উত্তেজনায় ও গভীর ঘৃণায় নন্দিনী আবার আমাকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল। আমি তার এ কান্নায় বাধা না দিয়ে তাকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে থাকলাম। নন্দিনী এমনভাবে কাঁদছে আমার মনে হল তার ভিতরের কোনো রুদ্ধ কপাটের খিল যেন কে ভেঙে দিয়েছে। আমি তার প্রতি আর কোনো সান্ত্বনার শব্দ উচ্চারণ করতে পারলাম না। বলতে পারলাম না, নন্দিনী শান্ত হও, তোমার সব দুর্ভাগ্যের কথা আমাকে খুলে বল। আমি শুধু নিবিড়ভাবে তাকে বুকের মধ্যে নিয়ে তার অন্তরের কাতরতার ঢেউগুলো অনুভব করতে লাগলাম। কাঁদতে কাঁদতে নন্দিনী এক সময় স্তব্ধ হয়ে এল। আমি একবার তার আমাকে জড়িয়ে ধরে রাখা হাতের বাঁধন আলগা করে দিয়ে বললাম, এস তোমাকে মিতুর খাটে রেখে আসি। তোমার একটু ঘুমের প্রয়োজন।
নন্দিনী যেন হঠাৎ সম্বিৎ পেয়ে, নিজেকে আমার কাছ থেকে সম্পূর্ণ আলাদা করে নিয়ে জিজ্ঞেস করল, সেই নির্মমতার ঘটনা তুমি শুনতে চাও না?
চাই। এখন একাকী এই ঘরে যে বিষয় বা ঘটনা তোমাকে এমন কাতর করেছে তা যদি বলতে থাক নন্দিনী তবে তুমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলবে। তোমার শরীর কতটা দুর্বল হয়ে পড়েছে তা আমি বুঝতে পেরেছি। এ অবস্থায় আমি তোমার বিবরণ শোনার কৌতূহল দেখাতে পারি না। কাল সকালে তুমি তোমার চাক্ষুস দেখার বিবরণ দিও পরিবারের সকলের সামনে। আমার বোন, ভাগ্নি ও ভগ্নিপতিকে। রেজাভাইও শুনবে। এরা সবই মুক্তিযোদ্ধা। সবাই শুনুক সে কাহিনী। তখন বলতে গিয়ে তুমি আর কাঁদবে না। তোমার মধ্যে তখন ক্রোধ জেগে উঠবে। পশুত্বের বিরুদ্ধে মনুষ্যত্বের ক্রোধ। কান্না নয় ঐ ক্রোধ আমি আগামীকাল তোমার মধ্যে দেখতে চাই। নন্দিনী আমি তোমাকে আরও নিবিড়ভাবে ভালবাসতে চাই।
আমার কথায় নন্দিনী আশ্বস্ত হয়ে উঠে দাঁড়াল।
আমি তাহলে মিতুর কাছে গিয়ে শুয়ে পড়ি।
বলল নন্দিনী। আমিও দরজার ছিটকিনি খুলে দিয়ে বললাম, এস নন্দিনী।
.
