কথাগুলো বলে নন্দিনী একটা বড় নিশ্বাস ফেলে অন্ধকারে চুপ করে গেল।
আর কিছু বলবে?
তোমাকে বিবাহিত জেনেও তোমাকে কামনা করতে বাঁধেনি। আমার সমস্ত দেহমন তখন তোমাকে সঁপে দিতে আমি প্রায় পাগল হয়ে গিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম তোমার স্ত্রীর ছবি আমি এ জনমের মতো তোমায় হৃদয় থেকে মুছে ফেলতে পারব। কিন্তু আমি জানতাম না হামিদা এমন শক্তিশালী মেয়ে যে স্বদেশের জন্য নিজের স্বামীকেও তুচ্ছজ্ঞান করে এত অসুবিধার মধ্যে যুদ্ধের শপথ নিয়ে মৃত্যুর মুখোমুখি হবে। বৌদি আমার সমস্ত অহংকারকে তছনছ করে দেয় যেদিন আমি পারুল ও মিতুর কাছে হামিদার শারীরিক বর্ণনা শুনি এবং তার তোমাকে ছেড়ে যাওয়ার মুহূর্তের কান্নার কথা শুনি তখনই বুঝতে পারি আমার সাধ্য নয় এই নারীর কাম্য পুরুষকে শুধু ভালবাসার জোরে দখল করে নিতে পারব। যে মেয়ে কর্তব্য পালনের জন্য নিজের পুরুষকে হেলায় অন্য নারীর দ্বারা বেদখলের বিপদ জেনেও ফেলে চলে যেতে পারে তার মনে প্রেমের ওপর ভরসা আমার চেয়ে অনেক বেশি। আমি সাময়িকভাবে আমার দেহের মোহে তোমাকে ভোলাতে পারলেও, এ মোহ ভেঙে যেতে বেশি দেরি হবে না। হামিদার মতো সাহসী মেয়েকে যে একদা ভালবেসেছে সে আজ না হোক কাল তার জন্য অনুতাপে এবং অনুশোচনায় দগ্ধ হবেই এবং আমাকে ভাববে সমস্ত অনিষ্টের মূল।
অর্থাৎ আমি তোমাকে ঘৃণা করতে শুরু করব। এই তো?
ঠিক তাই। তুমি স্বীকার কর বা না কর ঠিক তাই।
এই জন্যই বোধহয় ইসলামের একাধিক বিবাহের সুযোগটা খুঁজছ এবং ধর্ম পরিবর্তন করতেও চাও?
হ্যাঁ, তোমার অনুমান মিথ্যে নয়। তোমার ধর্মের একাধিক বিবাহের ব্যাকগ্রাউন্ড এখন আমি বুঝতে পারি। খুবই বাস্তবসম্মত এই উদার অনুমতি। এই সুযোগ নিতে পারলে আমি তোমার সাথে ব্যাভিচারের পাপ থেকে বেঁচে যাই। আর তোমার রক্ষিতা হয়েও থাকতে হয় না। আমাকে বাঁচাও কবি। আমাকে বাঁচাও কবি। যদি আমাকে মুহূর্তের জন্য একবার একটুও ভালোলেগে থাকে তবে তোমার ভালবাসার দোহাই, আমাকে বাঁচাও।
বলেই নন্দিনী আমাকে অন্ধকারে দুহাতে জড়িয়ে ধরে আবার ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। আমি তাকে সান্ত্বনা দিয়ে পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললাম, ভবিষ্যতে কী ঘটবে তা আমি জানি না নন্দিনী। তবে আমার প্রতিশ্রুতি আমি ভঙ্গ করব না। তোমাকে কোনো অবস্থাতেই পরিত্যাগ করব না আমি। আমি আমার স্ত্রীকেও জানি। সেও তোমার মর্যাদা রক্ষা করতে কোনো কসুর করবে না। এর জন্য অনিচ্ছায় কেন তোমাকে ধর্ম পরিবর্তন করতে হবে?
আমার কথায় হঠাৎ নন্দিনীর কান্না থেমে গেল। সে বিছানা থেকে উঠে গিয়ে সুইচ হাতড়ে বাতি জ্বালিয়ে দিয়ে বলল, অনিচ্ছায় তোমাকে কে বলল? স্বেচ্ছায় আমি ইসলাম গ্রহণ করতে চাই।
স্বেচ্ছায় নয়, বল আমি মুসলমান বলেই তুমি মুসলমান হতে চাও। তুমি তো ইসলাম সম্বন্ধে কিছুই জান না। এ যুদ্ধের পর একথা যখন জানাজানি হবে তখন এর পরিণাম চিন্তা করেছ?
পরিণাম?
