আগে যখন সাহিত্য করতাম, সাহিত্যের আড্ডায় বিতর্ক করতাম তখন অন্তদৃষ্টি বলে একটা কথা খুব উচ্চারিত হত। এখন অন্ধ হয়ে গিয়ে অন্তর্দৃষ্টি শব্দটা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করি। অন্তর্দৃষ্টি যেন হারপুন নিয়ে খেলা। যেন একটি দুর্ধর্ষ মাছকে বল্লম দিয়ে গেঁথে ফেলা।
হায় আল্লা। কানা মানুষেরও একটা জগত আছে। এর সবটুকু না দেখিয়ে আমাকে অন্য কোনও পর্দার অন্তরালে ঠেলে দিও না। আমি অন্ধত্বের জগত খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে হাতড়ে হাতড়ে অতিক্রম করব। আমি হোঁচট খেয়ে আসবাবপত্রের ওপর পড়ে যাবো। হয়তোবা শক্ত ও কাঠিন্য পরখ করতে করতে কোনও এক কালে আমি সেই কোমল শিহরণের কাছে পৌছে যাবো যা কবিকেও অশ্রুজলে পরিবর্তিত করে দেয়। কবি হয়ে যান ভর বর্ষার মেঘ।
মাঝে মাঝে মনে হয় আমি পানির ভেতর আছি। অবিশ্বাস্য হলেও এই অনুভূতি আমাকে আনন্দ দেয়। প্রশ্ন জাগে হযরত খিজির কি অকূল তরলের ভেতর দিয়ে জগতের ভবিষ্যৎ অবলোকন করেন?
আমি অবলোকন করি আমার ডানদিক দিয়ে অনুকূল এবং বায়ে প্রতিকূল তরঙ্গ বইছে। আমার চোখ দুটি হয়ে যায় মিষ্টিজলের স্বচ্ছ বড় চাঁদামাছ।
স্বচ্ছ তবু দৃষ্টি চলে। ভবিষ্যৎ দেখতে হলে কে বলেছে যে পরিচ্ছন্ন চোখই দরকার। ঘষা কাঁচের মত রহস্যময় চোখ চেয়েছিলাম আমি। আমার প্রভু আমাকে তা দিয়েছেন। কবি জীবনানন্দ দাশ বেতফলের মত ঘোলাটে দৃষ্টি পছন্দ করতেন কিন্তু রহস্যহীন বেদনা কবির কি কাজে লাগে?
আমি যখন স্বচ্ছ চোখের অধিকারী ছিলাম তখন আমার দুটি চোখকে যুক্তিহীন কৌতূহল ঘিরে রেখেছিল। আমি রোদকে দেখেছি গলিত সোনার মত। অন্ধকারের সাথে তুলনা দিয়েছি উল্টে যাওয়া দোয়াতের। এখন আর তা পারি না। কারণ আমি আলোর দিক থেকে রাত্রির দিকে যাত্রা শুরু করেছি। আলোর তো আয়ু শেষ হয় যেমন আমার চোখের আর আলো নেই কিন্তু রাত্রির কি অবসান আছে?
তবু আমি প্রার্থনা করি, আমার ধর্ম যে অন্তহীন জগতের কথা বলে, সেই পরকালে চলার শব্দ আমি শুনতে পাই। সেখানে কি সূর্যোদয় আছে, অস্ত ও অন্ধকার আছে, উষার উদয়ের প্রশান্তি আছে? এ সকল প্রশ্নের জবাব আমি আমার প্রার্থনার মধ্যে একটু একটু উচ্চারণ করি। আর মনে মনে ভাবি সব কিছু আছে। আছে, আছে, আছে…।
আছে শব্দটা আমার রক্ত-মাংসকে এতোটাই অভিভূত করে রেখেছে যে জীবনের সীমা পেরুতে আমি ক্রমাগত নির্ভীক ও নির্লিপ্ত হয়ে পড়েছি। কে আমাকে পর্দা পেরুনোর ভয় দেখায়! আমি তো জানি আমি সেখানে থাকব।
চোখ ছাড়াও তো আমার দেহ-দুর্গে আরও কয়েকটি ইন্দ্রিয় ছিল। তা একে একে ভবিষ্যতের বিরুদ্ধে আত্মরক্ষার অস্ত্রের মতো অকেজো হয়ে পড়েছে। এখন চোখও নেই, শুধু সেজদার জায়গাটুকু আন্দাজ করে লুটিয়ে পড়তে চাচ্ছি। যেখানেই আমার ললাট স্থাপিত হোক না কেন আমি জানি তা আমার প্রভুর ক্ষমার মঞ্জিলে গিয়ে উপচে পড়বে। আমাকে অন্ধ বলে তিনি তো আর এড়িয়ে যেতে পারবেন না।
