রেজা ভাইয়ের আপনার কবি এসেছেন শব্দটি শুনেই নন্দিনী এতক্ষণ ধরে থাকা আমার হাতটি তার মুঠো থেকে অন্ধকারে নিঃশব্দে ছেড়ে দিল। কিন্তু এবারও ভেতর থেকে কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না।
রেজাভাই বারান্দা থেকে মুখ বাড়িয়ে আমাকে বললেন, ভেতরে কেউ নিশ্চয়ই আছে। মনে হয় ভয়ে সাড়া দিচ্ছে না। আমার মনে হয় কবি ভাইয়ের গলা শুনলে পরিচিত কেউ বাসায় থাকলে উঠে আসবেন। আপনি এসে ভাবিকে ডাকুন না।
এ কথায় আমি যেই সিঁড়িতে পা দিয়েছি অমনি পাশের বাসার বাতি জ্বলে উঠল এবং দুয়ার খুলে আমার প্রতিবেশী খাদেম সাহেব বেরিয়ে এলেন। দরজায় এসে তার স্ত্রী ও কন্যা কৌতূহল ভরে দাঁড়িয়েছে। খাদেম সাহেবের মেয়েটি হঠাৎ আনন্দে চিৎকার করে উঠল, ওমা কবি চাচা এসেছেন। আমি গিয়ে পাঁচিলের ওপাশ দিয়ে দরজা খুলে দিচ্ছি। চাচি তো বিছানা ছেড়ে নামতে পারবে না।
খাদেম সাহেব এগিয়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন, আল্লাহ আপনাকে সুস্থদেহে ফিরিয়ে এনেছেন এজন্য হাজার শোকরগোজার করছি। যান, ভিতরে গিয়ে দেখুন কী অবস্থা। আপনার স্ত্রী তো দুদিন আগে গুরুতর অবস্থায় বাসায় ফিরেছেন। কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা স্ট্রেচারে করে তাকে এখানে আমাদের তত্ত্বাবধানে রেখে গেছে। কোমর থেকে নিচের দিকটা একদম নাড়াতে পারছেন না। দু’রাত আমার স্ত্রীই তার সাথে থেকে তার দেখাশোনা করছেন। আজ তিনি নিজেই বললেন তিনি রাতটা একাই থাকতে পারবেন। আমার মেয়েটা থাকতে চেয়েছিল তাকেও থাকতে বারণ করলেন।
ভদ্রলোকের কথা শেষ হওয়ার আগেই আমার বাসার ভেতরে আলো জ্বলে উঠল এবং কপাট খুলে দিল খাদেম সাহেবের মেয়েটি।
আসুন, কবি চাচা, চাচিকে জাগিয়ে দিয়েছি।
আমি ভেতরে ঢুকেই অবাক হয়ে গেলাম। আমার ছোট তিন কামরার এই বাসায় যত আসবাব ও বইপত্র ছিল এর কিছুই নেই। বসার ঘরটা একেবারেই ফাঁকা।
খাদেম সাহেব বললেন, এ পাড়ায় বেপরোয়া লুটতরাজ হয়েছে। আমরা গাঁয়ের বাড়িতে পালিয়ে গিয়েছিলাম। ষোল তারিখ ফিরে এসে দেখি আপনার, আমার আর পাড়ার পলাতক গৃহস্থদের কিছুই অবশিষ্ট নেই। এমনকি চৌকি, খাট, লেপতোষক, বালিশ, বাসন কোসন সবই লুট হয়ে গেছে কবি সাহেব। আপনার স্ত্রীকে যারা এখানে আমাদের জিম্মায় রেখে গেছে তারা কোত্থেকে যেন একটা জাজিম এনে ফ্লোরে পেতে তাকে শুইয়ে দিয়ে গেছে।
একথা শুনে আমি দ্রুত গিয়ে শোয়ার ঘরে ঢুকলাম। আমার পেছনে রেজাভাই, নন্দিনী ও রেজাভাইয়ের তিনজন রাজনৈতিক সঙ্গী।
ভেতরে ঢুকেই দেখলাম ফ্লোরে একটা খোলা জাজিমে বিছানো শাড়ির ওপর সটান শুয়ে আছে হামিদা। অসুস্থতার ধকলে শরীর খানিকটা শীর্ণ মনে হলেও বাহু উন্মুক্ত থাকায় স্বাস্থ্যের দীপ্তি একেবারে ম্লান হয় নি। তার বিশাল দুটিচোখ আমাকে দেখা মাত্রই পানিতে ভিজে গেল। মুখে ম্লান হাসিটি বজায় রেখেই বলল, কখন ঢাকায় এসে পৌঁছুলে?