আমার দুচোখে আর ঘুম নেই। নন্দিনী কী দেখে এমন ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছে তা ভাবতে লাগলাম। আমি চিন্তা করে পাচ্ছি না প্রকৃতপক্ষে কী ঘটেছে? যদিও নন্দিনী তার বলার সময় ঘটনার একটা আতংকজনক ইঙ্গিত দিয়েছে। তবুও ঘটনার বৃত্তান্ত সে বলে নি। কে জানে আগামীকাল কী বর্ণনা তার মুখ থেকে শুনতে হবে? নিশ্চয়ই এমন কোনো ঘটনা যা নন্দিনীর মতো এক লাঞ্চিত নারীকেও মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং ক্যাম্পের শপথ বাণীতে সন্দেহ জাগিয়ে তুলেছে। সে বিবরণ আমাকেও কী নন্দিনীর মতো দ্বিধান্বিত করে তুলবে? তাহলে সে বর্ণনা আমার না শোনাইতে উত্তম। অথচ আমি নন্দিনীকে একটু আগে কথা দিয়েছি আমরা একটি পরিবারের সবাই মিলে এবং কমরেড রেজাসহ এ কাহিনী শুনব। আমি বিছানায় এপাশ ওপাশ করেও চোখে ঘুম আনতে পারছি না। এর মধ্যে দুটি সিগ্রেট ফোকা হয়ে গেছে। ঘুম না পেলে সাধারণত আমি বিছানায় গড়াগড়ি যেতে পারি না। বাতি জ্বালিয়ে বই পড়ি কিংবা রাস্তায় বেরিয়ে গিয়ে পায়চারী করি। কিছুই ভালো লাগছিল না। একবার ভাবলাম, নিচে নেমে গিয়ে দারোয়ানকে বলি গেট খুলে দিতে। একটু ঘুরে আসি কিংবা একটু এগিয়ে গিয়ে পার্কসার্কাসের কোনো রাতজাগা দোকান থেকে সরভাসানো গাঢ় চা খেয়ে আসি। আমি জানি কলকাতার এদিককার মুসলমান পাড়াগুলোতে এমন অনেক চায়ের দোকান আছে যা সারারাত খোলা থাকে। হয়ত চা খেয়ে একটু পায়চারী করে এলে মনের ভার নেমে যাবে। হয়তো ঘুমিয়ে পড়তেও পারি।
আমি বিছানা থেকে নেমে শার্ট প্যান্ট পরে নিয়ে ঘরের বাইরে এলাম। বারান্দায় এসেই মনে হল একটু শীত লাগছে। আমার ঘড়িতে এখন রাত দেড়টা। রাত বারটার পর থেকে শুরু হয়েছে ডিসেম্বরের এক তারিখ। শীতের আমেজটা বুঝলাম। শীত আসছে অথচ আমার বা নন্দিনীর শীতের কোনো কাপড় কেনা হয় নি। সিঁড়ির কাছে এগিয়ে যেতেই কে যেন পেছন থেকে ডাকল।
কবি ভাই কী নিচে যাচ্ছেন?
আমি ঘাড় ফিরিয়ে দেখলাম ইমাম তার ঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দার পেসে এসে দাঁড়িয়েছে।
আপনি এখনও জেগে আছেন?
ঘুম পাচ্ছিল না। দেখলাম আপনি ঘর থেকে বেরুলেন।
আমারও ঘুম পাচ্ছে না। নিচে রাস্তায় পায়চারী করতে যাচ্ছি।
আপনার আপত্তি না থাকলে আমাকেও নিন না।
চলুন।
দাঁড়ান, আপনার জন্য একটা কোট এনে দিই।
বলে ইমাম ঘরের ভেতর চলে গেল। আমি সিঁড়ির ওপর দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম। একটু পরেই সোনালি বোতামঅলা একটা নীল ব্লেজার এনে আমার হাতে দিল।
নিন আপনার শীতকালটা এটা দিয়ে পার করে দিতে পারবেন। আমি মাত্র একটা শীতে পরেছিলাম। নতুনই আছে।
আমি ব্লেজারটা গায়ে দিয়ে বললাম, একেই বলে রাজার কপাল।
ইমাম বলল। সেও একটা কাশ্মীরি শাল গায়ে চাপিয়েছে। আমরা সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলাম।
.
আমরা রাস্তায় খানিকক্ষণ পায়চারী করে একটা গলির ভেতরকার চায়ের দোকানে এসে ঢুকলাম। কাউন্টার পার হয়ে টেবিলে বসা মাত্রই তিনজন সঙ্গীসহ রেজাভাই এসে দোকানে ঢুকলেন। কাকতালীয় যোগাযোগ। আমি হাত তুলে রেজাভাইয়ের দিকে ইঙ্গিত করতেই তার সাথের তিন সঙ্গী হকচকিয়ে আমার দিকে মুহূর্তের মধ্যে ফিরে দেখেই রেজাভাইকে আড়াল করে দাঁড়াল। তাদের প্রত্যেকের ডান হাত পকেটে ঢোকান। এ অবস্থায় আমিও হতভম্ব হয়ে গেলাম। ততক্ষণে রেজাভাই ব্যাপারটা আন্দাজ করে সঙ্গের লোকদের হাত দিয়ে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে সামনে এগিয়ে এলেন, আরে এতরাতে আপনারা এখানে কী করছেন?