.
আমরা সবাই টেবিলে গিয়ে বসলাম। একটু পরেই মুরগীর গরম ঝোল, দুটি আস্ত পাউরুটি এবং একপ্লেট ভাত এনে পারুল রেজাভাইয়ের সামনে রাখল। আমি ও ইমাম ছাড়া বাকি চারজনই গোগ্রাসে খেতে লাগল। ইমাম বলল, খাওয়ার পর আপনাদের দুজনকে ড্রয়িংরুমে সোফায় চাদর মুড়ি দিয়ে ঘুমোতে হবে। আর বাকি দুজন শোবেন কবি ভাইয়ের খাটে। একটু কষ্ট হবে।
রেজাভাই খেতে খেতে বললেন, কষ্টের কথা কেন বলছেন? আজরাতে দারুণ ঘুম হবে। এটাই সম্ভবত কলকাতায় আমাদের সবচেয়ে নিরাপদ শেষরাত। আপনি নিশ্চিন্তে গিয়ে শুয়ে পড়ুন।
.
স্বভাবতই পরদিন দেরি করে ঘুম ভাঙল আমার। পারুলের ডাকে চোখ মেলে সোজা বিছানায় উঠে বসে গেলাম, এখন কটা বাজে?
নটা। আপনার বন্ধুরা সবাই নাস্তা সেরে ড্রয়িংরুমে জমায়েত হয়েছে। দিদিও আছেন। ক্যাপ্টেন গজনফরের সাথে কথা বলছেন। সেই যে যার টাকার ব্যাগ দিদি নিয়ে এসেছিলেন?
হেসে বলল পারুল।
আমি বললাম, আমাকে জাগাস নি কেন?
ইমাম বলল আপনি ক্লান্ত, আজই বিকেলে ঢাকার দিকে রওনা হবেন। একটু বেশি ঘুমিয়ে নিলে শরীর ঠিক থাকবে তাই ডাকি নি।
আমি বললাম, ঠিকই আছে। আমি হাতমুখ ধুয়ে আসি, তুই টেবিলে নাস্তা লাগা।
ডাইনিং টেবিলে বসে খাওয়ার সময় নন্দিনী ক্যাপ্টেন গজনফরকে নিয়ে সামনে এসে দাঁড়াল, চিনতে পারছ?
আমি ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে বললাম, হ্যাঁ, রেজাভাইয়ের কাছে পরিচয় জেনেছি।
ক্যাপ্টেন গজনফর আমার পাশে এসে বসতে বসতে বললেন, আপনাদের কাছে কী বলে কৃতজ্ঞতা জানাব? যে অবস্থায় আপনারা স্যুটকেসটা আমাদের লোকদের কাছে এনে পৌঁছে দিয়েছেন তা অবিশ্বাস্য। শুধু এটুকু বলতে পারি আপনাদের মতো লোক থাকলে দেশ দুর্ভোগ কাটিয়ে উঠবে। আপনাদের সাথে আমিও ঢাকায় যাচ্ছি। এখন থেকে সব সময় যোগাযোগ থাকবে।
.
খাওয়ার পর আমরা সবাই পারুলদের ড্রইংরুমে এসে বসলাম। রেজাভাই আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, আজ সন্ধ্যায় আমরা বর্ডার ক্রশ করব। কলকাতা ছাড়তে হবে বেলা দুটোয়। নষ্ট করার মতো সময় আমাদের হাতে নেই। কেউ কোনো ভারি জিনিসপত্র এমন কী একাধিক কাপড়চোপড়ও সঙ্গে নেবেন না। যতটা দ্রুত সম্ভব আমরা ঢাকায় গিয়ে পৌঁছতে চাই। যদিও জানি আমাদের ঢাকার ঢুকবার আগেই ভারতীয় বাহিনী বাংলাদেশের বর্ডার ক্রশ করবে।
.
১২.
