কেবল ঝরার শব্দ। পাতা ঝরে। শিশিরের শেষ ফোঁটাটুক
মুক্তার বিন্দুর মত ঝুলে আছে কাঁঠালিচাঁপার ফুল থেকে,
শহীদের রক্ত যেন লেগে গেছে খুনির বিবেকে
তেমনি কি টলমল করে অই পুষ্পচোয়া পতনে উন্মুখ—
সময়ের প্রাণরস? প্রকৃতির নিগূঢ় ভেষজে
যৌবন ফেরে না আর। চারপাশে ঝরে যাওয়া সমাপ্তির গান
মর্মবেদনার মত; বালি ওড়ে কীর্তিনাশা নদীর বিরান
পেট থেকে। কাদাখোঁচা পাখি এক কাদাখুঁচে আহার্যের খোঁজে।
নদীর মৃত্যুর পর তার সিক্ত তলপেট ঘেটে
যা পেয়েছি এঁটোকাটা সময়ের জিহ্বা নেয় চেটে।
দিগবিজয়ী খঞ্জরাজা
ঊষার প্রার্থনার উচ্চকিত হাতের আঙুলে শিরশিরানির মত
প্রবেশ করল উদয়কালীন আলোর ঝলকানি। কবিত্ব নয়
বীরত্বই সৃজনরীতির নিয়ামক। ওঠো, আক্রমণ করো
নিশ্চিত জয়ের জন্যে সকালের রোদ্রের মত অশ্বারোহী হও।
একটি ময়দানে অসংখ্য নিষ্প্রাণ মানবদেহের মধ্যে আমার ঘোড়া লাফিয়ে উঠে
জানান দিল আমিই সেই খঞ্জবীর আমীর তৈমুর।
হত্যার তৃপ্তিতে আমার দাড়ি ঘর্মাক্ত। আমার বর্মে
শত্রুদের প্রতিহত তীরের শব্দ। বাহুতে
বীরের সদগতির জন্য মায়ের দোয়াঙ্কিত লোহার বলয়।
ঝাঁক বেঁধে মৃতভোজী শকুনেরা নেমে আসছে পরাজিত লাশের ওপর।
নতুন ব্যুহ রচনা করে বহুদূরে স্থিরপদে দাঁড়িয়ে আছে
আমার অনুগত সৈনিকেরা ইঙ্গিতের অপেক্ষায়। আমার ভায়েরা।
আবার হত্যা হবে। পৃথিবীর ভারসাম্যের জন্যে চাই কিছু প্রাণের উচ্ছেদ।
কবিত্বের কাতরানি আর চোখের পানিতে বাষ্পরুদ্ধ মানচিত্রের ওপর
দ্যাখো গ্রীবা বাঁকিয়ে লাফাচ্ছে তৈমুরের ঘোড়া।
দিগবিজয়ী খঞ্জরাজা আমীর তৈমুর।
কে তোলে সন্ধির প্রস্তাব? কারা করে শান্তির উদ্যোগ?
নিশ্চয়ই সেখানে আছে শেয়ালমুখো বণিক আর গাধার মুখোশ পরা ধূর্ত বাজারীরা।
তারা আরও শতেক বছর তাদের পুঁজির বিচরণ চায়। নির্বিবাদে
মানুষের রক্তের স্বাদ চাখতে শেয়ালের বদনে দ্যাখো হরিণের চোখ
কেমন চকচক করছে।
কেটে ফেল এদের সবগুলো মাথা। কাত্লে আম।
আমি খোঁড়া রাজা আমীর তৈমুর।
মানুষের নতুন মানবিক উদ্ভাবনার জন্যে, ছন্দ ও নতুন কবিতার জন্যে চাই
যুদ্ধ। চাই মানবরূপী দানবের উচ্ছেদ।
হত্যা হোক।
মানুষের নতুন সৃজনরীতির জন্য শতবর্ষের নৈশব্দের মধ্যে
কেবল আমি। কেবল একটিমাত্র অশ্বখুরের শব্দ।
শুনতে পাও? অক্ষমতার বিরুদ্ধে একমাত্র ঘোড়সোয়ার কে যায়?