১৮ সেপ্টেম্বর ২০০২
কানা মামুদের উড়ালকাব্য-৩
তোমার মুখতো কখনো মেঘাছন্ন ছিলো না। দৈব মেঘে
আমার দৃষ্টি হারিয়ে গেলে আমি তোমাকে এক ঝলক বৃষ্টির মত
আমার বুকে অনুভব করেছিলাম।
অন্ধের তো অনুভব শক্তি ছাড়া আর কিছুই থাকে না। শুনেছি
পৃথিবীতে আঠারো হাজার মাখলুকাতের মধ্যে চক্ষুম্মান প্রাণীর সংখ্যা
খুব বেশি নয়। অনেক জীবন আছে যাদের চোখ নেই। জীবন তো
থেমে থাকে না। তারা না দেখেও বাঁচে। হাতড়ে-হাতড়ে বাঁচে।
ধাক্কা খেতে খেতে বাঁচে। উবুড় হয়ে চিৎ হয়ে জীবনকে অতিক্রম
করে যায়। আয়ুকে নদীর ঢেউয়ের মতো বুকের উপর পেতে চায়।
আমি তোমাকে ঐভাবে পেতে চেয়েছিলাম। কিন্তু চোখের ওপর
মরা প্রজাপতির ডানার গুঁড়ো এসে ঝাপটা মারলো। এখন
আমি কি করবো? আমি কি তোমার কল্পনা ছেড়ে
হাত গুটিয়ে বসে থাকবো?
আমি যখন চক্ষুষ্মন ছিলাম তখন যেমন মানুষের দুঃখ-কষ্ট
ও প্রতিবাদের সাথে এক হয়ে নিশান উড়িয়ে দিয়েছিলাম। ভেবো
এখনও তেমনি আছি। কেবল চোখ না থাকায় তোমার মতো
লালমুখ নিয়ে বিচরণশীল পুঁজির দৌরাত্ম্যের বিরুদ্ধে মিছিলে যেতে পারি না
মাঝে মাঝে ভাবি আমার যদি আরো কয়েকটি চোখ থাকতো তা
তোমার গলায় মালা করিয়ে পরিয়ে দিতাম।
আমি ভূমিকম্পের সঠিক খবর তোমাকে দিতে পারি। আমি
কম্পন যন্ত্রের মতো ভূ-গর্ভে গলিত লাভা স্রোত উগড়ে দেওয়ার খবর
তোমাকে জানাবো বলে ওঁৎ পেতে আছি। আমি ধ্বংসে বিশ্বাস
করি না বলে মানুষের উপর এখনও আশা ছাড়িনি। আশাকে
প্রজ্বলিত করতে জ্ঞানীদের দৃষ্টিশক্তির প্রয়োজন হয় না। আমি
কল্পনায় তোমার ক্রুদ্ধ লাল মুখের ওপর আরো একটি নয়ন বসিয়ে
দেব। তুমি হও পৃথিবীর প্রথম ত্রিনয়না নারী। তোমার বাড়তি
চোখ দিয়ে তুমি মানবকুল বিনাশী পুঁজির অধিপতিদের
আসল চেহারা ভালো করে দেখে নাও। দ্যাখো বিশ্বলুণ্ঠনকারীরা
বিশ্বশাসনে পায়তারা করছে। তারা জানে না তাদের কেয়ামত আসন্ন।
তারা কতদিকে হাত বাড়াবে? পিপড়ের সারির মতো মানুষের সন্তানেরা
পৃথিবীর পৃষ্ঠে উঠে আসার জন্য ঘড়ির কাঁটা গুনছে। আমি অন্ধ না হলে
তাদের মুখ নিশ্চয় দেখতে পেতাম। তুমি একটু কাছে এলে আমি তোমার
মুখের ওপর হাত বাড়িয়ে দেব। দেখব তোমার তিনটি চোখই মর্মভেদী
দৃষ্টি নিয়ে মানবজাতির শেষ লড়াইয়ের দিকে অশ্রুসিক্ত হয়ে আছে।
চতুর্দশপদী
সময়ের স্রোত বয়। কুঁকড়ে যাওয়া কবির শরীর
ব্যাঙের ত্বকের মত অনুভব করে সেই সময়ের গ্লানি;
পানির মতই লাগে কালস্রোত। বল ওগো নিরভিমানিনী
চিড় ধরা এই দেহে কেন বিদ্ধ হয়, এত বিস্মৃতির তীর?