সকলেই বলবে কবি হাদী মীর মুক্তিযুদ্ধের সময় একটা অসহায় হিন্দু মেয়েকে জোর করে ধর্মান্তরিত করে বিয়ে করেছে। আমার প্রতিদ্বন্দ্বিরা আমার কবিখ্যাতিতে কালিমা লেপনের চেষ্টা করবে। সকলে মিলে আমার জীবন অসহনীয় করে তুলবে।
আমার কথায় নন্দিনী খানিকক্ষণ নিষ্পলক চোখে আমাকে দেখল। তারপর মুখটা ঘুরিয়ে নিল দেয়ালের দিকে। সেখানে একটা পটচিত্রে কালিঘাটের আঁকা স্বাস্থ্যবতী কোনো দেবী বা বাংলার চিরন্তন বঁধুর মুখ।
এতদিন কিন্তু এসব খ্যাতি অখ্যাতি বা পরিণাম চিন্তা তোমার মনে ঠাঁই পায় নি।
ঠাঁই পায় নি কারণ কোনো পুরুষই তোমার মতো রূপসী নারীকে হাতের কাছে পেলে পরিণাম ভেবে দেখবে না। আমিও তো পুরুষ নন্দিনী। আমারও তো বন্য কামনা বাসনা আছে?
আমি কী খুবই সুন্দরী কবি?
জানি না, আয়নার নিজেকে দেখ গিয়ে।
আমার কথায় আমরা উভয়েই হেসে ফেললাম।
অবস্থাটা একটু হালকা হলে বললাম, চল তোমাকে মিতুর ঘরে দিয়ে আসি। রাত তো অনেক হয়েছে। একটু না ঘুমালে তোমার শরীর খারাপ হবে।
যাবার আগে আর একটা কথা বলতে চাই।
কি কথা?
ট্রেনিং ক্যাম্পে না ফেরার প্রকৃত কারণটা তোমাকে খোলাখুলি বলা হয় নি।
তুমি বলতে চেয়েছিলে কিন্তু আমিই শুনতে চাই নি। শুনে কী হবে, সব জায়গাতেই কিছু নোংরা লোকজন থাকে যারা মানুষ নামের কলঙ্ক। তাবলে মুক্তিযুদ্ধটাই খারাপ একথা তোমার মুখে শুনতে আমার ভাল লাগবে না বলে শুনতে ইচ্ছে করে নি।
আমি মুখ ফিরিয়ে নিলাম।
নন্দিনী বলল, আমি শুধু মানুষের লোভের কথা তোমাকে বলতে চেয়েছিলাম তুমি সেটুকু শোনারও আগ্রহ দেখাও নি। আমি সেসব অসুবিধেকে পরোয়া করি না। কিন্তু যেজন্য ট্রেনিং ক্যাম্পে ফিরে যাওয়ার ব্যাপারে আমার মন বিষিয়ে গেছে সেটা কোনো লোভী মানুষের নোংরামো নয়। সেটা একজন নির্দোষ নিরপরাধ মানুষের হত্যাকান্ড। যা আমার চোখের সামনে ঘটেছে। যে অন্যায়ের প্রতিবাদ করলেও প্রতিরোধ করতে পারি নি। আমার দিনের আহার ও রাতের ঘুম যে দৃশ্যটি কেড়ে নিয়েছে কবি। যে অসহায় মুখখানির নিরুপায় দৃষ্টি ও ঈশ্বরের কাছে কাতর প্রার্থনার দৃশ্য আমাকে তাড়া করে ফিরছে। যার ফলে আমার মনে হাজার হাজার বাঙালি বীরের আত্মত্যাগের মহিমা, আমার বোনের মৃত্যু, আমার ভগ্নিপতির নিখোঁজ হওয়া, আমার সম্ভ্রম লুণ্ঠন ইত্যাদি যা কিছু আমরা বাংলাদেশের মুক্তির জন্য উৎসর্গ করেছি, সবকিছুর ওপরই কালি ঢেলে দিয়েছে। মনে হচ্ছে আমি কোথায়, কাদের সঙ্গে আছি? কেন আছি? প্রকৃত মুক্তিযুদ্ধ কোথায় চলছে? কারা সেই মুক্তিযোদ্ধা? আর সেই মুহূর্তে ভেসে উঠেছে কমরেড রেজার মুখ, তোমার আর নাসরিনের মুখ। সুযোগ পেয়েই সেই নরক ছেড়ে আমি ছুটে এসেছি তোমার কাছে এখানে, যেখানে ইমাম সাহেবের মতো উদারচেতা দাদা, পারুলের মতো বোন আর মিতুর মতো সুন্দর শিশুরা স্বাধীনতা যুদ্ধে বিজয়ের জন্য কাল গুনছে। কবি, এই যুদ্ধের খারাপ দিকগুলো তুমিও কম দেখ নি কিন্তু আমি যা দেখেছি তা যেন কোনো বাঙালি নারীর দেখার দুর্ভাগ্য না হয়। আমিও যোদ্ধা, হত্যার মন্ত্র আমিও নিয়েছি। হানাদার পশুদের বিরুদ্ধে আমার যুদ্ধ। কিন্তু যে আমাদের প্রতিজ্ঞার সাথে শত্রুতা সাধন করে নি কিংবা এই লড়াইয়ের তাৎপর্য সম্বন্ধে সম্পূর্ণ অজ্ঞ এবং নিরপরাধ, যে একটা মসজিদে ঈশ্বরের গুণগান করছে, এমন অবস্থায় তাকে ধরে এনে বিনা প্রমাণে যারা তাকে গুলী করে মারল, আমি তাদের কাছে ফিরে যেতে চাই না কবি। আমি তাদের ঘৃণা করি, ঘৃণা করি, ঘৃণা করি…