আমি তোমাদেরই খঞ্জবীর আমীর তৈমুর।
নির্বিবেক পৃথিবীর ওপর এ কার পতাকা
আমাদের দেহের ওপর শত্রুর প্রতিটি অস্ত্রাঘাতই তোমার চেনা। কারণ
প্রতিটি আঘাতই সামনের দিকে। বর্তমান জগতের সবগুলো যুদ্ধক্ষেত্রেই তো
আমি ছিলাম। ছিলাম নাকি? ভুরুর ওপরের এই কাটা চিহ্নটি তোমার এমন
পছন্দ, জানো কি একটি গ্রেনেডের স্প্লিন্টারে।
রক্তাক্ত হয়ে যখন লুটিয়ে পড়েছিলাম কারগিলে। মৃত্যুর
অন্ধকারে বেহুঁশ হয়েও অবচেতনার এলোমেলো স্বপ্নে তোমার কাছেই
ফিরে আসার সাঁতার। ভাবো সেই আকুলিবিকুলি।
এখন আগানিস্তান থেকে সঞ্চিত ক্ষতচিহ্নগুলো কি তোমাকে ভয়
ধরিয়ে দিয়েছে? অথচ
আমার পৃষ্ঠদেশে তুমি সারারাত হাতড়েও একটি কাপুরুষতার ক্ষত বের
করতে পারোনি। এবার চুম্বন কর আমার প্রতিটি আঘাতের চিহ্নে, কারণ
পৃথিবীর প্রতিটি রণক্ষেত্রে আমি ভীরুতা, শান্তি ও আত্মসমর্পণের
বিরুদ্ধে লড়ে এসেছি এবং জেহাদের মহিমা প্রচার করেছি। তোমার
উষ্ণ ওষ্ঠের এক সহস্র চুম্বন আমার প্রাপ্য, দাও
ঋণশোধ করে। কে জানে এবার যদি ফিলিস্তিন থেকে আমার আর
ফেরা না হয়? তুমি তো দেখবে না হেবরণের কোনো ধূলিধূসরিত
কান্তারে পড়ে আছে এক শহীদের রক্তে ভেসে যাওয়া
চেহারা, মুখ থুবড়ে। কিন্তু পিঠে কোনো আঘাতের চিহ্ন নেই।
কিংবা আল আকসার আঙিনায় হুমড়ি খেয়ে শিশুর মত পড়ে আছে
এক বিজয়ী বীর যার প্রতিটি ক্ষতস্থান থেকে রক্তের বদলে
বেরিয়ে আসছে যুদ্ধের চিকার। আর জেহাদ জেহাদ শব্দে তার
আকুতি ছড়িয়ে পড়ছে পৃথিবীতে।
বলো তুমি আর আমি ছাড়া কে আর পৃথিবীতে যুদ্ধ চায়? অধর্মের
বিরুদ্ধে এই হল মানবতার শেষ জেহাদ। আমরা কি আল্লার জমিনে
জানোয়ারের রাজত্ব কায়েমে বাধা দেব না? আমার বাম পাঁজরে
আফগান যুদ্ধের সহস্র বোমার বিধ্বংসী ক্ষতচিহ্ন। তবে কি আমরা
যুদ্ধ ছেড়ে দেব? না, আমাদের নিঃস্তব্ধতা ও মৃত্যুর ভেতর থেকে
জন্ম নিচ্ছে নতুন কবিতা। যুদ্ধের কবিতা। না প্রেম, না শান্তি।
ভাবো, যুদ্ধ ছাড়া ভালো মানুষের আর বাঁচার উপায় রইল না। তোমার
সিজদার জায়গা কোথায়? তোমার কেবলা কোন দিকে?
কবিরা শিল্পীরা কেন এত ভালোবাসার কথা বলে, কেন বলে?
তারা কি মার্কিন বোমার হাত থেকে তাদের আধ্যাত্মিক ঐশ্বর্য রক্ষা করতে সক্ষম?
ভালোবাসা, তোমার ওপর নাপাম বোমা।
প্রেমপ্রীতি মনুষ্যত্ব তোমাদের ওপর কার্পেট বম্বিং
মসজিদ মাদ্রাসা সবকিছুর ওপর বোমা। বোমা, নারী শিশু মাতৃউদর।
শিল্প-সাহিত্য রুচি-সভ্যতা—দ্রুম, দ্রুম, দ্রুম।
এরপর একটাই দৃশ্য দেখতে বাকি, নিপ্রাণ চাঁদের ওপর
যেমন মার্কিন পতাকা, তেমনি নির্বিবেক পৃথিবীর ওপর
পরাজিত পৃথিবীর ওপর একটি বিশাল
মার্কিন পতাকা।
২০-১১-২০০১
পৃথিবীতে চাষ হবে ফের
পৃথিবী অপেক্ষা করে অলৌকিক ঘটনার জন্য।
গাছ, মাছ, মানুষ, পাখি ও প্রকৃতির ভেতর একটা উষ্ণ অনুভূতি।
প্রাণীমাত্রই ম্যাজিক চায়। সবচেয়ে বেশি ম্যাজিকবিলাসী প্রাণীদের
মধ্যে মানুষের কম্পন আমিও নিজের মধ্যে অনুভব করি। একটি
অপার্থিব ঘটনার পুলক আমার হৃৎপিণ্ডকে এমনভাবে ঘটুক ঘটুক
বলে আছড়াতে থাকে যে আমি সকালের আকাশের দিকে
তাকিয়ে হাঁপাতে থাকি। আর ঠিক সেই সময় দোয়েলের
শিসের অজস্র আওয়াজ আজানের আহ্বানের সাথে মিশে গেলে
পূর্ব দিগন্তের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকি।