ইমাম হেসে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ঘুম আসছিল না বলে রাস্তায় আমরা একটু পায়চারী করব বলে বেরিয়েছি। আর কবি ভাইয়ের সরে ভাসা চা পছন্দ।
ইমামের কথায় দেয়ালের মতো দাঁড়িয়ে থাকা লোকগুলো পকেট থেকে হাত বের করে একটু শিথিল ভঙ্গিতে একটা টেবিল দখল করে বসে পড়ল। কমরেড রেজাও ইমামের সাথে হ্যান্ডসেক করে আমাদের টেবিলে এসে বসলেন।
এরা তিনজন আমার লোক। মুক্তিযোদ্ধা।
খুব অনুচ্চকণ্ঠে রেজাভাই কথা বলছেন।
আপনার কলকাতার কাজ সম্ভবত শেষ। এবার ভেতরে যাওয়ার ব্যাপারে কী ভাবছেন?
আগামীকাল সন্ধ্যায় কলকাতা ছেড়ে যাব। আমি জানি এখানে ভারত সরকারের কাছে আপনি আমার জিম্মাদার। আপনার আর তাজউদ্দিন সাহেবের জন্যই এখানে আমার ওপর কেউ আপাতত নজর রাখছে না। আমিও এখানকার বন্ধুদেরকে আপনার সহযোগিতার কথা জানিয়েছি। তাদেরও ধারণা আগামী দুসপ্তাহের মধ্যেই ভারত আমাদের দেশের ভেতর হস্তক্ষেপ করবে।
ফিস ফিস করে, ইমামের কানের কাছে মুখ নামিয়ে রেজাভাই কথাগুলো শেষ করলেন। ইমাম আর কিছু বলল না। চায়ের দোকানের বয়টা আমাদের সামনে সরেভাসা চায়ের কাপগুলো নামিয়ে রাখল। এখন একজন শিখ ভদ্রলোক ছাড়া দোকানে অন্য কোনো খদ্দের নেই। লোকটা সম্ভবত ট্যাক্সি ড্রাইভার। গলিতে ঢোকার সময় আমরা গলির মুখে একটি ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে এসেছি।
চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে ইমাম বলল, কাল সন্ধ্যায় রওনা দেবেন তো এখন এত রাতে সশস্ত্র সঙ্গীদের নিয়ে পথে পথে ঘোরা কী নিরাপদ?
আমি জরুরি কাজে অর্থাৎ আমার এই কমরেডের বিভিন্ন এলাকা থেকে তুলে আনতে কলকাতার বাইরে গিয়েছিলাম। ফিরতে রাত হয়ে গেল। ভেবেছিলাম সামান্য কিছু খেয়ে আপনার বাসায় গিয়ে আপনাকে জাগাব। আমরা চারজনই অভুক্ত।
আমি বললাম, তাহলে চলুন রেজাভাই বাসায় গিয়ে আমার বোনকে জাগিয়ে কিছু একটু মুখে দেবেন। এখানে তাহলে আর কিছু খাওয়ার দরকার নেই।
এতরাতে তাকে জাগালেই যে খাবার পাওয়া যাবে সেটা কী করে বলা যায়? তিনি তো আর আমাদের জন্য রেঁধে রেখে ঘুমান নি? তারচেয়ে বরং এখানেই চা-বিস্কুট একটু বেশি করে খেয়ে যাই।
দরকার নেই, চলুন বাসায় গিয়ে সবাই মিলে একটা ব্যবস্থা করা যাবে। আপনারা রাতে কিছু খান নি, তাহলে তো এতক্ষণ খুবই কষ্ট পেয়েছেন। চলুন।
বলে ইমাম কাউন্টারের দিকে চায়ের দাম মিটাতে গেলে আমি রেজাভাইকে নিয়ে উঠে দাঁড়ালাম এবং পাশের টেবিলে চা পানরত রেজাভাইয়ের সঙ্গীদেরও ইঙ্গিত করলাম। আমার ইঙ্গিতে সঙ্গী তিনজন চা শেষ না করেই কাপ টেবিলে রেখে উঠে দাঁড়াল। তিনজনই যুবক এবং দেখতে ফর্সা এবং সুদর্শন। তারা আমার দিকে তাকিয়ে একটু হেসে আমাদের টেবিলের পাশ কাটিয়ে কাউন্টার পার হয়ে বেরিয়ে গেলে আমি ও রেজাভাই তাদের অনুসরণ করলাম। ইমামও চায়ের দাম মিটিয়ে আমাদের পেছনে আসতে লাগল।
