হামিদার এই সোজা সরল অভিব্যক্তিতে আমি হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম। হামিদা কত সহজেই আমার আর নন্দিনীর সম্পর্কটিকে মেনে নিয়েছিল। আমি হামিদাকে বহুদিন থেকে জানি। আমার স্ত্রী বলেই যে তাকে জানতাম এমন নয়। বিয়ের আগে থেকেই জানতাম। আবেগ ও বাস্তববুদ্ধির এমন একটি মেয়েমহিমা আমার পরিচিত বৃত্তের মধ্যে ছিল না বলেই হামিদাকে আমার চোখে পড়েছিল। আর হামিদা আমার দৃষ্টিতে চিরকালই ছিল এক আকর্ষণীয় সুশ্রী মেয়ে। হামিদাকে যে আমি কতটা ভালবাসি তা আর তার কাছে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার কোনো উপায় না থাকলেও আমার বর্তমানকালের বিপর্যয়কর সম্পর্ককেও আমি অস্বীকার করতে পারি না এবং পারছি না। আমার অপরাধ কী এই, আমি দুটি মেয়েকেই ভালবাসি?
নন্দিনীর কথায় রেজাভাইও কেমন যেন একটু বিহ্বল দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে ছিলেন। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে রেজাভাই আমার দিকে সান্ত্বনার ভঙ্গিতে বললেন, আমার ধারণা আপনার স্ত্রী ষোল ডিসেম্বরের পর আপনাদের সাবেক বাসাতেই ফিরে এসেছেন। এখন তো আর লুকিয়ে থাকার প্রয়োজন দেখি না। যদি তার শারীরিক অবস্থা একেবারেই সটান শুয়ে থাকার মতো না হয়ে গিয়ে থাকে তাহলে তাকে বাসায় গিয়েই পাবেন। আর যদি শরীরের নিম্নাংশ পঙ্গু হয়ে গিয়ে থাকে তবে তাকে সম্ভবত হাসপাতালগুলোর কোনো একটায় পাওয়া যাবে। আমি শুধু এটুকুই আন্দাজ করতে পারি তিনি হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের পর বিপদমুক্ত পরিবেশেই কোথাও অবস্থান করছেন। এ নিয়ে আপনি আর টেনশনে থাকবেন না। আর আমি তো কলকাতা ছাড়ার আগেই আমার পার্টির প্রতি সহানুভূতিশীল মেডিক্যাল প্রফেসনের লোকদের এবং ছাত্রদের ইন্সট্রাকশন পাঠিয়েছিলাম আপনার স্ত্রীকে খুঁজে বের করে চিকিৎসা করতে। আপনার দেয়া ঠিকানাও তাদের পাঠানো হয়েছিল। যদি সত্যি তারা তাকে পেয়ে থাকেন তবে জানবেন আপনার স্ত্রী যেখানেই থাকুন অযত্নে নেই।
আমি ও নন্দিনী পরস্পরের দিকে তাকালাম। কারো মুখ থেকে কোনো কথা বেরুল না।
.
সদরঘাটে নেমে রেজাভাই বিশাল গয়না নৌকার মতো ডিঙ্গিনাওয়ের মাঝিদের ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে ডাঙায় উঠলেন। তার অন্যান্য কমরেডের সাথে আমি আর নন্দিনীও বাকল্যান্ড রোডের ওপর উঠে এলাম। আমি বহুক্ষণ ধরে সিগ্রেটের অভাবে কষ্ট পাচ্ছিলাম। সদরঘাট এসেই মনে হল এক প্যাকেট সিগ্রেট কিনি। কিন্তু সমস্ত এলাকাটাই কেমন যেন অন্ধকার। এর মধ্যে ইসলামপুর কিংবা ওয়াইজঘাট রোড থেকে ক্রমাগত আকাশের দিকে গুলী ছুঁড়ে আনন্দ করার মতো শব্দ এবং হইহল্লা ভেসে আসছিল।
আমি বললাম, রেজাভাই একটা সিগ্রেট খেতে ইচ্ছে করছে। গত চব্বিশ ঘণ্টা ধরে ধূমপান করি নি। আপনার কাছেও সিগ্রেট ছিল না। আমার কাছেও। এক প্যাকেট সিগ্রেট কিনব তেমন দোকান দূরে থাক সারা সদরঘাটে রাত সাড়ে বারোটায় একটা বাতিও জ্বলছে না এটা কেমন কথা?
