মসজিদ শূন্য করে প্রার্থনাকারীরা যার যার আস্তানায় ফিরে
গেলে আমারও হাঁ-মুখ বন্ধ হয়ে যায়।
ভাবি কিছুই বুঝি ঘটল না।
না, দিগন্তের সীমানা থেকে সূর্যকে লক্ষ লক্ষ তাগড়া মহিষ
বাঁকা শিংয়ে আমাদের পতাকার মতো আকাশে ঠেলে দিয়ে
ঐ তো আমার দিকে এগিয়ে আসছে।
লক্ষ মোষের হাম্বা ডাকের মধ্যে অর্থবহ হয়ে উঠেছে যেন
এক ভবিষ্যৎ চাষের চাহিদা। পৃথিবীতে চাষ হবে ফের।
তেজস্ক্রিয় মাটির পরত অসংখ্য লাঙ্গলের ঘায়ে উপড়ে
ফেলে পৃথিবীতে চাষ হবে ফের। কিন্তু নেই প্রকৃত রাখাল।
কলকারখানার শব্দ থেমে গেছে। সভ্যতার উগড়ে দেওয়া
বর্জ্য ও উচ্ছিষ্টের ভাগাড় চাপা দিতে পৃথিবীতে চাষ হবে ফের।
জ্যোতির্ময় রৌদ্রের নীচে লক্ষ লক্ষ মহিষের ঘামে ভেজা
তেজস্ক্রিয় মাটির ভিতরে মিসরের মমির বাক্সে রেখে যাওয়া
বীজ এনে পৃথিবীতে চাষ হবে ফের।
পুঁজি ও সাম্রাজ্যের সমস্ত খিলানগুলো বিধ্বস্ত সভ্যতার
মতো লুপ্ত হয়ে মিশেছে সাগরে। যেমন আটলান্টিসের
গালগল্প সাগরের ঢেউয়ের উপরে মাঝে মধ্যে বুদবুদের
মতো ভাসে। তবে কি সমুদ্রেও চাষ হবে?
আমি কবি কালের রাখাল। তরঙ্গে রেখেছি এক পা,
অন্যটি ধেয়ে আসা মহিষের পিঠে। পৃথিবীতে চাষ হবে ফের।
১১-১২-২০০২
পোষা দোয়েলের শিস
পোষা সে দোয়েল এসে বন্ধ চোখে ঠোঁট ঘষে কয়
ওরে ও মামুদ কানা, চোখ মেলে দেখবে না ভোর?
ললাটে পাখির নাচে অকস্মাৎ কেটে গেলে ঘোর
চেয়ে দেখি লেজঝোলা, স্বপ্ন কিংবা দৈববাণী নয়।
পাখি সেই দুঃসাহসী, কালো চঞ্চ, তীক্ষ্ণ তার শিস
ঊষার প্রার্থনা সেরে পিঠ রেখে নিজের শয্যায়
যখন মুদেছি চোখ অকস্মাৎ হাড়ে ও মজ্জায়
ঢুকেছে পাখির শিস, ডাক নয় আল্লার আশিস।
অন্ধের তো শব্দই সম্বল। অকস্মাৎ পাখিটির ডাক
চোখের পাপড়ি দুটি খুলে দিয়ে কৃপণ আলোর
যতটা শুষতে পারে চেখে নিয়ে দেখে এক অফুরন্ত ভোর
অনন্তে অপেক্ষমাণ, চতুর্দিকে আলোর মৌচাক।
পাখিটি ললাট ছেড়ে বসে গিয়ে লাউয়ের মাচায়
মুক্তপ্রাণে গান গায়। আমি আছি নিজের খাঁচায়।
ফিঙে
আমি যখন অতীতের কথা ভাবি
তখন আমার ঘরটা পাখির গন্ধে ভরে যায়
চারদিকে ওড়াউড়ির শব্দ
একটা ফিঙে পাখির তীক্ষ্ণ যুদ্ধংদেহী আওয়াজ
বাতাসের ঢেউয়ের উপর ওঠে গিয়ে
পৃথিবীর সমস্ত চিল ও শকুনকে হতচকিত করে ফেলে।
তারা বাতাসে ঝাঁপ দেয় দিগ্বিদিক দিশেহারার মতো
বায়ুর উপর ভাসতে ভাসতে আবার অশ্বথের ডালে
যার যার নিজের আশ্রয়ে ফিরে আসে আর ঝিমোতে ঝিমোতে ভাবে
ওই ফিঙেটা তার তীক্ষ্ণ চঞ্চুতে তাদের মাথা কামড়ে দিতে আসছে।
অথচ ওই খুদে পাখিটার কালো পালকের ওপর বিদ্যুতের অক্ষরে লেখা ‘দিগ্বিজয়ী’
এই দ্বীপদেশে যখন সব নখঅলা পাখির একচ্ছত্র রাজত্ব কায়েম হওয়ার কথা
তখন একটি মাত্র ক্যাচকাওয়ার কেন এই দুরন্ত গতি? এই দুঃসাহস?
এই মারমুখী ওড়ার কৌশল?
