দৃশ্যটা দেখে লোকটা পিস্তলের নলটা আকাশের দিকে রেখে পর পর দুটি ফাঁকা গুলী ছুঁড়ল। মাটিতে পড়ে যাওয়া মা তার শিশুটিকে বুকে নিয়ে দিশেহারার মতো উল্টো দিকে অর্থাৎ আমাদের দিকে দৌড়ে আসছে দেখে রাজাকার ও তার দলবল হো হো করে হেসে উঠল। মাটা শিশুসহ আমাদের খুব কাছাকাছি এসে হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়েই আমাদের অর্থাৎ মাটিতে আষ্টেপৃষ্টে শাড়ি দিয়ে বাঁধা আমি, উদাসীনভাবে চুলের খোঁপাখুলে পিঠ ঢেকে বসে থাকা সীমা ও শাড়ি খুলে হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা। নন্দিনীকে দেখেই সে আবার পেছন ফিরে দৌড়ুতে লাগল। তার সাথের সকলেই এর মধ্যে মাঠ পার হয়ে গাছপালার আড়ালে চলে গেছে। ফাঁকা মাঠের ওপর শিশুটিকে বুকে চেপে ধরে সে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটছে দেখে লোকগুলো পেছন থেকে রাইফেলের ফাঁকা আওয়াজ ও অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল। মেয়েটা মাঠের শেষ সীমায় পৌঁছে আরও একবার আছাড় খেয়ে মাটিতে পড়ে আবার উঠে দৌড়ুতে লাগল। মেয়েটা চোখের আড়ালে চলে গেলে লোকটা নন্দিনীর হাত থেকে শাড়িটা নিয়ে সঙ্গীদের দিকে ছুঁড়ে দিল।
এই মুরগী দুটোকেও বাঁধ। টাকাকড়িগুলো গুটিয়ে বেঁধে আমার হাতে দে। আর সব কয়টাকে নিয়ে আয়, এই দিলা।
লোকটা তার এক সঙ্গীকে ইঙ্গিত করল। দিলা বলল, হুকুম করেন সুবেদার সাব।
তোর বাড়িতে নিয়ে আয়। কাল সকালে ঠিক জায়গায় চালান করব। আজ রাত একটু হাতিয়ে দেখতে হবে সোনা-রুপো কিছু এখনও শরীরটরিরে কোথাও লুকিয়ে রেখেছে কিনা! তোর বাড়িতে আজ আমরা সবাই মেহমান।
কথাগুলো বলে সুবেদার দিলার দিকে ইশারা করে হাসল।
দিলা আমতা আমতা করে বলল, স্যার আমার বাড়িতে এতগুলো মানুষের জায়গা কোথায়? তাছাড়া এই গাঁয়ে একটাও মানুষ নাই। সব ইণ্ডিয়ায় চলে গেছে। সব এখন মুক্তিযোদ্ধা। আমি আর আমার মেয়ে থাকি। মেয়েটার জামাই মেয়েটাকে ফেলে ইণ্ডিয়ায় ভেগেছে। আমরা আপনার কথায় বর্ডার পাহারা দিই। আমার বাড়িতে ঐসব কারবার দেখলে আমার মেয়েটা ভয় পাবে। তাছাড়া….
থাক, থাক। তুই আর অজুহাত দেখাবি না। ঠিক আছে তোর বাড়িতে যখন একটা মেয়ে আছে তখন গাঁয়ের অন্য একটা খালি বাড়িতেই এদের নিয়ে চল। তোর মেয়েকে দিয়ে শুধু আমাদের জন্য রান্নাটা বেঁধে আনবি। নাকি এটাও পারবি না? এদিকে তো প্রতি ক্ষেপে টাকাকড়ি সোনাদানার ভাগ ঠিকই নিচ্ছো। হারামজাদা!
গালমন্দ করবেন না সাব। ঠিক আছে, আমার বাড়ি থেকে আমি ডালভাত যা পারি বেঁধে আপনাকে পৌঁছে দিয়ে আসব, আপনি কোথায় কার বাড়িতে আস্তানা গাড়বেন বলুন?
বেশ ঠান্ডা আর দৃঢ় গলায় দিলা তার মতামত ব্যক্ত করল। সুবেদার আর তেরিমেরি না করে বলল, এদের নিয়ে নিতাই মেম্বারের খালি বাড়িতে চলে আয়। সেখানেই আজকের মালামাল ভাগবাটোয়ারা হবে। আমি চললাম। তোরা পেছন পেছন এদের নিয়ে আয়। গামছাটা গুটিয়ে বেঁধে দিস্?
