দিল্লি এয়ারপোর্টে এখন জেটপ্লেনের পেটে অবতরণের
কম্পনে আমার স্বপ্নের শিহরণ স্তম্ভিত। এতক্ষণ আমি
নিজামুদ্দীনের দরগায় লায়লাতুল কদরের জিকিরে
মশগুল ছিলাম।
তিনি তো সেই দরবেশ যিনি সম্রাটদের মুখের
ওপর মৃদু হাসি মিশিয়ে বলে দিয়েছিলেন, দিল্লি দূর অস্ত।
আমি কিন্তু আউলিয়ার মাজারে দাঁড়িয়েই অতিকায় তর্জনীর
মত কতুবুদ্দীন আইবেকের বিশাল ইশারা
হৃদয়ঙ্গম করছি।
হিন্দুস্তানের মুক্তির ইঙ্গিত। মাথা এমনভাবে সোজা করে
দাঁড়ানো যা মেঘবৃষ্টি, শীত-গ্রীষ্ম এবং সবরকম
ঝঞাঋতুর দাপটেও অকম্পিত।
সর্বপ্রকার দাসত্বের বিরুদ্ধে এক দাস সম্রাটের বিদ্রোহ কেবল
মাথা উঁচু রাখার ইঙ্গিত মাত্র।
তিনি দাস ছিলেন বলেই উপমহাদেশের দাসত্বের হীনতার
বিরুদ্ধে এই মেঘস্পর্শী মিনার গড়েছিলেন। যা
আজ উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদী পুঁজির বিরুদ্ধে এক
প্রস্তরীভূত অঙ্গুলি সংকেত।
দাঁড়াবার ঠাঁই খুঁজতে গিয়ে এই কীর্তিস্তম্ভের গায়ে একটু
হেলান দিয়ে বসি
কত কবির আত্মা আমাকে জোনাকির মত ঘিরে আলোর
নকশা বুনছে। একটু পরেই আমি শের শাহসুরী
রোড ধরে পুরানা কিল্লার দিওয়ার পেরিয়ে শাহী
মসজিদে আজান দিতে যাবো।
বেপথুমান চিরচঞ্চল কবির আত্মায় এখন গুঞ্জরিত হোক–
দিল্লি নজদিক।
৯-১২-২০০১
একটি চশমা শুধু উড়িতেছে
ডানা আমি গুটিয়েছি। উড়িতেছে চশমা আমার
কানা চোখে থাকে না সে উড়ে যায় আকাশ ভেদিয়া
মানচিত্র ছেড়ে গিয়ে খোজে তার বিচিত্র আহার
পরদেশী জোড়াকাচে কে দিয়েছে অসম্ভব বিয়া?
কানাচোখে থাকবে না উড়ে যাবে অনন্তের কাছে
মেখের উপর বসে ডিম দিবে, ওম দিবে ডিমে
যাতে ফের বৃষ্টি হয় সৃষ্টি হয় পৃথিবীর গাছে
পুষ্পের সমারোহ; ফলভার অনন্ত অসীমে
ফেটে গিয়ে খুলে দিবে তার সব রহস্যের দ্বার
একটি চশমা শুধু ঘুরিতেছে দেখিতেছে সব
কে কোথায় অন্তর্বাস খুলে বলে ওঠে, আমার আমার
এইসব অন্ধকার এইসব আলোর উৎসব।
নয়নবিহীন হে চশমাখানি ফিরে এসো আমার নয়নে
অশ্রুসিক্ত হয়ে তুমি বসে থাকো অন্ধকার কবির শয়নে।
৩০-০১-২০০৩
কানা মামুদের উড়ালকাব্য
উড়াল শিখেছি আমি বহুকাল। শীতার্ত গোলার্ধ ছেড়ে
বরফের কুচি ঝেড়ে এশিয়ার মানচিত্রে গরম
মৌসুমী বায়ুর বেগে ভেসে গেছি, ফুরোয়নি দম
বঙ্গোপসাগরে এসে ঘূর্ণিঝড়, কালবোশেখী মাঝেমধ্যে
আমাকেও নিয়ে গেছে কেড়ে।
পরাজয় মানিনিকো। কানা এই মামুদের আত্মার উড়াল,
পৃথিবীর মেঘবৃষ্টি, রক্তবৃষ্টি, বোমাবর্ষণের আঁচে
ভেবেছি মানুষ তবে মানুষের রক্ত খেয়ে বাঁচে?