পাখিটির জন্মবৃত্তান্তে না আছে কোনও আভিজাত্য না আছে পালকের বাহার
তার চঞ্চ অতিশয় ক্ষুদ্র এবং আঘাতে কিরিচের তীক্ষ্ণতা
যেন সে গগনভেরী ঈগলের চিরস্থায়ী রাজত্বের বিরুদ্ধে একটি কালো উড়ন্ত প্রতিবাদ।
তার চলনে বলনে ওড়ার কায়দায় তীক্ষ্ণচোখ চিলেরাও বিহ্বল হয়ে পড়ে।
এই পাখিটির উচ্ছেদ নিয়ে পক্ষীমহলে মাঝে মাঝে সাড়া পড়ে যায়।
কিন্তু মানুষেরা বলে ফিঙে হলো অত্যাচারের বিরুদ্ধে——জুলুম, খুনের বিরুদ্ধে
ডিম ও শাবক অপহরণের বিরুদ্ধে একটি সম্বৎসর যুদ্ধের প্রতীকী উড়াল মাত্র।
সে কালো কিন্তু কোকিল নয়, সে কালো কিন্তু কাক নয়
সে বরং কাকের দঙ্গলকে ভিক্ষুকের দল মনে করে।
সে একা উড়ে, একাকী আঁচড়ে কামড়ে পালক ধসিয়ে দেয়
চিলের, শকুনের, বাজের।
বন্ধ দেরাজ খুলে
আজকাল কিভাবে যেন মাঝরাতে ঘুম ছুটে যায়। নিঃশব্দে শূন্য বিছানায়
বসে সিগ্রেট টানি। অবলীলায় তোমার চলে যাওয়ার দৃশ্যগুলো মনে পড়তে
থাকে। ভয় লাগে, মৃত্যুকে তোমার মত আকস্মিকভাবে অতিক্রমের সাহস
কই আমার?
তবে মৃত্যু যে আকস্মিক শূন্যতার ভেতরও গর্ত সৃষ্টি করে তা আমি
প্রতিদিন মর্মে মর্মে, একটু একটু করে বুঝতে শিখেছি। তোমার যাওয়ার
বছরখানেক পর একটি বন্ধ দেরাজ তালাশ করতে গিয়ে তোমার খোঁপা
সাজাবার আইভরির চিরুনিটি হাতে পেয়ে কিছুক্ষণ স্তম্ভিত হয়ে থাকি।
কাঁটাগুলোর ফাঁকে একগুচ্ছ চুল এখনও লেগে আছে দেখে সাবধানে তুলে
মুঠোবন্ধ করে ধপ করে চেয়ারে বসে পড়ি।
প্রথমে বিস্ময় ও নৈশব্দ ছাড়া কিছুই মনে হয়নি।
বার বার মুঠো খুলি আর বন্ধ করি। অকস্মাৎ মনে হল তোমার ঠাণ্ডা, ছিন্ন
কেশগুচ্ছ স্মৃতির সুতো হয়ে আমার শরীরের ভেতরে আক্ষেপের জাল বুনে
চলেছে। আমি আমার অবসন্ন হাতের তালু বাতাসে উন্মুক্ত করে দিতেই
তোমার পরিত্যক্ত অলকগুচ্ছ ফ্যানের এলোমেলো হাওয়ায় সাঁতার কেটে
চতুর্দিকে ছড়িয়ে গেল। ধুলো ঘূর্ণি যেমন শেষপর্যন্ত পাক খেয়ে ধরণীতেই
মিশে যায় তোমার স্মৃতিও এর বেশি কিছু নয়।
এখন আর তোমার পরিত্যক্ত বাক্সোপেটরা ঘাঁটাঘাঁটি করি না।
কেবল তোমার শূন্য বালিশের ফুলতোলা নকশার ওপর তোয়ালে চাপা
দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ি। কিন্তু মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেলে বিছানায় একাকী বসে
সিগ্রেট টানি।
মনে হয় জানালার ফাঁক দিয়ে নামা জ্যোছনা, পোড়া নিকোটিনের সাথে
গোলাপের গন্ধ তালগোল পাকিয়ে একটা অবস্থার সৃষ্টি করেছে
যা কাব্যসৃষ্টি বা ন্দ্রিার সহায়ক নয়।
আমি কবিতা বা প্রেমের ভিখিরি নই। পুনর্বার কারো সাক্ষাপ্রার্থীও নই,
সব ফিরিয়ে দিলেই কি সব নেওয়া যায়? তুমি কি নেবে? তাহলে আমাকে
কেন ঘুমুতে দেবে না।
মাৎস্যন্যায়
এটা হলো বোয়াল মাছের দেশ।
কালি বোয়াল, ধলি বোয়াল, সোনা বোয়াল ও সাদা বোয়ালের অব্যাহত বিচরণভূমি।
খাল-বিল, ডোবা-নালা ও হাওড়ে একচ্ছত্র বোয়ালেরই রাজত্ব।
আমরা বোয়ালরা আমাদের চেয়ে নরম চোয়ালের
মাছেদের আইনসঙ্গতভাবে খেয়ে বাঁচি।
আমাদের চেয়ে একটু গায়ে গতরে ছোট মাছদের
মোটামুটি গিলে ফেলি।