.
যে লোকটা গামছায় রাখা টাকাকড়ি ও গহনাপত্র এতক্ষণ গুটিয়ে নিয়েছিল সে নিঃশব্দে সুবেদারের হাতে তা তুলে দিল।
একিন কর, আমি তোদের বখরা মেরে দেব না। আর যে হারামিপনা করবে তাকেই গুলী খেয়ে মরতে হবে। সোজা ক্যাম্পে চালান দেব। সাবধান। আমার সাথে যতক্ষণ আছিস পাঞ্জাবিরা তাদের ঘাটাবে না। বেগারও খাটতে হবে না। প্রতিরাতেই তো তোদের মালদার বানিয়ে দিচ্ছি। একবেলা ভাত জোটাতে পারতিস না, এখন তিনবেলা মুরগি আর ছাগলের রান চিবুচ্ছিস। আর সব শালাদের তো ঐসবেরও ভাগ দিচ্ছি।
বাঁ হাতের বুড়ো আঙুলটা সোজা কারে একটা অশ্লীল ভঙ্গীতে হাসল লোকটা। একবার নন্দিনী ও সীমার অসংবৃত দেহের ওপর চোখ বুলিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে হাসল।
সঙ্গের অন্যান্য লোকগুলো এবং দিলা কিন্তু হাসল না। এরা রাইফেল আমার ওপর বাগিয়ে রেখে মাথা নুইয়ে রাখল। পিস্তলটা কোমরের বেল্টে খুঁজে রেখে সুবেদার মাঠের দিকে হাঁটা দিল।
লোকগুলো আমাদের পিঠে রাইফেল ঠেকিয়ে মাঠ পার করে ঠেলে নিয়ে চলল। হাঁটার সুবিধার জন্য আগেই আমার পায়ের বাঁধন খুলে দেয়া হয়েছিল। বাড়তি শাড়ির দড়িটা দিয়ে আমার বাঁধা হাতগুলো আরও শক্ত করে পেঁচিয়ে গিট দেয়া হয়েছে। সীমা ও নন্দিনীর হাত খুলে দিয়ে নন্দিনীর শাড়িটাকেও পাকিয়ে দড়ির মতো করে দুপ্রান্ত দিয়ে দুজনের কোমর পেঁচিয়ে শক্ত করে বাঁধা। বাঁধার সময় এরা যেমন কেউ বাধা দেয় নি তেমনি মানুষগুলোও মেয়েদের সাথে কোনোরূপ অশালীন আচরণ করে নি। সুবেদার চলে গেলে দিলার নির্দেশেই রাইফেলধারী ছেলেগুলো আমাদের বাঁধাছাদা করেছিল। এখন তার হুকুমেই তিনজনেরই পিঠে নল ঠেকিয়ে এগিয়ে নিয়ে চলেছে। আমরা কেউ কোনো কথা বলছিলাম না। এমন কি পরস্পরের মধ্যেও না। নন্দিনী শুধু আমার শাড়ির দড়িতে বাঁধা বাহু ধরে হাঁটছে। তার চোখেমুখে কিছুক্ষণ আগের সেই ভয়বিহ্বল পাঁশুটে ভাবটা যেন শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। সীমাকেই শুধু আমার কাছে প্রাণহীন লাশের মতো মনে হল। তার চুলগুলো খোঁপা ভেঙে উদ্দাম হয়ে পিঠ ছাপিয়ে কোমর ঢেকে ফেলেছে। তার পরনের পেটিকোট ও খালি ব্লাউজে তাকে উপজাতীয় মেয়ের মতো লাগছে। নন্দিনী আরও একটু বেশি নিরাভরণ হয়ে হাঁটছে। পরনে পেটিকোট থাকলেও তার গায়ের ব্লাউজটা টেনে ছিঁড়ে ফেলায় সে শুধু একটা সিকের কাঁচুলী পরা। তবে নিরুপায় অবস্থায় নারীর লজ্জা উন্মুক্ত করে ফেললে তাদের মধ্যে এক ধরনের উপেক্ষা ও উদাসীনতাই অদৃশ্য পোশাক হয়ে যায় বলে আমার ধারণা হল। কারণ আমার সঙ্গিনী দুজনই এখন আমাদের শত্রু এবং ইজ্জতের জিম্মাদারদের সামনে নিজের অর্ধাচ্ছাদিত দেহ সম্বন্ধে সম্পূর্ণ উদাসীন।