেয়ে গেছি।
আমি শূন্যতা থেকে এসেছি বলেই সমস্ত
স্পর্শযোগ্য বিষয় আমার কাছে স্বাদ ও গন্ধযুক্ত
খাদ্যের মত মনে হয়। যেন এই মুহূর্তে বেইজিং-এর কোন
রেস্তোরা থেকে হাজার বছর আগে অবলুপ্ত ধোঁয়া ওড়া নীল
‘লবস্টার’ রাঙা করে আমার পাতে তুলে
দিয়েছে মৎস্যকুমারীর মত সুন্দরী এক চীনা বালিকা।
তার মুখে এখনও লেগে আছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সেই লং মার্চের
আদব, ‘তা-তাও জিপান জেন’।
জাপানী এনিমিরা নিপাত যাক।
আমি শূন্য থেকে এসেছি বলেই রক পাখির ডিমের মত
ঐশ্বর্যভরা পৃথিবীকে বুকের ভেতর অনুভব করি।
কি উষ্ণ, কি সমুদ্রের তৃপ্তিতে ভরা,
কি হীরকের দ্যুতিতে সমুজ্জ্বল বরফের প্রান্তর।
এই তো পৃথিবী। এই তো আমার আত্মা আমার
আছে, আছে অনিঃশেষ শব্দের দোলনা।
কে এর উপর প্রভুত্ব করবে। সাম্য, মৈত্রী ও ভালবাসা
ছাড়া? ভ্রাতৃত্বের বন্টন ছাড়া?
সহস্রাক্ষ
আমি নিশ্চিতই অপেক্ষমাণ মানুষ। নদী এসে
ছুঁয়ে গেছে। আমার দেহ ঠুকরে অতিক্রম করে
গেল মাছের ঝাঁক। কিন্তু আমি তো কোনো
স্রোতের বা তরঙ্গের জন্য বসে থাকিনি। ঋতুর
পর ঋতু আমার ত্বকে স্পর্শ বুলিয়ে ফিরে গেছে,
দ্যাখো আমি নড়িনি। তবে আমি কার জন্য
বসে থাকি।
একদিন ব্যাকুল হয়ে এক নারী এসে হাত
ধরল। আমি তার আকুলতায় কম্পিত হলেও
চিনতে ভুল হল না তিনি আমার পরিচর্যাকারিণী
স্ত্রী ছিলেন। আমার স্থবিরতা তাকেও বিমুখ
করল। তার শাড়ির আঁচল ধরে অতিক্রম করে
গেল সন্ততিরা আমি অনড়। অটল আমার
প্রতীক্ষা।
পৃথিবীর কত উত্থান-পতন, মানবিক বুদ্ধির
মহাকাশশী সাফল্য, অন্যদিকে পৃথিবীর
দুঃখ-দারিদ্র ঝড়ঝঞা কোনো কিছুই
প্রতিজ্ঞাবদ্ধ কবির অপেক্ষাকে বিচলিত করতে
পারে না। আমি আরও দেখবো, আরো আরো
অফুরান দৃশ্যাবলীর চলচ্চিত্র। কিংবা সমস্ত
প্রত্যক্ষতার বিলয়।
দেখবো বলছি, কিন্তু আমি কি জানতাম চোখ
আর কাজ করে না। আতশকাঁচ ধরেও
প্রজাপতির ডানায় আঁকা অর্থবহ অক্ষর আমি
আর পড়তে পারব না? এখনও কি আমার
দেখার শেষ হবে না? নয়ন নিষ্প্রভ হলে বুকের
ওপর হাত রেখে দেখি হৃদয়ের কাছে হাজার
চোখের পাপড়ি কে যেন মেলে দিয়েছে।
অশ্রুজলে ভেজা।
০৪-০১-২০০২
স্করপিয়ন
বাগদাদের এই মরু বিছেটিকে নিয়ে এখন যত দুশ্চিন্তা।
ঘুম নেই কারো। কত টন বোমায় বিছের বংশ ধ্বংস
হয় তা সমরবিশারদরা হিসেব করে দেখছেন। বিছেটি পাছার
হুল তুলে এক জায়গায় স্থির হয়ে বসে আছে। তার
সর্বাঙ্গের বিষ, মাথায় গোবর এবং কথাবার্তা
মহামতি লেনিনের মৃত্যুর আগে সর্বশেষ ভাষণের মত।
কে জানে কে বেশী বিপ্লবী? বাগদাদের স্করপিয়ন
না ভ্লাদিমির ইলিচ?