এই তো দুঘণ্টা আগে।
আমার খোঁজ পেয়েছিল? এই আমার আহত হওয়ার খবর?
হ্যাঁ, জেনেছিলাম।
সে আসে নি?
কার কথা বলছ, নন্দিনীর?
আমি কিছু বলার আগেই পেছন থেকে নন্দিনী বলল, আমিও এসেছি বৌদি, তোমাকে একনজর দেখে জীবন ধন্য করতে এসেছি। আমাকে ক্ষমা করে দাও বৌদি। … বলেই নন্দিনী হুমড়ি খেয়ে জাজিমের পৈথানে হামিদার অনড় পা দুটিতে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করে ফুঁপিয়ে কেঁদে ফেলল।
হামিদা হাত বাড়িয়ে নন্দিনীর বেণীটা স্পর্শ করতে পারল মাত্র। নন্দিনীর কান্না এই স্নেহপর্শে দ্বিগুণতর বেগে ফুলে উঠছে দেখে হামিদা বলল, বিশ্বাস কর বোন আমি তোমার জন্যেই অপেক্ষা করছিলাম।
এ কথায় নন্দিনীর কান্না সহসা থেমে গেল। সে উত্তেজিত কণ্ঠে বলতে লাগল, আমার অপেক্ষা? জানি কিসের অপেক্ষা। কবি আমাকে বলেছে তুমি নাকি বলেছ আমি এলে তুমি কবিকে ছেড়ে চলে যাবে। আমার মতো একজন পাপী মেয়ের লোভের কাছে পরাজিত হয়ে তুমি তোমার সংসার ছেড়ে চলে যাবে বৌদি? তুমি না একজন বিজয়ী মুক্তিযোদ্ধা? আমার মতো পাপীকে, লোভীকে এক্ষুণি গুলী করে মেরে ফেলতে পার না বৌদি? তোমার পকেটে তো শুনেছি সব সময় একটা পিস্তল থাকতো। আমাকে মেরে ফেল বৌদি, আমাকে শেষ করে দাও।
নন্দিনী শিশুর মতো বিলাপ করতে করতে হামিদার পায়ের তালুতে মুখ ঘষতে লাগল। এ অবস্থায় আমি দেখলাম হামিদা যেন উঠে বসতে চাইছে কিন্তু পেরে উঠছে না। আমি দ্রুত এগিয়ে গিয়ে তার পিঠের নিচে আস্তে চাপ দিলাম। আমার দেখাদেখি রেজাভাইও হামিদার সাহায্যে এগিয়ে এসে তাকে আস্তে করে পিঠে হাতের ঠেলা রেখে বসতে সাহায্য করলেন। হামিদা বসেই নন্দিনীকে বুকে জড়িয়ে ধরল।
আমি তোমাকে এবং কবিকে রেখে চলে যাওয়ার কথা যুদ্ধের দিনগুলোতে একবার ভেবেছিলাম নন্দিনী। তখন আমি সুস্থ ও সক্ষম ছিলাম। আমার একজন সতীন থাকবে। এটা ছিল আমার কাছে একদম অসম্ভব ব্যাপার। আমি এখন আর একজন নারী হিসেব সক্ষম নই। আমার স্বামীর যোগ্যও নই। যে কারণে একজন নারী অন্য নারীর আওতায় তার পুরুষকে এক মুহূর্তের জন্য ছাড়তে চায় না, আমার সেই সম্পদ, নন্দিনী, বোন আমার, আমি বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য তা খুইয়ে ফেলেছি। আর তা কোনো দিন ফিরে পাব না। আমাকে আর কবিকে ফেলে তুই কোথাও যাস না নন্দিনী। আজ থেকে এ সংসার তোর। আমি পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা, নিরাশ্রয় মানুষ। তোর কবির কোনো কাজে লাগব না। তবে কবিকে ছেড়ে কোথাও যেতেও পারব না কারণ তোর মতো আমারও এ সংসারে আপন বলতে কেউ নেই। কোথায় যাব? রাষ্ট্র হয়তো পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আমার দায়িত্ব নিতে রাজি হবে। কেন হবে না? কিন্তু আমি তোদের সাথেই থাকতে চাই নন্দিনী। তোদের প্রেম ভালবাসা সন্তান সন্ততি দেখে সুখ পেতে চাই।