এই অবস্থা থেকেই ঢাকার পরিবেশটা আন্দাজ করে নিতে হবে। সতর্কতার সাথে এগোতে হবে। এখন সিগ্রেটের চেয়ে যে জিনিসটা আমাদের বেশি দরকার তা হল কিছু খাবারের। আজ দুপুর থেকে নদীতে উপোষ দিয়ে চলতে হয়েছে। ভেবেছিলাম সদরঘাট নেমে হোটেল থেকে কিছু খেয়ে নিয়ে শহরের দিকে যাব। কিন্তু দেখতেই পাচ্ছেন শহরের অবস্থা স্বাভাবিক নয়। মনে হচ্ছে হেঁটেই যার যার গন্তব্যে পৌঁছুতে হবে। এখন বলুন আপনি কী এ রাতেই আপনার বাসায় যেতে চান?
প্রশ্ন করলেন রেজাভাই।
আমি বললাম, শহরের এ অবস্থায় নন্দিনীসহ হেঁটে হেঁটে শাজাহানপুর যাওয়ার ভরসা পাচ্ছি না রেজাভাই। যেরকম বেপরোয়া গুলীর শব্দ হচ্ছে তাতে নিরাপদে পথচলা বোধহয় সম্ভব হবে না। তার চেয়ে আজ রাতটা আপনারা যেখানে যাবেন কিংবা থাকবেন আমাদেরও সেখানেই নিয়ে চলুন।
আমরা আপনার বাড়ির কাছেই আমাদের এক শেল্টারে যাব। খিলগাঁও বাগিচায়। চলুন আপনাদের রাসায় পৌঁছে দিয়েও যেতে পারব। তবে সারাটা পথ কিন্তু হেঁটেই যেতে হবে।
বলেই আমাদের তার সাথে চলার ইঙ্গিত করে রেজাভাই হাঁটা শুরু করলেন। আমিও নন্দিনীর হাত ধরে জমাট বাঁধা কালিমার মতো ঢাকা শহরের অন্ধকার উদরের দিকে হাঁটা শুরু করলাম।
.
আমরা রাত আড়াইটার দিকে শাজাহানপুর আমার বাসার সামনে এসে দাঁড়ালাম। একতলা বাড়ি। রাস্তা থেকে ঝিল পর্যন্ত লম্বা দালান। দালানটার শেষ দিকের তিনটে কামরা নিয়ে আমি ও হামিদা থাকতাম। আমাদের বাঁদিকে খাদেম সাহেব বলে একজন শ্রমিক নেতা সপরিবারে দুটি কামরা নিয়ে থাকতেন। প্রায় ন’দশমাস পর নিজের বাসার সামনে এসে মনটা কেমন যেন করতে লাগল। মনে হল একটা অজানা ভয়ে হৃদয় কাঁপছে। হৃদপিন্ডের দুলুনিতে শরীরটাও কাঁপছে। নন্দিনী বোধহয় আমার অবস্থাটা উপলদ্ধি করে আস্তে ফিসফিস করে বলল, এ বাসায় তো কেউ আছেন বলে মনে হচ্ছে না কবি। আমি কড়া নাড়ব?
রেজাভাই বললেন, আপনারা দাঁড়ান। আমিই ডাকছি।
আমার নড়ার সাহস হল না। রেজাভাই বারান্দায় উঠলেন।
অন্ধকারে দরজার কড়ায় হাত দিয়েই বললেন, ভেতরে লোকজন আছে মনে হচ্ছে।
রেজাভাই কড়া নাড়লেন।
কেউ আছেন বাড়িতে?
ভেতর থেকে কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না।
রেজাভাই আবার কড়া নেড়ে বললেন, দরজা খুলুন হামিদা বোন। আপনার কবি এসেছেন।