আঠারোই ডিসেম্বর মধ্যরাতে রেজাভাই আমাদের নিয়ে সদরঘাটে নৌকা থেকে নামলেন। যেভাবে আমাদের আসার কথা ছিল বলাবাহুল্য আমরা সেভাবে আসতে পারি নি। সেভাবে এলে আমরা ঢাকা এসে পৌঁছুতাম ষোল ডিসেম্বর নিয়াজির সারেন্ডারের এক সপ্তাহ আগে। নানা প্রতিকূল অবস্থায় এক গ্রাম থেকে অন্যগ্রামে রেজাভাইয়ের নিজস্ব রাজনৈতিক যোগাযোগের সূত্র ধরে আমরা এগিয়ে এসেছি। আমাদের পাশ কাটিয়ে উল্লসিত মুক্তিযোদ্ধারা ভারতীয় বাহিনীকে পথ দেখিয়ে ঢাকার পথে নিয়ে গেছে। গুলীর শব্দে সারা বাংলাদেশের পল্লী এলাকাকে প্রকম্পিত করে যাওয়ার বিজয়োল্লাস আমরা চোখে না দেখলেও কানে শুনতে পেয়েছি। এই উল্লাস ধ্বনিতে নন্দিনী একবার লাফিয়ে উঠে রেজা ভাইয়ের হাত চেপে ধরেছিল, আমরা কি, রেজাভাই, এদের সাথে হেঁটে হেঁটেই ঢাকায় চলে যেতে পারি না?
রেজাভাই গম্ভীর মুখে হেসেছেন, পারতাম যদি আপনি আমাদের সাথে না থাকতেন। এখনকার সময়টার কথা বিবেচনা করতে হবে। এখনকার এই গ্রুপগুলো যারা ঢাকার দিকে এগোচ্ছে তারা একদিকে যেমন প্রতিহিংসা পরায়ণ তেমনি অনেক প্রিয়জনকে হারিয়ে ক্ষিপ্ত। যদিও হানাদাররা ষোল ডিসেম্বর আত্মসমর্পণ করেছে এবং ইন্ডিয়ান আর্মি প্রতিশ্রুতি দিয়েছে রক্তপাত বন্ধের। তবুও যুদ্ধ পরবর্তী বিশৃঙ্খলা ও হিংস্রতা দমনের ক্ষমতা তাদের হাতে থাকবে বলে মনে হয় না। সামাজিক অরাজক অবস্থা কতদিন চলবে তা এখনই আন্দাজ করা সম্ভব নয়। এ অবস্থায় একটু ঘুরপথে পাড়াগাঁর নদীনালা ধরে আমরা এগোব। সদর রাস্তা ধরে যেতে চাইলে আমরা আরিচা দিয়েই যেতে পারতাম। কিন্তু আমি মনে মনে স্থির করেছি আমরা নদীপথ ধরে একটু সময়ক্ষেপণ করে সদরঘাট গিয়ে নামব। এ ব্যাপারে আপনার কী কিছু বলার আছে কবি ভাই!
না রেজা ভাই। আমি আপনার ধীরে এগোনোর কারণটা মোটামুটি আন্দাজ করতে পারছি। নন্দিনী একটু অস্থির হয়ে পড়েছে বটে। তবে বিলম্বে ঢাকার প্রবেশের ফল আখেরে আমাদের জন্য ভালোই হবে।
বলেছিলাম আমি। আমার কথার ওপর নন্দিনী হঠাৎ কথা চালিয়ে বলে উঠেছিল, আমি জানি না লাখ লাখ দেশত্যাগী নরনারী আর মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে এমন কেউ আছে কিনা যে এই মুহূর্তে নিজেদের বাড়িঘর এবং আত্মীয়দের মধ্যে পৌঁছুতে চায় না। আমার অবশ্যি আত্মীয় বলতে পৃথিবীতে কেউ নেই। ঢাকা আমার দৈনন্দিন থাকারও জায়গা নয়। আমি এই মুহূর্তে ঢাকায় থাকতে চেয়েছিলাম কেবল একজনের জন্য। তিনি হামিদা বৌদি। জানি না বেচারা এখন কোথায় কী অবস্থায় আছেন।
নন্দিনীর মুখে হামিদার নাম শুনে সহসা আমার বুকটা কেমন যেন ধক করে উঠেছিল। সত্যি তো হামিদা এখন কোথায়? ষোল ডিসেম্বরের পর নিশ্চয়ই সে এখন আর আত্মগোপন করে নেই। হামিদা আহত মুক্তিযোদ্ধা, নিশ্চয়ই কেউ তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছে। হয়তো এখন সে হাসপাতালের সীটে শুয়ে আমার কথাই ভাবছে। আমার কথাই ভাবছে কি? হামিদা তার সাথে শেষ সাক্ষাতের সময় বলেছিল তাকে পরিত্যাগের আগে আমি ও নন্দিনী যেন অন্তত কয়েকটা দিন অপেক্ষা করি। কারণ তারও আত্মীয়স্বজন বলতে কেউ নেই। হঠাৎ সে কোথায় গিয়ে উঠবে?