আমরা রাস্তায় নেমে দেখলাম রেজাভাইয়ের লোকেরা আমাদের থেকে পঁচিশ গজের ব্যবধান রেখে সামনে এগোচ্ছে। রেজাভাই হঠাৎ হাঁটতে হাঁটতে আমার হাতটা, ধরলেন, আমার সঙ্গীদের একজনকে তো আপনার চেনার কথা? এদের তিনজনই আসাম থেকে এখানে এসেছে। এরা তোরা বর্ডার দিয়ে আসামে প্রবেশ করেছিল। একজন টাকার স্যুটকেসটা আপনার সঙ্গিনীকে দিয়েছিল। এখন চিনতে পারছেন? ওই যে মাঝের জন। নাম ক্যাপটেন গজনফর। ইষ্টবেঙ্গল রেজিমেন্টে ছিল।
আমি পেছন থেকে মাঝের ভদ্রলোকের দিকে তাকালাম। এখন ঠিক চেনা যাচ্ছে না। তিনজনই সাফারীর মতো সাদা প্যান্টশার্ট পরা। তিনজনই বেশ লম্বাচওড়া। হাঁটছেনও সামরিক কেতায়। আমি বললাম, বাসায় গিয়ে পরিচয় হবে।
গজনফর আপনাকে দেখেই সম্ভবত চিনেছে। একটু আগে তার হাসি থেকে কিছু বুঝতে পারেন নি? স্যুটকেস এবং টাকা যে আপনারা পৌঁছে দিয়েছেন আমাদের ঠিকানায় জীবন বাজি রেখে একথা আমি গজনফরকে জানিয়েছি। সে আপনার এবং আপনার বান্ধবীর সততায় অতিশয় মুগ্ধ।
তাকে তো আটক করা হয়েছিল ছাড়া পেলেন কী করে?
তাজউদ্দিন সাহেবকে তার আটকের কথা আমি বলেছিলাম। অনুরোধ করেছিলাম এ ব্যাপারে সাহায্য করতে। তিনি আমার অনুরোধের খুবই মূল্য দিয়েছেন।
জানালেন রেজাভাই। আমরা হাঁটতে হাঁটতে পার্ক সার্কাসের মাঝামাঝি আমাদের বাসার গেটে এসে দাঁড়াতেই দারোয়ান গেট খুলে দিল। ওপরে এসে দেখি পারুলের ঘরে বাতি জ্বলছে। বারান্দায় আমাদের পায়ের শব্দ পেয়েই পারুল দরজায় এসে মুখ বাড়াল, কী ব্যাপার তোমরা এত রাতে কোথায় গিয়েছিলে?
ইমাম বলল, একটু পায়চারী করছিলাম রাস্তায়। বাইরে রেজা সাহেবের সাথে দেখা। এরা রেজা সাহেবের সঙ্গী। আমাদের বাসার উদ্দেশ্যেই আসছিলেন। এদের রাতের খাবারের ব্যবস্থা করতে হবে। আছে কিছু?
পারুল একটু বিব্রত হয়ে আমার দিকে ফিরে বলল, সামান্য কিছু ভাত আর মুরগীর সুরুয়া গরম করে দিতে পারি।
চমৎকার, তাই দিন।
হেসে বললেন রেজাভাই।
ইমাম জিজ্ঞেস করল, ভাত কম থাকলে তোমার ভাঁড়ারে পাউরুটি পাওয়া যাবে না?
সকালের নাস্তার জন্য রাখা আস্ত দুটি পাউরুটি বের করে দিতে পারি।
তাই দাও। জলদি।
ইমামের কথায় পারুল রান্নাঘরের দিকে যেতে উদ্যত হলে আমি বললাম, আমি নন্দিনীকে জাগিয়ে দেব?
এত রাতে তাকে জাগিয়ে কষ্ট দেয়ার কী দরকার? আমিই খাবার এনে দিচ্ছি। আপনারা বরং খাবার টেবিলে একটু অপেক্ষা করুন।