ভয় হয়, ভূমধ্যসাগর কবে আদমের রক্তে
হবে লাল?
মানুষের প্রতিবাদ, দীর্ঘশ্বাস অতলান্তিক পার হবে কবে
বুঝিনি, সন্দেহ ছিল। তবু অকস্মাৎ ভেঙে কি পড়েনি বলো
আলিশান পুঁজির প্রতীক?
মানুষের হাহাকার পরাভব মানবে না, এগোবে সে
চূড়ান্ত আহবে।
এগোবে সে আফগানিস্তানে, ফিলিস্তিনে, কাশ্মীরে
ঘড়ির কাঁটার মত ঠিক।
প্রগতির প্রবক্তারা পালিয়েছে। যেমন গীধর
মরণের ইশারায় গ্রাম ছেড়ে শহরে পালায়;
এখনও সাম্যের বুলি, কথাবার্তা নাক বরাবর।
নিজের নাসিকা কেটে খাবি খায় নিজেরই লালায়।
পালায় পালায় লাল শেয়ালেরা গুটিয়ে বিতণ্ডাবাদী
লেজের জলুস
আছে রে হুক্কাহুয়া, না বোঝে সে ক্যায়সে হুয়া?
আছে পথের কোনো হুঁশ।
২
কানা মামুদ, কানা মামুদ
কোথায় পেলে ওড়ার বারুদ?
আত্মা তোমার হাউই হয়ে
শূন্যে ওড়ে দিগ্বিজয়ে।
যাচ্ছে মেঘের পুচ্ছ ঘেঁষে
অবলীলায় চাঁদের দেশে।
এমন ওড়ার শেষ কি আছে
নিজের গ্রহেই ভোঁদড় নাচে।
গ্রহান্তরে কী পাবে আর
নিজের ঘরেই ইফেল টাওয়ার।
হায়রে কানা মামুদ কানা
নিজকে নিয়েই পদ্য বানা।
তুইতো বোকা, আদম জাতি
আরম্ভ যার আত্মঘাতি।
কানা মামুদের উড়ালকাব্য-২
এখন আমার রাত্রির ভিতর দিয়ে চলা।
অন্ধকারকে একটি সপ্রাণ জগতের মত মনে হয়। আলোর বিন্দু কোথাও নেই, একদা যখন আলোর জগতে ছিলাম তখন তোমার হাসির যে ছটা আমার রক্তকে মথিত করে তুলতো আঁধারের ভেতরে এসে সেই হাসিকে কল্পনায় ফিরিয়ে আনতে চাই।
কিন্তু হাসি যে কারণে হাসি হয়ে ওঠে সেই শব্দকে তো আর ফিরিয়ে আনতে পারবো না।
আমি জানতাম আলোর পরেই অন্ধকার আছে।
কিন্তু সে অন্ধকারে পৌছুতে জীবনকে অন্য কোথাও রেখে আসতে হয়। আমি এসেছি জীবনের সমস্ত অনুভূতি অবিকল রেখে এই অন্ধকারের জগতে। এখানে কারো মুখ দেখা যায় না। না মানুষ, না প্রাণী, তবে আমি আন্দাজ করতে পারি। কারও মুখ না দেখলেও তার অবয়ব দেখে বুঝতে পারি যে এই আয়তনটা আমার চেনা। তবু বলব আমি চেনা জগতের বাইরে চলে এসেছি।
আগে বাতাসকে নিষ্প্রাণ ইথারের তরঙ্গ বলে ভাবতাম।
এখন কেন যেন মনে হয় আমি তাকে সালাম বললে সে উত্তর দেবে। থামতে বললে শিরশির শব্দ তুলে সে থেমে যাবে।
কোনও কিছুই যেন অনাত্মীয় নয়, বোবা বা বধির নয়।
আমি আগে গাছের সাথে কথা বলতাম সেটা ছিল দৃষ্টির জগত। অভ্যেস এখনো ত্যাগ করিনি। গাছের পাতারা সরসর শব্দ তুলে আমার কথার জবাব দিতে থাকে। আমাকে মানুষের মতই কানা বলে ভালোবেসে ঠাট্টা মশকরা করে, আমি গাছের কথায় আসি। পুকুরের মাছের কলকাকলি ও নিঃশ্বাসের শব্দ শুনি।
তবে সবার কাছে তো যেতে পারি না, কেউ হাত ধরে না নিয়ে গেলে হোঁচট খেয়ে পড়ে যাবার ভয়।